টরন্টোয় রবীন্দ্রনাথের ‘রক্তকরবী’র মঞ্চায়ন: বহির্বিশ্বে বাংলা নাটকের এক মাইলস্টোন

‘রক্তকরবী’র দুর্দান্ত মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে টরন্টোর থিয়েটার নতুন এক মাইলস্টোন তৈরি করেছে। এ কথা বললে বাড়িয়ে বলা হবে না, টরন্টোর বাংলা কমিউনিটির এখন ঢাকার দক্ষ থিয়েটার গ্রুপগুলোর সমমানের প্রোডাকশন তৈরি করার সক্ষমতা তৈরি হয়েছে। দ্বিধা ছাড়াই বলছি, প্রায় ২০ বছর টরন্টোতে থেকে এই প্রথম সম্পূর্ণ তৃপ্তি নিয়ে একনিশ্বাসে একটি নাটক উপভোগ করলাম। এই প্রথম নাটক চলাকালে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মঞ্চ ছাড়া কোনো দিকে চোখ গেল না। যাঁরা থিয়েটার দেখতে এবং করতে ভালোবাসেন, তাঁদের আনন্দিত ও গর্বিত করেছে ‘রক্তকরবী’।

থিয়েটারের দর্শক আমরা যাঁরা তরুণ অবস্থায় ঢাকা ত্যাগ করেছি, তাঁদের অনেকের মনেই চিনচিনে দুঃখ ছিল, হায়, ঢাকার থিয়েটারগুলো মিস করছি। টরন্টোয় বিভিন্ন সংগঠন তাদের সীমিত ক্ষমতা দিয়ে থিয়েটারের প্রদীপটি বহু বছর ধরে জ্বালিয়ে রেখেছে। টরন্টোর বাঙালি কমিউনিটিও ছোট থেকে বড় হয়েছে এখন। কিন্তু তারপরও কোথায় যেন কী একটা নেই, কী একটা নেই ব্যাপার ছিল। মঞ্চনাটকের বেলায় পূর্ণমাত্রায় সন্তুষ্টি যেন পাচ্ছিলাম না, কেন পাচ্ছিলাম না, সেটাও বোঝার আগেই ‘রক্তকরবী’ এসে একঝটকায় সেই শূন্যস্থান পূরণ করে দিয়ে গেল।

টরন্টোর থিয়েটার গ্রুপগুলোর সক্ষমতার কথা যখন বলি, তখন অনেক বিষয় মনে মনে ভাবি। তার মধ্যে একটি মঞ্চনাটক সামাল দেওয়ার মতো আর্থিক সক্ষমতা বড় ব্যাপার। কমিউনিটি ছোট, ডোনারও ছোট, দর্শকও ছোট। বলার অপেক্ষা রাখে না যে ‘রক্তকরবী’র মাপের একটি নাটক এতটা পারদর্শিতার সঙ্গে মঞ্চস্থ করতে যতটা গাঁটের জোর থাকতে হয়, স্পনসর থাকতে হয়, তা আমাদের এখন হয়েছে। উদীচীর ২৫ বছর পূর্তির আয়োজন সেটাই প্রমাণ করল বলা চলে। পৃষ্ঠপোষকতার সহায়তা ছাড়াও আগ্রহী থিয়েটারকর্মী, লাইট, কোরিওগ্রাফি, সেট ডিজাইনার, প্রপস, ড্রেস, যোগ্য পরিচালক সর্বোপরি যে বিপুল সময় দরকার একটি সফল প্রযোজনার জন্য, বলা চলে এর সবগুলোতেই দক্ষতা ও যোগ্যতার সমন্বয় ঘটেছে ‘রক্তকরবী’তে।

ব্যক্তিগতভাবে ‘রক্তকরবী’ পড়া থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি ভার্সন দেখার ও শোনার অভিজ্ঞতা হয়েছে আমার। শম্ভুমিত্রের প্রযোজনা, বিটিভি এবং শেষেরটি যুবরাজ (খালেদ খান) ও অপি করিমের অভিনীত নাটক। তো নানাভাবে নানা মিডিয়ায় দেখার কারণে মাথার ভেতরে এর একটা ছাপ নিয়েই হলরুমে ঢুকেছি। মনে মনে ক্ষীণ একটা ভয় ছিল, আবার না হতাশ হই। উঁহু, একবাক্যে স্বীকার করছি, নাটকটি শুরুর মুখে খানিকটা কাব্যিক ঢঙে ডায়ালগ শুরু করলেও অচিরেই দুর্দান্ত গতিতে থিয়েট্রিকাল মোমেন্টগুলো তৈরি করতে সক্ষম হয়েছে। পুরো মঞ্চকেই পারফর্মাররা ব্যবহার করেছেন ভারসাম্য বজায় রেখে, কোথাও ফাঁকা বোধ করার সময় পাওয়া যায়নি। প্রতিটি চরিত্র নিজস্ব গুরুত্বে সবটুকু দিয়ে অভিনয় করেছে। অনেক পরিশ্রম আর সময় নিয়ে পারফর্মাররা খাটাখাটনি করেছেন। তাঁদের কল্যাণে নাটক একমুহূর্ত ঝুলে যাওয়ার সময় পেল না। আরও দেখতে পেলাম পারফর্মারদের ফিজিক্যাল ফিটনেস, কণ্ঠস্বরের ওঠানামা, স্বর প্রক্ষেপণ আর নীরবতার ব্যবহার। নাটকের পরতে পরতে দেখতে পেলাম নির্দেশকের মুনশিয়ানা। ব্রাভো!

নন্দিনীকে নিয়ে তো কথা বলতেই হবে। নন্দিনী শব্দটি উচ্চারণ করামাত্র যে চিত্র মনে লাফ দিয়ে ওঠে, তনুকার সঙ্গে তার ভারি মিল। তনুকার মঞ্চাভিনয় এর আগে আমি দেখেছি, কিন্তু নন্দিনী চরিত্রে তনুকাকে দেখে মনে হলো, তিনিও নতুন করে জন্ম নিলেন নন্দিনীর মধ্য দিয়ে। নাটকের আগা থেকে গোড়া তাঁর মঞ্চ-উপস্থিতি নাটকের প্রাণ। তিনি মনপ্রাণ ঢেলে কাজ করেছেন, কঠোর পরিশ্রম করেছেন, ভালো অভিনয় করেছেন, ভালো গান ও কোরিওগ্রাফি করেছেন। তনুকার ফিটনেস চোখে পড়ার মতো। মসৃণ তাঁর গতায়াত। নন্দিনীর যে ছন্দ যক্ষপুরীর প্রতিটি বাঁধন কেটে কুচিকুচি করেছে, তা তনুকার গতিময়তায় দারুণ ম্যাচ করে গেছে। তবে সেই গতিময়তা কণ্ঠেও রাখার চিন্তায় কি না জানি না, বেশ কিছু জায়গায় ডায়ালগ ব্যক্তির কথোপকথন মনে না হয়ে কানে কবিতা আবৃত্তির মতো লেগেছে, খানিকটা সুরেলা ও লম্বা। নন্দিনীর সারল্য ছাপিয়ে সেটা একটু দুর্বলতা প্রকাশের দিকে যায়, অথচ রক্তকরবী যতবার পড়েছি, কোনো দিনই নন্দিনীকে দুর্বল মনে হয়নি। নন্দিনী সরল কিন্তু দ্বিধাহীন, নরম কিন্তু তার্কিক, সহজগম্য কিন্তু কঠিন পণ। নন্দিনী বুঝ নেয় না সহজে, তাকে টলানো যায় না, প্রশ্নে প্রশ্নে জর্জরিত করা তার স্বভাব, কৌতূহলী, প্রকৃতিপ্রেমী এবং আনন্দ তার সহজাত। বেদনায় নন্দিনীর মতো কঠিন-কঠোর তো আর কাউকে দেখি না। রাজার অনেক ধমক-ধামক আছে, কিন্তু সেও তো নন্দিনীর মতো কঠিন ও অনমনীয় নন, থাকতে পারলেন না! নন্দিনীর এই বহুমুখী ওঠাপড়ার দ্বন্দ্বে মাঝেমধ্যে মনে হয়েছে, তনুকার খানিকটা বিড়ম্বনা ছিল হাত দুখানি নিয়ে, নন্দিনী ঠিক যেন নিশ্চিত না যে হাত দুখানি নিয়ে ওই মুহূর্তে সে কী করবে।

অনবদ্য অভিনয় করেছেন রাজা চরিত্রে মাহমুদুল ইসলাম সেলিম। তাঁর ভরাট, স্পষ্ট উচ্চারণ নাটকের দ্বন্দ্ব উসকে দিয়ে জমিয়ে দিয়েছে। নন্দিনীর কোমল উপস্থিতির কনট্রাস্টে রাজার ভয়ংকরতা যতটা প্রবল, ততটাই ফাঁপা। শুধু কণ্ঠস্বরের কারুকাজ দিয়ে নাটকের বড় অংশ ধরে রেখেছে রাজা চরিত্রটি; এবং বিশু চরিত্রে মিঠুন রেজা। দুজনই অত্যন্ত সবল কণ্ঠস্বরের অধিকারী ও সাবলীল। প্রয়াত অভিনেতা খালেদ খান যুবরাজের বিশু চরিত্রটি চোখে লেগে ছিল আমার। সেই চোখ নিয়ে দেখার পরও মিঠুনের বিশু চরিত্রটি মনে গভীর দাগ কেটেছে। সরদার, ফাগুলাল, গোঁসাই, কিশোর নিঃসন্দেহে তাঁদের সর্বোচ্চটা দিয়েছেন।

মোটাদাগে বলতে গেলে প্রতিটি চরিত্রই সাধ্যমতো ভালো করেছে, চরিত্র চিত্রায়ণের জন্য জান দিয়ে খেটেছে। তুলনামূলক দুর্বল মনে হয়েছে চন্দ্রা ও অধ্যাপক চরিত্র। বারবার চিন্তা করেও মেলাতে পারছিলাম না যে নির্দেশক প্রতিটি চরিত্রের জন্য যেখানে মেদহীন প্রকাশ বাঞ্ছা করলেন, সেখানে চন্দ্রা চরিত্রটির অতি-অভিনয়কে সহ্য করলেন কেন; চন্দ্রাকে অ্যান্টিনন্দিনী প্রমাণ করতে একজন সাদাসিধা নারীর ভয় ও ঈর্ষার স্বাভাবিক প্রকাশকে ব্যাহত করার কি কোনো দরকার ছিল!

জানতে পারলাম যে নাটকের অভিনেতা-কলাকুশলীরা বেশির ভাগই নতুন। এ নাটকেই তাঁদের প্রথম পদচারণ মঞ্চকর্মী হিসেবে। এমনকি বেশির ভাগই নতুন প্রজন্মের। তাঁদের দিয়ে এমন কাজ বের করে আনার জন্য নির্দেশক ও অভিনেতা সবাইকে ধন্যবাদ জানাতে হয়। নির্দেশনার ধরন বারবারই আমাকে নাট্যব্যক্তিত্ব জামিল আহমেদের কথা ও কাজ মনে করিয়ে দিচ্ছিল। বিশেষ করে মঞ্চের স্পেস, অভিনেতার শরীর, লাইট এমনভাবে ব্যবহার করা হয়েছে যাতে মঞ্চকে কোনো এক মুহূর্তের জন্য খালি মনে হয়নি। একবার তো এ–ও মনে হয়েছে যে মানুষগুলোকে দিয়ে এ কাজ বের করে আনতে মিঠুন রেজা হাতে আবার চাবুক তুলে নেননি তো!

নাটকের আবহ সংগীত, মিউজিক, সেট, প্রপস, ড্রেস, লাইটিং সবকিছুতে দক্ষতা ও পরিশ্রমের ছাপ রয়েছে। তবে দর্শক হিসেবে একটা অংশের গ্যাপ কানে বেজেছে। যক্ষপুরীর পতনে ওই গুটিকয় মানুষ নয়, জেলভাঙা মানুষ, শ্রমিক, জনতা তারা তো ছিল। তাঁদের কণ্ঠস্বর কোথায়! যে উদ্দীপনা ও উত্তেজনায় যক্ষপুরীর পতন ঘটল, তা মনে হলো গুটিকয় ব্যক্তির লেনদেন! অন্তত ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকে হলেও সেই শত মানুষের আওয়াজ পেতে পারতাম আমরা।

টরন্টোয় ‘রক্তকরবী’র মঞ্চায়ন আমাদের মুশকিল করে রেখে গেল হয়তো। এর পর থেকে যেকোনো নাটকই হোক না কেন, তুলনা করার জন্য আমরা ‘রক্তকরবী’কে টেনে আনব।  এত বড় একটা কাজ হাতে নিয়ে তা সফল করে তোলায় উদীচী-কানাডাকে অভিনন্দন।

একটা প্রশ্ন, আমরা তো ভালো নাটক বানিয়ে দর্শক মাত করলাম, কিন্তু আমরা কবে ভালো দর্শক হব? অনুষ্ঠান দেখে মনপ্রাণ ভরে যাওয়ার পরও আমরা কবে দাঁড়িয়ে হাততালি দিয়ে সম্মান প্রদর্শন করতে পারার যোগ্যতা অর্জন করব?