খলিল স্যার
সদ্য প্রয়াত অধ্যাপক খলিলুর রহমান। তিনি আমার শিক্ষাগুরু। আমাদের শিক্ষাগুরু। আমরা যাঁরা ১৯৯০ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (সাস্ট) রসায়ন বিভাগ থেকে পাস করে এসেছি, আমাদের সবার কাছে তিনি অসম্ভব শ্রদ্ধেয় একজন শিক্ষক। শুধু রসায়ন বিভাগে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য বিভাগেরও তিনি সমানভাবে পরিচিত ও পরম শ্রদ্ধেয় ছিলেন। আজ তাঁকে নিয়ে কয়েকটি কথা বলব বলেই এই লেখা।
ধবধবে সাদা চুল, এক রঙের চকচকে শার্ট, গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, পলিশ করা বুটে কী অসম্ভব স্মার্ট ও চৌকস লাগত স্যারকে। শেষের দিকে তিনি ডাবল কালারের সানগ্লাস পরা শুরু করেছিলেন। সেই সময়ে না বুঝলেও এত দিন পর এসে খুব ভালো করে বুঝি, রসায়ন বিষয়ে তাঁর ছিল অগাধ পাণ্ডিত্য। রসায়নের বাইরেও পদার্থ, মহাকাশবিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য প্রভৃতি বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল অসাধারণ। তাঁর পড়াশোনা ও জানাশোনা নিয়ে এখানে আমি কোনো আলোচনায় যেতে চাচ্ছি না। কারণ আমার মনে হয়, তাঁকে নিয়ে আলোচনা করার মতো প্রজ্ঞা ও জ্ঞান—কোনোটাই আমার এখনো হয়নি। তাই আজ মূলত আমাদের সেই সময়ের খলিল স্যারকে ঘিরে আমার ব্যক্তিগত কিছু স্মৃতি সবার সঙ্গে শেয়ার করব।
আমার মনে হয়, খলিল স্যারের প্রখর ব্যক্তিত্বের মূল ভিত ছিল তাঁর নিরেট সততা। যা সত্য, যা সুন্দর, তা তিনি মুখের ওপর বলে দিতেন। এ জন্য প্রথম দেখাতেই যেকোনো ছাত্রের মনে হতে পারে, তিনি খুব বদরাগী মানুষ। তাঁর রাগ আর ধমক ছিল ক্যাম্পাসে বিখ্যাত। এইচএসসি পাস করে আসা ছেলেমেয়েরা বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নিয়ম ভেঙে একটু এই-সেই করবে, এটাই তো স্বাভাবিক। কিন্তু খলিল স্যারের কাছে নিয়মের বাইরে কিছু করা চলবে না। আর যদি সেটি পড়াশোনায় ব্যাঘাত ঘটায় এমন কিছু হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। ক্লাস ফাঁকি দিয়ে বিভাগের করিডরে কেউ হাঁটছে এবং সে খলিল স্যারের মুখোমুখি হয়ে গেছে, তাহলে তার খবর আছে! এমন সব প্রশ্নের মুখোমুখি সে হবে, তাতে তার ‘ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি’ অবস্থা হবে! অন্য বিভাগের কেউ হলেও একই রকম ট্রিটমেন্ট। কারও মাফ নেই। কতজনকে যে আমাদের বিভাগের ক্লাস টাইমে বন্ধুদের খুঁজে এসে খলিল স্যারের তোপের মুখে জুতা ফেলে দৌড়াতে হয়েছে! কিন্তু এই রাগী স্যারের ভেতরটা ছিল জলের মতো টলটলে নরম ও স্নিগ্ধ। ছাত্রদের যেকোনো কষ্ট তাঁকে খুব ব্যথিত করত।
একটি ঘটনা বলি, স্যার আমাদের নিউক্লিয়ার কেমিস্ট্রি পড়াতেন। দুপুরের খাবারের পর ক্লাস। ক্লাস শুরুর একটু পরই সাধারণত বেশির ভাগ ছেলে আধো আধো ঘুম চোখে ক্লাস শুনত। এ সময় ঘুম আটকিয়ে রাখা খুব মুশকিল। স্যার ব্যাপারটি খেয়াল করলেন। এত ক্লান্ত থাকার কারণ জিজ্ঞেস করলেন। আমরা সবাই নিশ্চুপ! স্যার তখন জিজ্ঞেস করলেন, আজ দুপুরে কে কী খেয়ে এসেছে! আমরা সবাই শাহপরাণ হলের খাবারের দুরবস্থার কথা বললাম। পাতলা ডাল এবং অণুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়ে খুঁজে পেতে হয়, এমন এক টুকরা মাংস দিয়ে দুপুরের খাবার হয়। এই তথ্য স্যারের জানা ছিল না। খাবারের এই চিত্র প্রায় প্রতিদিনের, সেটিও তাঁকে জানালাম। স্যার আমাদের কথা শুনে ক্লাস থেকে চলে গেলেন। তাঁকে খুব বিচলিত মনে হয়েছিল। পরদিন ক্লাসে তিনি একটি চিঠি নিয়ে এলেন। বললেন, চিঠিটি তাঁর মেয়ে তাঁকে লিখেছিলেন। তাঁর মেয়ে যখন বিদেশের কোনো একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে থাকতেন, সেই সময়ের লেখা। চিঠিতে সেখানকার হল লাইফের একটি বর্ণনা আছে। সেখানকার ছাত্রদের হলের খাওয়াদাওয়া কেমন হয়, তা-ও বোধ হয় সেখানে লেখা ছিল। খুব কষ্ট নিয়ে সেদিন স্যার আমাদের বললেন, তোমরা যদি নিয়মিত ভালো খাওয়াদাওয়াই না করতে পারো, তাহলে পড়বে কীভাবে? পরে শুনেছিলাম, তিনি হলের প্রভোস্ট এবং সংশ্লিষ্ট সবার সঙ্গে আলাপ করে হলে খাওয়ার মান কীভাবে বাড়ানো যায়, তার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছিলেন।
ঝড়-বৃষ্টি বা গরম—কোনো কিছুই স্যারকে সময়মতো ডিপার্টমেন্টে আসতে বাধা দিতে পারেনি। আমার মনে হয়, কোনো বিশেষ অসুবিধা ছাড়া সারা জীবনে একবারের জন্যও অফিসে বা ক্লাসে দেরি করে যাননি। একটি ঘটনা মনে আছে। সকাল আটটার ক্লাস। প্রচুর বৃষ্টির দিন ছিল সেদিন। সঙ্গে ঝোড়ো বাতাস ছিল। আমরা ছাত্ররা টিলাগড় আর আম্বরখানার বাসে ঠিক সময়ই এসে ক্লাসে পৌঁছে গেলাম। তখন আটটার একটু ওপরে বাজে। স্যার চুপিচুপি আমাদের ক্লাসরুমের সামনে এসে জিজ্ঞেস করলেন, কোন স্যারের ক্লাস! আমরা স্যারের নাম বললাম। খলিল স্যার দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইলেন। একটু পরপর ঘড়ি দেখছেন। প্রায় ১৫ মিনিট পর ক্লাসের স্যার কাকভেজা হয়ে খলিল স্যারের সামনে দাঁড়ালেন! স্যার খুব শান্তভাবে তাঁকে বললেন, ‘আপনি ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টার থেকে ঠিক সময়ে আসতে পারলেন না, আর এই ছেলেমেয়েগুলো প্রায় ১০ কিলোমিটার দূর থেকে সময়মতো চলে এল। এখন আপনিই বলেন, এদের আপনি কীভাবে সময়জ্ঞান ও নিয়ম শেখাবেন?’ তাঁর দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ, নিয়মানুবর্তিতা, সততা আর শৃঙ্খলার কথা বলতে গেলে একটি উপন্যাস লেখা যাবে!
১৯৯৮ সালের বন্যার সময়ের একটি ঘটনা বলি! শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ পরীক্ষা পেছানোর পক্ষে। অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যার এবং প্রশাসন চাচ্ছে পরীক্ষা হোক। তাঁরা আমাদের মধ্য থেকে মেয়েদের একটি অংশকে পরীক্ষা দেওয়াতে রাজি করালেন। মেয়েরা দল বেঁধে গান গাইছে, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে’। বিশ্ববিদ্যালয় দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেল। প্রশাসন পরীক্ষা নেবে আর আমরা পরীক্ষা দেব না! তুমুল আন্দোলন শুরু হলো। পরীক্ষার দিন ছাত্রনেতারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি ভবনে তালা ঝুলিয়ে দিলেন। এখানে বলে রাখা ভালো, সেই সময় ক্যাম্পাসের বড় নেতাদের বেশ কয়েকজন ছিলেন কেমিস্ট্রির। সকালবেলা খলিল স্যার পরীক্ষার খাতাপত্র নিয়ে বি বিল্ডিংয়ের সামনে এলেন। গার্ডকে বললেন তালা খুলে দিতে। তিনি ছাত্রনেতাদের বললেন, ‘আমাকে তোমরা ভেতরে যেতে দাও। বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে দায়িত্ব দিয়েছে, আমি পরীক্ষা নিতে এসেছি। যদি একজন ছাত্রও পরীক্ষা দিতে আসে, আমি তার পরীক্ষা নেব। তোমরা আমাকে ফেরাতে পারবে না। আর যদি কোনো ছাত্র পরীক্ষা দিতে না আসে, আমি ১৫ মিনিট অপেক্ষা করে খাতাপত্র রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ে জমা দিয়ে বাসায় চলে যাব।’ ছাত্রনেতারা তাঁকে ঢুকতে দিলেন এবং তিনি যথারীতি পরীক্ষার হলে অপেক্ষা করলেন। তারপর ১৫ মিনিট পর বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে হনহন করে রেজিস্ট্রার বিল্ডিংয়ের দিকে চলে গেলেন।
খলিল স্যার তাঁর মেরুন কালারের বিখ্যাত ভক্সওয়াগন গাড়ি নিয়ে ক্যাম্পাসে আসতেন। এটি ছিল একটি ট্রেডমার্ক। তাঁর গাড়ি দেখামাত্র অনেক ছাত্রছাত্রী, কর্মচারী, কর্মকর্তা—এমনকি শিক্ষকেরাও শ্রদ্ধায় রাস্তা থেকে সরে দাঁড়াতেন। ক্যাম্পাসের প্রত্যেক রিকশাচালক তাঁর গাড়ি দেখামাত্র নিয়ম মেনে আস্তে আস্তে রিকশা চালাতেন। রিকশাচালকদের এমন করার পেছনে একটি কারণ আছে। সাধারণত বেশির ভাগ রিকশাচালক ট্রাফিক নিয়ম জানেন না। তাই তাঁরা গোল চত্বরে ডানে কী আর বাঁয়ে কী, একদিকে গেলেই হলো—এমন ভাব নিয়ে ইচ্ছেমতো রিকশা চালাতেন। একদিন হলো বিপত্তি। খলিল স্যার তাঁর ভক্সওয়াগেন গাড়ি নিয়ে গোলচত্বরে বাঁ দিক দিয়ে ঢুকেছেন মাত্র। দেখেন, তাঁর গাড়ির ঠিক মুখোমুখি উল্টো দিক দিয়ে দুটি রিকশা আসছে। তিনি গাড়ি থামিয়ে নামলেন। প্রথমে দুই চালককে জিজ্ঞেস করলেন, কেন তাঁরা উল্টা দিক দিয়ে আসছেন। তাঁদের উত্তর শুনে বুঝলেন যে এঁরা ট্রাফিক নিয়ম জানেন না। তিনি তাঁদের বুঝিয়ে দিলেন, প্রতিটি গোলচত্বরে কীভাবে ঢুকতে এবং বের হতে হয়। দুই রিকশাচালককে তিনি বাধ্য করলেন ঘুরিয়ে নিয়মমতো যাওয়ার জন্য। তবে এখানে উল্লেখ্য, এই দুই রিকশার যাত্রী যাঁরা ছিলেন, তাঁরা স্যারের গাড়ি সামনাসামনি এসে থামামাত্রই রিকশা থেকে নেমেই ভোঁ-দৌড়! এর পর থেকে ক্যাম্পাসের সব রিকশাচালক স্যারের গাড়ি দেখলেই মোটামুটি নিয়ম মেনে রিকশা চালাতেন!
খলিল স্যার ছিলেন ছাত্র-অন্তঃপ্রাণ একজন শিক্ষক। প্রত্যেক ছাত্রকে তিনি নিজ সন্তানের মতো ভালোবাসতেন। তাঁর কাছে জাত-ধর্ম—এসবের কোনো ভেদাভেদ ছিল না! তিনি ছিলেন আগাগোড়া একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। তাঁর কোনো ছাত্র কোনো অসুবিধায় পড়ে তাঁর কাছে সহযোগিতা চেয়ে কোনো উপকার পাননি, এমন দৃষ্টান্ত মনে হয় একটিও নেই। আমার নিজের একটি ঘটনা এখানে বলার আছে! ঘটনাটি আমি বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে বলেছি এবং লিখেছি। আজ আবার এখানে বলতে ইচ্ছা হচ্ছে। ক্যাম্পাসজীবনে আমি ছিলাম ক্লাসবিমুখ ছাত্র। প্রথম বর্ষ প্রথম সেমিস্টারের পর থেকেই আমি টিউশনি, কোচিং এবং রাজনীতি নিয়েই বেশি সময় কাটাতাম। পড়াশোনা যা করার, তা করতাম পিএলের ছুটিতে। বন্ধু সালাম ও আসাদের ক্লাস নোটই আমার ভরসা! তিন সপ্তাহ দরজা-জানালা বন্ধ করে পড়েই প্রতিটি সেমিস্টার পার করে এসেছি! রেজাল্টও একেবারে খারাপ করিনি। প্রথম দিকের কয়েকজনের মধ্যেই ছিলাম! সেই সময়ে সেমিস্টার পরীক্ষার আগে আগে কিছু লেট ফি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করা যেত।
যাঁরা রেজিস্ট্রেশন করতেন, তাঁরাই অ্যাডমিট কার্ড পেতেন এবং পরীক্ষা দিতে পারতেন। আমার ক্ষেত্রে লেট ফি দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করাটা মোটামুটি একটি অভ্যাসে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। একবার হলো বিপত্তি। বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ম করেছে, যাঁদের অ্যাটেনডেন্টসে নির্দিষ্ট পার্সেন্টেজ নেই এবং সময়মতো রেজিস্ট্রেশন করেননি, তাঁরা পরীক্ষা দিতে পারবেন না! এ নিয়ে কয়েকবার নাকি ডিপার্টমেন্টে নোটিশও হয়েছে। আমি তো ডিপার্টমেন্টে যাই না! এসব নোটিশ কীভাবে দেখব! কাউকে জিজ্ঞেসও করিনি। কেউ বলেওনি। ভেবেছি, অন্যবারের মতো পরীক্ষার কয়েক দিন আগে টিউশনির টাকা পেয়ে রেজিস্ট্রেশন ফি জমা দেব। পড়ে গেলাম বিরাট বিপদে। আমি জানি, বিপদ থেকে বাঁচার একমাত্র সহায় খলিল স্যার।
সোজা গেলাম স্যারের কাছে। আমি এটাও জানি যে স্যারের সঙ্গে কোনো ধানাইপানাই করে লাভ নেই। এতে আরও বিপদ বাড়বে। যা সত্য তা সরাসরি বলতে হবে। স্যারকে সব বললাম। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেন সময়মতো ভর্তি হইনি। আমি বললাম, ‘অনেকটা অবহেলা এবং কিছুটা টাকার সংকটের কারণে সময়মতো ভর্তির চেষ্টা করিনি। প্রতিবার লেট ফি দিয়ে ভর্তি হতে পারতাম, এবার ভেবেছিলাম লেট ফি দিয়ে পরে ভর্তি হয়ে যাব।’ স্যার সব শুনলেন। চশমার ফাঁক দিয়ে অনেকক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে রইলেন। কী যেন ভাবলেন। বললেন, ‘ঠিক আছে, আমি কন্ট্রোলার সাহেবকে ফোন করে দিচ্ছি, এখনই ভর্তি হয়ে যাও।’ আমি বললাম, ‘স্যার, আমি এখন ভর্তি হতে পারব না।’ তিনি মোটামুটি হুংকার দিয়ে বললেন, ‘কেন পারবে না?’ আমি বললাম, ‘টিউশনির টাকা না পেয়ে ভর্তি হতে পারব না।’ কদিন সময় চাইলাম। তিনি সঙ্গে সঙ্গে হুংকার দিয়ে তাঁর অফিস সেক্রেটারি সরদার ভাইকে ডাকলেন। বললেন, তাঁর চেক বই নিয়ে আসতে। সরদার ভাই চেক বই এনে দিলেন। স্যার একটি চেকে লিখলেন, এক হাজার আট শ পঞ্চাশ টাকা মাত্র। চেকটি আমার হাতে দিতে দিতে বললেন, ‘যখন টিউশনির টাকা পাবে, তখন এসে দিয়ে যেয়ো।’ চেকটি হাতে নিয়ে খেয়াল করলাম, চেকে স্যার কোনো সিগনেচার দেননি। এটি তাঁকে মনে করিয়ে দিতেই আরেকটি হুংকার দিয়ে বললেন, ‘তাড়াতাড়ি ব্যাংকে যাও, ওরা আমাকে চেনে, এখানে সিগনেচার দিতে হবে না।’ আমি এই টাকা দিয়ে সেদিন মাত্র ৩০ মিনিটের মধ্যে ব্যাংক এবং কন্ট্রোলার সেকশনের সব কাজ করে অ্যাডমিট কার্ড নিয়ে এসেছিলাম। পরে টিউশনির টাকা পেয়ে স্যারের দেওয়া টাকাটা ফেরত দিতে গিয়েছিলাম, তিনি নেননি। বলেছিলেন, ‘কারও উপকার হয়, এমন কাউকে দিয়ে দিয়ো!’ আমি এই টাকা স্যারের কথামতো তেমন একজনকেই দিয়েছিলাম। খলিল স্যারের এই এক হাজার আট শ পঞ্চাশ টাকা আমার হাত থেকে কাউকে দেওয়া প্রথম দান। আমার জীবনের প্রথম চ্যারিটি (স্যারকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাকে এই মহৎ কাজটি এভাবে শিখিয়ে যাওয়ার জন্য)। ২০২৩ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে আমি লন্ডনে গিয়েছিলাম। সেখানে আমাদের সাস্টিয়ানদের উদ্যোগে খলিল স্যারের জন্য দোয়া ও আলোচনা সভায় অংশ নিয়েছিলাম। স্যারের পরিবারের পক্ষ থেকে একজন সম্মানিত অতিথি সেখানে এসেছিলেন। তাঁর একটি কথা আমার খুব মনে ধরেছিল। তিনি বলেছিলেন অধ্যাপক খলিলুর রহমানের জীবনে তাঁর নিজের পরিবারের থেকেও প্রিয় বা সমকক্ষ আরেকটি বড় পরিবার ছিল, তাঁর সেই পরিবার হলেন আপনারা, তাঁর ছাত্র-ছাত্রীরা! তাঁর সব সময় এবং অ্যাটেনশন আপনারা দখল করেছিলেন। গবেষণা ও ছাত্রদের নিয়ে সারা দিনরাত মেতে থাকলে একজন মানুষ যে তাঁর পরিবার এবং সামাজিক জীবন থেকে কতটা ছিটকে পড়েন, এর কিছুটা তো এখন আমি আমার নিজের জীবন দিয়েই জানি।
শেষ করার আগে খলিল স্যারকে নিয়ে আমার মা এবং আমার একটি ঘটনা এখানে বলতে চাই। আমি স্যারের সততা, পড়ানোর স্টাইল, আমরা কেন তাঁকে এত ভয় পাই আবার শ্রদ্ধাও করি, এসব নিয়ে মায়ের কাছে এত তন্ময় হয়ে গল্প করতাম যে প্রায়ই তিনি রাতের খাবারের টেবিলে খলিল স্যারের গল্প করতে বলতেন। অনেক দিন পর বুঝেছিলাম, আমার মা আমাকে আসলে বেশি বেশি খাওয়ানোর জন্য স্যারের গল্প করতে বলতেন। আমি স্যারের কথা বলতে বলতে নাকি ঘোরের মধ্যে চলে যেতাম, ননস্টপ বলতেই থাকতাম। মা আমাকে যা যা খাওয়াতে চাইতেন, সব একে একে প্লেটে তুলে দিতেন। আমিও গল্পের তালে সব খেয়ে উঠতাম। এবার বাড়িতে গিয়ে মাকে স্যারের মৃত্যুর খবর দিয়েছিলাম। তিনি আল্লাহর কাছে দোয়া করেছিলেন তাঁকে যেন ভালো রাখেন। আমার বিশ্বাস, আমার মায়ের দোয়া, আমাদের সবার দোয়া আল্লাহ তাআলা কবুল করবেন।
লেখক: প্রাক্তন সাস্টিয়ান। বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ার চার্লস স্টুয়ার্ট ইউনিভার্সিটির ন্যানো টেকনোলজি বিভাগের ডিস্টিংগুইশড অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত
**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]