হৃদয়ের রানির রাজসিক বিদায়

ছবি: সংগৃহীত

‘আমরা সবাই এই সময়ে, এই জায়গার দর্শনার্থী। এখানে আমাদের উদ্দেশ্যই হলো পর্যবেক্ষণ করা, শেখা, বেড়ে ওঠা, ভালোবাসা এবং তারপর আমরা বাড়ি ফিরে যাই।’ —রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ।  
বালমোরাল প্যালেস থেকে রানি ফিরে এলেন পতাকাশোভিত বাকিংহাম প্যালেসে। হীরা–মণি–মুক্তাখচিত রাজমুকুট এবং ফুলে ফুলে সজ্জিত কফিন। বিগব্যান বেজে উঠেছে, করুন সুরে বাজছে বিউগল। মোমবাতি আর ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে গোটা প্যালেস চত্বর। লাখোকোটি মানুষের হৃদয়ের রানির প্রয়াণে শোকগ্রস্ত রাজপরিবার আর গোটা জাতি। এরপর শেষবারের মতো আসেন ওয়েস্টমিনস্টার হলে। হৃদয়নিংড়ানো ভালোবাসায় রানিকে বিদায় জানাতে সব শ্রেণির মানুষের ঢল ওয়েস্টমিনস্টার অভিমুখে। শ্রদ্ধা, ভালোবাসা, ফুল আর নীরবতায় বিদায় জানাচ্ছেন তাঁর শেষযাত্রায়।

ছবি: সংগৃহীত

এলিজাবেথ আলেকজান্দ্রা মেরি। ১৯২৬ সালের ২১ এপ্রিল লন্ডনে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৬ সালের ১১ ডিসেম্বর তাঁর বাবা কিং জর্জ সিংহাসনে অভিষিক্ত হলে মাত্র ১০ বছর বয়েসে তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের উত্তরাধিকারী হন। ১৪ বছর বয়সে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরুতে কিশোরী প্রিন্সেস এলিজাবেথ এবং প্রিন্সেস মার্গারেট পরিবারহারা শিশুদের মনোবল বৃদ্ধি করেন রেডিও বার্তার মাধ্যমে। তিনি ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রথম নারী, যিনি ব্রিটিশ আর্টিলারি সার্ভিসে যোগ দেন এবং সরাসরি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে অংশ নেন অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসে যোগদানের মাধ্যমে।

১৯৫২ সালে ব্রিটেনের সিংহাসনে অভিষিক্ত হওয়ার পর থেকে তাঁর পরিবার ও জীবনে অনেক ঝড়ঝাপটা গেছে, কিন্তু রানি তাঁর প্রতিজ্ঞা ভোলেননি। তিনি তাঁর কর্তব্য থেকে নড়েননি একচুল। দীর্ঘ ৭০ বছর নিষ্ঠার সঙ্গে তাঁর রাজকীয় দায়িত্বের পাশাপাশি কমনওয়েলথের প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করে গেছেন। তিনি যুক্তরাজ্য এবং কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর ১৪৪ মিলিয়ন মানুষের রানি ছিলেন। ব্রিটিশ ইতিহাসে তিনিই সবচেয়ে বেশিকাল রাজত্ব করেছেন। এমনকি মৃত্যুর আগমুহূর্ত পর্যন্ত রয়্যাল ডিউটি পালন করেছেন মহামান্য রানি। বালমোরাল প্যালেসে ইংল্যান্ডের নতুন প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসকে সাক্ষাৎ দেন তিনি। তাঁর রাজত্বকালে উইনস্টন চার্চিল থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডে মোট ১৫ জন প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন।    

ছবি: সংগৃহীত

রানি ব্রিটেনের জনগণের বিপদে যেমন পাশে থেকেছেন, ঠিক তেমনিভাবে জনগণের প্রতিটি আনন্দ কিংবা অনিশ্চয়তা অথবা জাতির দুঃখের সময় জনগণের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন।

২০১৭ সালে রানি রয়্যাল ম্যানচেস্টার হাসপাতালে যান ‘ম্যানচেস্টার অ্যারেনায়’ বোমা হামলায় আহত শিশুদের দেখতে। একই বছর তিনি ছুটে যান ভয়াবহ আগুনে পুড়ে যাওয়া ভবন ‘গ্রিনফেল টাওয়ার’ দেখতে। তিনি সেখানকার বাসিন্দা, ফায়ার সার্ভিসের সদস্য এবং স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলেন। সাম্প্রতিক সময়ে ২০২০ সালে পৃথিবীব্যাপী করোনা মহামারির সময় এক টেলিভিশন বার্তায় তিনি জনগণকে আশ্বস্ত করেছেন, সাহস জুগিয়েছেন। পাশাপাশি ফ্রন্টলাইনে থেকে কাজ করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন এনএইচএসের কর্মীদের।    

২০১২ সালে লন্ডন অলিম্পিক উদ্বোধনীতে জেমস বন্ডের সঙ্গে সিক্রেট মিশনে গোলাপি ড্রেস পরা রানিকে দেখে ভীষণ অভিভূত হয়েছিলাম।

ছবি: সংগৃহীত

সাম্প্রতিক কালে ‘উইন্ডসর’ সম্পর্কে প্রচারিত নেটফ্লিক্সের টিভি সিরিজ ‘দ্য ক্রাউন’ ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করায় রানি ও ব্রিটিশ রাজপরিবারের প্রতি জনসাধারণের আগ্রহ অনেক গুণ বেড়ে গেছে। অর্থ ও সম্পত্তির মালিকানায় পৃথিবীর অন্যতম ধনী নারী হলেও ব্যক্তিগত জীবনে তিনি খুবই সাদামাটা জীবন যাপন করতেন। রেসের ঘোড়া ও কুকুর পুষতেন রানি।        

এই তো সেদিন রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের প্লাটিনাম জুবিলি উপলক্ষে হইহুল্লোড় করলাম, নেচেগেয়ে আনন্দ করলাম। এ উৎসব সর্বস্তরের মানুষকে একত্র করেছিল। জাতি–বর্ণ–ধর্ম–বয়সনির্বিশেষে সবাই প্রিয় রানির রাজত্বকাল উদ্‌যাপন করে। লন্ডনের রাস্তায় রাস্তায় স্বতঃস্ফূর্ত মানুষের যে আনন্দ আমি দেখেছি, তা ছিল শুধু হৃদয়ের গভীরের ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ। ১৯৫২ সালে ব্রিটিশ সিংহাসনে আরোহণ করা রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথ আজীবন নিঃস্বার্থ সেবার জন্য পৃথিবীর মানুষের কাছে অমর হয়ে থাকবেন।

ব্রিটিশ ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘকাল যিনি রাজত্ব করেছেন, যিনি অগণিত মানুষের জন্য অনুপ্রেরণা, হাজারো মানুষের সঙ্গে আজ এসেছি তাঁর শেষযাত্রায় শামিল হতে। প্রায় ১০ কিলোমিটার হেঁটে, সকালে টাওয়ার ব্রিজ থেকে পদযাত্রা শুরু করে গোধূলিবেলায় এসে শেষ করেছি।

নীরবতার কী যে এক অপার শক্তি, তা টের পেয়েছি রানির কফিনের পাশে এসে। সুনসান ওয়েস্টমিনস্টার হলের ভেতর ঢুকতেই অদ্ভুত এক শিহরণ অনুভব করেছি। কফিনের ওপর শোভিত মুকুটের জাজ্বল্যমান হীরার দ্যুতি মুহূর্তের জন্য চোখ ধাঁধিয়ে দেয়। মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে গিয়ে রানির কফিনের পাশে কিছুক্ষণ নীরবে দাঁড়িয়ে থাকলাম। শান্তিতে ঘুমান আমাদের হৃদয়ের রানি। এরপর বেরিয়ে আসার সময় আরও একবার পেছন ফিরে তাকালাম। মনে হলো খুব প্রিয়জন কাউকে ফেলে যাচ্ছি। কখন যে চোখের কোণে জমেছে এক ফোঁটা জল, টের পাইনি। বুকে চাপা একটা ব্যথা নিয়ে এসে বসলাম টেমসের পাড়ে।
তথ্য সূত্র: বিবিসি, এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকা, ব্রিটিশ রয়্যাল ফ্যামিলি অফিশিয়াল পেজ