নরওয়ের পাহাড়ঘেরা নীল জলপথে

ফিয়র্ড শব্দটি নরওয়েজীয়।

গভীর সরু ও দীর্ঘ প্রসারিত সামুদ্রিক জলপথ, যার তিন দিকেই সুউচ্চ পাহাড়, তাকেই বলা হয় ফিয়র্ড। ফিয়র্ডের মাঝের অংশ সুগভীর ও প্রবেশমুখ সরু। নরওয়েতে বেশ কয়েকটি ফিয়র্ড আছে, তার মধ্যে লিসেফিয়র্ড অন্যতম। স্ট্যাভ্যাঞ্জার বন্দর থেকে শুরু করে সমুদ্রমুখ পর্যন্ত লিসেফিয়র্ড প্রায় ৪২ কিলোমিটার লম্বা। দুই পাশে সুউচ্চ পাথরের দেয়ালসদৃশ পাহাড়, মাঝেমধ্যে বিশাল ঝরনায় সমৃদ্ধ জলপথ।

এর আগে নরওয়ে এলেও স্ট্যাভ্যাঞ্জার দেখা হয়নি।

নরওয়ের চতুর্থ বৃহত্তম শহর স্ট্যাভ্যাঞ্জার। স্ট্যাভ্যাঞ্জারে এসে পৌঁছালাম গত ১২ আগস্ট, সমুদ্রের পাড়ে হোটেল, জানালা খুললেই সমুদ্র, জাহাজের আনাগোনা। ঠিক হলো লিসেফিয়র্ড নীল জলপথটি দেখার। ইন্টারনেটে টিকিট কাটা হলো, সাড়ে তিন ঘণ্টার জাহাজে ভ্রমণ, মাথাপিছু টিকিট সাড়ে সাত হাজার টাকা।

স্ট্যাভ্যাঞ্জার বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জায়েদ সম্রাট ও মুকসেদা হাসান টিকিট সংগ্রহে সহায়তা করলেন। নির্ধারিত দিন ও সময়ে জাহাজ ঘাটে এসে উপস্থিত হলাম। অন্য ভ্রমণযাত্রীদের নিয়ে আমাদের দর্শনীয় জাহাজ ছাড়বে সকাল সাড়ে দশটায়।

জাহাজে উঠেই আমরা খোলা ডেকে চলে এলাম। যাতে করে চারপাশ দুচোখ ভরে দেখা যায়। ঘাট ছেড়েই দ্রুত জলপথে এগিয়ে যায় বৈদ্যুতিক জাহাজ। ডেকের ওপর সামুদ্রিক হাওয়া, কারও কারও মাথার চুল ও গলার স্কার্ফ পতাকার মতো উড়ছে। নীল জল কেটে ছুটছে জাহাজ। কিছু দূর এসেই জাহাজের গতি ধীর হয়ে এল, মাইকে গাইডের ঘোষণা এল, বিখ্যাত স্যামন মাছের খামারের পাশ দিয়ে যাচ্ছি আমরা।

খামারগুলো জলের ভেতর। কিছু দূরে দূরেই বিশাল জায়গা নিয়ে মাছের খামার। নরওয়ে তেলসমৃদ্ধ দেশ, তবে তেল পাওয়ার আগে স্যামন শিকারই ছিল প্রধান পেশা। নরওয়ের স্যামন পৃথিবীখ্যাত। স্যামন বিক্রি করে দেশটি বছরে আয় করে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার। স্যামনের প্রধান ক্রেতা জাপান, জার্মানিসহ পৃথিবীর প্রায় ১০০টি দেশ।

স্যামন খামারগুলো পাড়ি দিয়ে জাহাজ সামনে এগোচ্ছে। যেতে যেতে এমন স্থানে এসে থামে যেখানে এগোনোর পথ নেই। তিন দিকেই খাড়া কালো দানবীয় পাহাড়। পাহাড়গুলো এতই বিকট যে মাথা উঁচু করে দেখতে হয়। পাহাড়ের গায়ে বসে আছে চৌকো লম্বা ছুড়ির ফলার মতো পাথর। যদি কোনো কারণে ভেঙে পড়ে তবে এসে পড়বে ডেকের ওপর। এমন স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতেও গায়ে কাঁটা দেয়। মনে হয় আমরা যেন ভয়াবহ এক রহস্যের দেয়ালে আবদ্ধ হয়ে গেছি। দিনের বেলায় ও চারদিক নিঝুম। জাহাজের যাত্রীরাও ভয়ে নিশ্চুপ হয়ে গেছেন। নিঝুমতার মধ্যে পাহাড়ের গায়ে জলের ধাক্কার মৃদু শব্দ। এমন ভয়াবহ স্থানে এর আগে আসিনি। ভেতরের ভয় তখনো কাটেনি।

জাহাজ পেছনে যেতে শুরু করে, সামনে এগোনোর পথ নেই। রহস্যঘেরা দেয়াল পাশ কাটিয়ে সামনে এগোয়। হাজার ফুট ওপর থেকে নেমে আসা জলে এক ঝরনার পাশে এসে দাঁড়ায়। প্রচণ্ড উঁচু পাহাড়ের চূড়া বেয়ে নেমে আসছে সশব্দ জলধারা, প্রকৃতির এক দৃষ্টিনন্দন সৃষ্টি। জাহাজ ধীরে ধীরে জলধারার কাছে চলে এল। অনেকেই হাত বাড়িয়ে মুঠোভরে শীতল জল পান করলেন। বিশাল ঝরনাকে পাশ কাটিয়ে জাহাজ সামনে এগোয়। এসে দাঁড়ায় ঠিক পুলপিট রক বা প্রেইকেস্টুলেনের নিচে। পুলপিট রক জল থেকে প্রায় ২ হাজার ফুট ওপরে। ভ্রমণকারীদের অন্যতম আকর্ষণ পুলপিট রক এক বিশাল সমতল প্রাকৃতিক পাথর। পাথরের আয়তন ২৫ বাই ২৫ ফুট। পাহাড় বেয়ে পায়ে হেঁটে পুলপিটের কাছে যেতে সময় লাগে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার মতো। বিশাল সমতল পাথরটিতে কোনো রেলিং দেওয়া বা ধরার কিছু নেই। প্রকৃতি যেভাবে দিয়েছে, সেভাবেই রাখা হয়েছে। উঁচু পাথরটি থেকে পড়ে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনাও আছে। ২০১৩ সালে একজন স্প্যানিশ ও ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার একজন ২৪ বছরের ছাত্রী পড়ে গিয়ে প্রাণ হারান।