এক গ্লাস বিয়ার, তার মধ্যে দুই টুকরা আইস

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

১৭ কি ১৮ বছরের যুবক, নামটা জিজ্ঞেস করতে পারিনি। একটি চকচকে কাচের গ্লাসে বিয়ার আর তার মধ্যে দুই টুকরা আইস দেওয়া, এমন একটা গ্লাস হাতে নিয়ে দ্রুতগতিতে দোকানে প্রবেশ করল। সে ফ্রিজের দিকে গেল, উদ্দেশ্য কোনো কোমল পানীয় কেনা। তবে এখানে বলে রাখা মন্দ নয় যে এ–জাতীয় লোক দোকানে ঢুকে হাঁটা অবস্থায় কিছু একটা চুরি করে শরীরে লুকিয়ে সটকে পড়ে।

যা–ই হোক, নেশাজাতীয় খাবার হাতে থাকায় ওই যুবককে বিন্দুমাত্র দেরি করার সুযোগ না দিয়ে দূর দূর করে দোকান থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হলো। সুতরাং যুবকটি তার সৎ বা অসৎ মতলবটি হাসিল করতে পারেনি তখন।

যুবকটির শরীর বেশ শক্ত। দোকান থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার পর যখন সে দ্রুত বের হয়ে গেল, তাতে দেখা গেল, তার হাঁটার লাইন ঠিক আছে। অর্থাৎ, মাতাল এখনো হয়নি, হেলেদুলে পড়ছে না। বুঝতে পারলাম, এক গ্লাস বিয়ার আর তার মধ্যে দুই টুকরা আইস তাকে কাবু করতে পারে না।

এমন হেলেদুলে পড়া অনেক লোককে দেখা যায়, কাস্টমার হয়ে দোকানে আসে। এক–দুটি সিগারেট বা এক পিচ রিজলা কিনতে আসে। রিজলা হচ্ছে খুব পাতলা একটা পেপার, যার ওপর গাঁজা রেখে সুখটান দিলে আস্ত শরীরটা শূন্যে ভাসানো দোলনায় বসে। এমন মাতাল অবস্থায় আসে যে সে না পারে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে, না পারে স্পষ্ট কণ্ঠে কথা বলতে। হেলেদুলে যখন কাউন্টারে এসে টাকা পে করে, তখন এক পা সামনে আসে তো দুই পা পিছে যায়। সেখান থেকে আবার দুই পা বাঁয়ে যেতে গিয়ে আইসক্রিমের ফ্রিজের সঙ্গে ধাক্কা খায়। তার এ অবস্থা দেখে পাশের কাস্টমার গুঁতো খাওয়ার ভয়ে চার কদম দূরে সরে থাকে। কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে, ড্রাংক কেন করো বা অতিরিক্ত ড্রাংকই–বা কেন করো—এমন প্রশ্ন বা প্রতিবাদ করার কেউ নেই।

সমাজে প্রতিবাদের ভাষা খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিল। এ দেশে হয়তো এমনটা অনেক আগে থেকেই হয়েছে, সেটা বুঝে নেওয়া যায়। এ দেশের স্কুলে যেমন শিক্ষকদের হাতে বেত নেই, তেমন মুরব্বিরাও পারেন না অন্যের সন্তানের শাসন করতে। অন্যায় কিছু দেখলে ধমক দেওয়াও বিপদ। তেমন কিছু করতে গেলে হিতে বিপরীত হতে পারে।

আসলে নিজের পরিবার থেকেও ঠেকানোর ইচ্ছা খুব কম। পরিপূর্ণ বয়স হলে তো কোনো কথাই নেই, আর ঠেকায় কে? এক গ্লাস বিয়ার আর তার মধ্যে দুই টুকরা আইস নিতে কোনো ভয় নেই।
কেন ঠেকাবে? ঠেকানোর উপায় তো নেই। আমরা যেমন আমাদের মা–বাবা, ভাইবোন মিলে একসঙ্গে বসে খাবার খেয়েছি, এ দেশেও তেমন দেখা যায়। তবে আমাদের খাবার টেবিলে কোনো ধরনের বা কারও জন্যই এক গ্লাস বিয়ার আর তার মধ্যে দুই টুকরা আইস বরাদ্দ থাকে না। কিন্তু এ দেশে সবার জন্যই তা থাকে।

স্কুলের ছাত্রদের ব্যাগে বোতল দেখলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। শাসনের অভাবে সিঙ্গেল সিগারেট কিনতে দোকানে ছুটে না যাওয়া শিক্ষার্থী খুব কম নজরে আসতে পারে। শুধু সিঙ্গেল সিগারেট নয়, রিজলাও কিনে থাকে। শুধু সিগারেটে কি আর সুখ ধরা দেয়! তাই তো গাঁজা না হলে চলেই না। ছুটির পর দলবদ্ধ হয়ে রাস্তার ওপর গাঁজার টান দিতে দেখা যায় অহরহ। এক গ্লাস বিয়ার আর দুই টুকরা আইসে মত্ত হলে কি দোষ থাকে তাতে? তা–ও একদম রাস্তার ওপর। কে দেখবে তার কোনো চিন্তা নেই। স্কুলের শিক্ষক দেখতে পারেন, বড় ভাই বা মহল্লার মুরব্বিরা দেখতে পারেন, বাপ–চাচারা দেখতে পারেন, এমন কোনো চিন্তা বা ভয়ের কোনো বালাই নেই কারও অন্তরে। সখী স্বাধীনতা কারে কয়?

হ্যাঁ, স্বাধীনতা তো এমনই হয়। একটা স্কুলপড়ুয়া মেয়ে দোকানে ঢুকে একটা সিঙ্গেল মালবোরো ব্লু সিগারেট কিনে দোকান থেকে গ্যাসলাইট নিয়ে সিগারেটটা ধরিয়ে ধোঁয়া ক্রেতার মুখে মেরে দোকান থেকে বেরে গেল। হাতে সিগারেট, কোনো সংকোচবোধ নেই। টানতে টানতে বাড়ির দিকে চলে গেল। এটা তার স্বাধীনতা। এমনও দেখা গেছে, পিতামাতা সিগারেট কিনে দিচ্ছেন তাঁদের ছেলেমেয়েকে। আবার মা বা বাবা রাস্তার ওপর গাড়িতে বসে থেকে তাদের জন্য দোকানে সিগারেট কিনতে পাঠাচ্ছে শিশুসন্তানকে। তারা বড় হলে তো তখন নিজের জন্য আলবত সিগারেট কিনবে। তারপর একদিন হাতে নেবে এক গ্লাস বিয়ার আর তার মধ্যে দুই টুকরা আইস।

এক গ্লাস বিয়ার আর তার মধ্যে দুই টুকরা আইস পান করে কত মানুষকে জঙ্গলের বা রাস্তার পাশে শুয়ে থাকতে দেখা যায়, তার কোনো ইয়ত্তা নেই। এর কাছ থেকে দুই টাকা, ওর কাছ থেকে দুই টাকা চেয়ে চেয়ে এক গ্লাস বিয়ার আর দুই টুকরা আইস কেনার টাকা হলেই হলো, ব্যস। চলে যাবে মদের দোকানে, বোতল কিনে কেউ একা খাবে, কেউ পরিবার নিয়ে খাবে।

এখানে একটা সামাজিক অনুষ্ঠানে, পারিবারিক অনুষ্ঠানে, ক্রীড়া অনুষ্ঠানে বা যেকোনো ধরনের আড্ডায় অধিকাংশ উপস্থিতির হাতে এক গ্লাস বিয়ার আর তার মধ্যে দুই টুকরা আইস থাকবে না, তা প্রায় অসম্ভব।

এখানে মদ–বিয়ার পান উন্মুক্ত হয়। জনসমক্ষে পান করলেও তেমন একটা অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয় না। দক্ষিণ আফ্রিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা স্টেজে উঠে এক গ্লাস বিয়ার আর তার মধ্যে দুই টুকরা আইস দিয়ে পান করেছেন, তা আমরা টিভির পর্দায় দেখেছি। কিন্তু জনসমক্ষে গাঁজা সেবনের ওপর যথেষ্ট কড়াকড়ি আরোপ করা ছিল। কিন্তু এখন আর সে নিষেধাজ্ঞা নেই। এর ফলাফল সমাজের ওপর নিশ্চিত আঘাত করেছে এবং রন্ধ্রে রন্ধ্রে করে যাচ্ছে। অবশ্য যারা গাঁজা টানে বা যে সমাজের মানুষ গাঁজা সেবন করে, তারা হয়তো সমাজের ওপর কোন ধরনের আঘাত প্রবাহিত হচ্ছে, তা মূল্যায়ন করতে পারে না। বরং তাদের অনেকেই গাঁজার উপকারিতা স্বীকার করে থাকে, গাঁজা সেবনের পক্ষে যুক্তিও দিয়ে থাকে।

এক গ্লাস বিয়ার আর দুই টুকরা আইস পান করতে করতে কারও মুখ দিয়ে একটা অদ্ভুত মর্মযন্ত্রণাদায়ক দুর্গন্ধ বের হতে থাকে। এ–জাতীয় লোক দোকানে ঢুকলে আলাদা সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়। দ্রুত দোকান থেকে বের করার জন্য কৌশল গ্রহণ করতে হয়। তাদের শরীর দিয়ে মদ আর গাঁজার গন্ধ বের হতে থাকে। চলে যাওয়ার পরও দু–চার মিনিট গন্ধ বিদ্যমান থাকে। তাই চলে যাওয়ামাত্র দোকানের ফ্যান চালু করে এয়ার ফ্রেশ স্প্রে ছিটিয়ে দুর্গন্ধ দূর করতে হয়।

পিটার যখন রাস্তা দিয়ে হাঁটে, তখন হেলেদুলে হাঁটতে থাকে। পরে কি মরে অবস্থা। তাকে যদি বলা হয়, তুমি সোজা হেঁটে ওইখানে যাও, তবে সে কস্মিনকালেও যেতে পারবে না। কারণ, তাকে এক গ্লাস বিয়ার আর দুই টুকরা আইসে পেয়ে বসেছে। এ রকম পিটার দক্ষিণ আফ্রিকায় বহু আছে। শুধু কি তা–ই? অনেক আছে যারা এক গ্লাস বিয়ার আর দুই টুকরা আইস খেয়ে জঙ্গলে রাত কাটাচ্ছে। জঙ্গলের ডালপালা ভেঙে বিছানা বানিয়ে সেখানেই রাতভর ঘুম দিচ্ছে।

শুধু যে পুরুষেরা এক গ্লাস বিয়ার আর তার মধ্যে দুই টুকরা আইসের সঙ্গে সম্পৃক্ত, তা কিন্তু নয়। সমানে সমান সুযোগ নিয়ে নারীরাও পিছিয়ে নেই। তারাও হেলেদুলে আঁকাবাঁকা হয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলে। ভারসাম্যহীন কথাবার্তাও বলতে শোনা যায়। কারণ, স্বাধীনতা বলে একটা কথা আছে। কেউ এক গ্লাস বিয়ার আর তার মধ্যে দুই টুকরা আইস দিয়েও খেতে পারে, আবার কেউ পাঁচ গ্লাস বিয়ার আর তার মধ্যে সাত টুকরা আইস মিশিয়েও খেতে পারে।

শিক্ষকের হাতে বেত নেই, শিক্ষাব্যবস্থায় শাসন নড়বড়ে হয়ে গেছে। মুরব্বিদের মুখে ধমক নেই, সমাজের শাসন গোল্লায় গেছে। নেট দুনিয়ায় ছেলেমেয়েদের বুদ্ধি–বিবেক বেশি হওয়ায় তারা তো মা–বাবা–দাদাদের পাত্তাই দিতে চায় না। এ কারণে তারা যেকোনো বয়সে এক গ্লাস বিয়ার আর তাতে দুই টুকরা আইস নিয়ে যেকোনো জায়গায় আড্ডায় মত্ত হচ্ছে। ছেলেমেয়েরা গাঁজার সেবনের প্রস্তুতি নিচ্ছে অহরহ। মাদক সেবনে বিকৃত মস্তিষ্ক দেখা যায় সর্বত্র।

এতক্ষণে যতটা বকবক করলাম, তার উদ্দেশ্য আসলে আমার মুণ্ডু। হয়তো আমার মুণ্ডু কিছুটা হলেও বিগড়ে যেতে পারে। বিগড়ে যাওয়ার কোনো কারণ আছে কি না, তা–ও বুঝতে পারছি না। কোনো দিন এক গ্লাস বিয়ার আর তাতে দুই টুকরা আইস খেয়েছি কি না, তার উত্তর দেওয়ার আগে একটু ভাবনাতে যাওয়া উচিত।

তবে মাথা বিগড়ে গেলেও এটা মনে আছে যে বিশ্বের অনেক দেশ ছিল, যারা আগে এক গ্লাস বিয়ার আর তাতে দুই টুকরা আইস নিয়ে ভাবতে পারত না। মুষ্টিমেয় কিছু লোক গ্রহণ করলেও তা ছিল অতি গোপনে। কে দেখে ফেলবে, কে জেনে যাবে—তার একটা সংকোচ থাকত, গোপনীয়তা ছিল। তবে ইদানীং অনেক পরিবর্তন হচ্ছে বলে প্রতীয়মাণ হয়। ইয়াবা আর গাঁজা বেশ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এক গ্লাস বিয়ার আর তাতে দুই টুকরা আইস পাল্লা দিতে প্রস্তুত ইয়াবা আর গাঁজার সঙ্গে।

স্বাধীনতার নামে সব প্রতিষ্ঠান থেকে যে গতিতে শাসনব্যবস্থা চলে যাচ্ছে, তার থেকে দ্রুতগতিতে আমার দিকে ধেয়ে আসছে মাদকদ্রব্য। আমিও একদিন এক গ্লাস বিয়ার আর তাতে দুই টুকরা আইস হাতে নিয়ে বেরিয়ে আসব রাস্তায়। হেলেদুলে চলব, আঁকাবাঁকা হয়ে পথ হারাব। সমাজ ধ্বংসে থাকবে আমার ব্যাপক ভূমিকা। এক গ্লাস বিয়ার আর দুই টুকরা আইস খেতে খেতে একদিন পরিপক্ব হয়ে পাঁচ গ্লাস বিয়ার আর তাতে সাত টুকরা আইসে অভ্যস্ত হয়ে ন্যাকাবোকা হব।

বন্ধুদের সঙ্গে রাতদিন আড্ডা দেব, বোতল বোতল বিয়ার খাব। মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরব। ঝাপসা চোখে মস্তিষ্ক হবে এলোমেলো। অস্পষ্ট কণ্ঠে থাকবে অনিয়মের ভাষা। বাড়িতে ঢোকার সময় শরীর দুলবে আর বলব, ‘আমি মুত (মদ) খেয়েছি।’ এক গ্লাস বিয়ার আর তাতে দুই টুকরা আইস পাগল করবে আমাকে। আর পাগল হব বলেই তো সব স্তরের শাসনব্যবস্থাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেব হানু নদীর তলদেশে। তখন সমাজ থেকে স্লোগান আসবে এমন—
সমাজ: গাঁজা তুমি এগিয়ে চলো
মাদক : আমরা আছি তোমার সঙ্গে।
আর আমি এক গ্লাস বিয়ার আর তার মধ্যে দুই টুকরা আইস হাতে নিয়ে বলব, ‘আমার সমর্থন রইল তোমাদের প্রতি।’

  • লেখক: মাহফুজার রহমান, দক্ষিণ আফ্রিকা