শান্তিকে আলিঙ্গন
কিছু ছবি থাকে যার সঙ্গে শব্দমালা অবান্তর মনে হয়। যেন ছবিই কথা কয়। নীল আকাশকে পটভূমি করে, আকাশের কাছাকাছি উচ্চতায় সাদা টুপি আর নেভি ব্লু পোশাকে দণ্ডায়মান নাবিক আলিঙ্গনাবদ্ধ করেছেন শুভ্র সাদা পোশাকের নার্সকে। যে নার্সের ঠোঁটে তিনি চুম্বনের রেখা এঁকে দিচ্ছেন, তাঁর দেহ স্বভাবতই পেছনে নোয়ানো। মাথা নাবিকের কনুইয়ের ভাঁজে ভর দেওয়া।
শিল্পীর নৈপুণ্যে আবেগে আপ্লুত নাবিকের চেহারা, তাঁর টুপি এবং নার্সের পোশাক, তাঁর সোনালি চুল, চুলে সাঁটা সাদা বো, জুতায় প্যাঁচানো লেইস, খুঁটিনাটি প্রতিটি ব্যাপার এ ভাস্কর্যে এমনভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে যে দেখে বিস্মিত হতে হয়।
‘এমব্রেসিং পিস’নামের এই ভাস্কর্যের অবস্থান ডাউনটাউন সানদিয়েগো–সংলগ্ন গ্যাসল্যাম্প কোয়ার্টার থেকে হাঁটা দূরত্বে ‘টুনা হারবার’ নামের এক ছোট্ট পার্কে। ব্রোঞ্জের তৈরি, সুদর্শন এ নাবিক যদি চোখ মেলতে পারতেন, নিশ্চিত দ্বিধায় পড়তেন, ঝলমলে নীল আকাশ, নাকি ঢেউয়ে দোলানো সমুদ্রের নীলকে যে কার চেয়ে বেশি সুন্দর! কারণ, নীলাকাশ বা নীল জলরাশি দুটিই তার নাগালের সীমানায়।
সত্যি কথা বলতে, তোলা ছবির চেয়ে আসল ভাস্কর্যটি আরও অনেক বেশি সুন্দর! একমাত্র চোখে দেখলেই অনুধাবন করা সম্ভব, এ ভাস্কর্যের বিশালতা! মাটি থেকে পঁচিশ ফুট উঁচু এ যুগলকে দেখতে তাই লোকসমাগম হয় প্রচুর।
ছবি বা মূল ভাস্কর্য দেখে বা বর্ণনা শুনে সম্পূর্ণ ব্যাপারটা খুব রোমান্টিক ঠেকলেও বাস্তব ঘটনা একটু ভিন্ন। এ নার্স কিন্তু ওই নাবিককে এই বিশেষ ক্ষণের আগে জীবনে কখনো দেখেননি (The Kissing Sailor: 2012)। আর এরপরও যে তাদের মধ্যে খুব যোগাযোগ ঘটেছিল ইতিহাস তা–ও বলে না। ১৯৪৫ সালের ১৪ আগস্ট, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ, জাপানিজরা আমেরিকান ফোর্সের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এ খুশির খবর শোনামাত্র মানুষের ঢল নামে নিউয়র্কের টাইম স্কয়ার ও তার আশপাশে। ঘটনাক্রমে এ আনন্দের শামিল হয়েছেন দুটি ভিন্ন পটভূমি থেকে আসা এই নর–নারী। নাবিকের সঙ্গে তাঁর প্রেমিকাও ছিলেন আশপাশে কোথাও। এ নার্সকে দেখে, নাবিকের নাকি মনে পড়ে যায় সেই সেবিকাদের কথা, যাঁরা যুদ্ধের সময় সেবা ও যত্ন দিয়ে প্রাণ বাঁচিয়েছেন শত শত সৈনিকের, যুদ্ধের হানাহানিতে আহত, ব্যথাকাতর মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ছিলেন পরম মমতায়। যুদ্ধ শেষ। সেই দুঃস্বপ্ন তাই এখন অতীত! কিন্তু সামনে দাঁড়ানো এই সেবিকা তো তাঁদেরই একজন! তাই তিনি এগিয়ে যান নার্সের পোশাক পরা এই রমণীর দিকে। আলোকচিত্রী আলফ্রেড এইসেনস্টেডও করেছিলেন সুযোগের যথাযথ ব্যবহার। আমেরিকার ইতিহাসের ধারক হিসেবে পরিচিত এ ছবি পরবর্তী সময়ে স্থান পায় লাইফ ম্যাগাজিনের পাতায়।
ছবি থেকেই জে. স্টুয়ার্ড জনসন তৈরি করেন ভাস্কর্যটি। ভাস্কর্যের নিচের ফলকে স্রষ্টা স্টুয়ার্ড জনসনের নামের পাশাপাশি খোদাই করে লেখা—বিশ্বযুদ্ধ সমাপ্তির আনন্দের স্বতঃস্ফূর্ত বহিঃপ্রকাশের এই ‘এমব্রেসিং পিস’।
ভাস্কর্য বা ছবির পাত্র-পাত্রী, ছবির বিষয় ইত্যাদি নিয়ে আছে নানা বিতর্ক। তবে প্রথমবারে দেখা জ্যোৎস্নাস্নাত রাতের পটভূমিতে, দ্বিতীয়বারে উজ্জ্বল সূর্যের নিচে, প্রতিবারই আমাকে মুগ্ধ করছে বিশাল এ শিল্পকর্মটি! কথিত নার্স, নাবিক, আলেকচিত্রী—তাঁরা কেউই আর বেঁচে নেই; কিন্তু বেঁচে আছে শিল্পকর্মটি। যার আছে নিজস্ব ভাষা, যাতে প্রভাবিত হয়ে ভাস্কর্যের আদলে, কোনো কোনো যুগল নিজেদের মতো করে তৈরি করেন নতুন আরেকটি ছবির ভঙ্গিমা।