ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বিড়ম্বনা: পর্ব–১
কয়েক দিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছেই না। দিন বেশ বড়। ক্যালগেরির সূর্যোদয় সকাল সাড়ে ৫টায় আর সূর্যাস্ত রাত পৌনে ১০টায়। সাধারণত তাপমাত্রা ২০–এর ওপরে থাকে। এখন তাপমাত্রা ১০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে। এ দেশের বৃষ্টির সঙ্গে বাংলাদেশের বৃষ্টি মেলানোর চেষ্টা করি; কিন্তু সে আমেজ পাই না। বৃষ্টি নামলেই বৃষ্টিতে ভেজার ইচ্ছায় সবাই মিলে ফুটবল খেলতাম। শৈশবে আমাদের দুরন্তপনার সীমা ছিল না। আমরা ছিলাম সদা উচ্ছল প্রাণবন্ত। বৃষ্টি উপভোগের আরেকটি সুন্দর উপায় ছিল, গ্রামের বাড়ির বারান্দায় বসে টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ। যদি এ বৃষ্টি হয় রাতে, তখন টিনের চালে বৃষ্টির শব্দে ঘুম ভেঙে না গিয়ে ঘুম গভীর থেকে গভীরতর হতো। টিনের চালে বৃষ্টির শব্দ, পাশে থেকে ভেসে আসা ব্যাঙের ডাক—সেসবের কিছুই এখন আর নেই। সে দিনগুলো আজ স্মৃতি। শৈশবের স্মৃতিমধুর দিনগুলো সব সময়ই মনে পড়ে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আমাদের একজন ভিন্ন ধরনের শিক্ষক ছিলেন। তিনি গতানুগতিক শিক্ষকদের মতো কখনোই বইয়ের পাতায় বেঁধে রাখতেন না। সেই সময় তাঁর কাছে আমরা কুয়াশার গল্প শুনতাম। তা ছাড়া আমাদের বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান দিতেন। তার মধ্যে অন্যতম আমাদের ইন্দ্রিয়বিষয়ক। যেমন চোখ, কান, নাক, ত্বক ও জিব—এই পাঁচটিকে পঞ্চইন্দ্রিয় বলে, এর বাইরেও নাকি একটি ইন্দ্রিয় আছে, তাকে বলা হয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় মানুষের মনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আবার একে অনেকে তৃতীয় চক্ষুও বলে থাকেন, ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় দ্বারা ভবিষ্যৎ দেখা বা অনুমান করা, অশরীরীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা, কথা বলা, ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থেকেও কোনো ঘটনা ঘটার সময় তা অনুভূত হওয়া ইত্যাদি। অনেক দিন পর এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় ব্যবহৃত হলো নিজের অজান্তেই, তবে ভিন্ন আঙ্গিকে।
আজ সাপ্তাহিক ছুটি। অলসভাবে দিনটি কেটে যাবে মনে হচ্ছে। বৃষ্টির কারণে কোথাও যাওয়া হবে না। এমন ধারার বৃষ্টি উপভোগ করতে ঘন দুধ চা, সঙ্গে ঝালমুড়ির দরকার। সেসব করার উপকরণ থাকলেও ইচ্ছা করছিল না। তাই মগ ভর্তি কালো কফি নিয়ে বসেছি বৃষ্টির ঝুমঝুম শব্দ শুনতে, বিদেশ বলে কথা। মাঝেমধ্যে হারিয়ে যাচ্ছি অতীতের বিভিন্ন সময়ের দিনগুলোতে। মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘এমন দিনে তারে বলা যায়, এমন ঘনঘোর বরিষায়’–বিষয়ক প্রমথ চৌধুরীর লেখা একটি প্রবন্ধ ছিল আমাদের পাঠ্য। সেখানে তিনি লিখেছেন, বৃষ্টির দৃশ্যে চোখ ভর করে কানের ওপর। এ সময় সামনে দিয়ে কেউ হেঁটে গেলেও নজরে আসে না। বৃষ্টির সব দৃশ্য যেন কানে রিনিঝিনি বেজেই চলছে। সেই সঙ্গে আমার মুঠোফোনও বাজছিল, আমার কান তা শুনতে পাচ্ছিল না। স্ত্রীর ধাক্কায় সংবিৎ ফিরে পেলাম। সে বলল, ‘কী ব্যাপার, তোমার ফোন বাজছে ধরছ না কেন? কার কথা মনে করে ধ্যানমগ্ন?’ আমি তাড়াতাড়ি ফোন ধরলাম।
পল্লবের ফোন, আমার ফেসবুক বন্ধু। তাঁর সঙ্গে কখনো আমার দেখা হয়নি। তবে ভিডিও কলে কথাবার্তা হয়েছে। প্রথম দিন ফোন করে বলেছিলেন, ‘আপনার লেখা আমি খুব পছন্দ করি।’ আমি কিছুটা বিব্রত হয়েই বলেছিলাম, ‘ধন্যবাদ।’ তার পর থেকে মাঝেমধ্যে কথাবার্তা হতো। একদিন বললেন, ‘আমার নিজস্ব কিছু কাহিনি আছে। আমি চাই, আপনি সেগুলো নিয়ে গল্প লিখুন।’ আমি বললাম, ‘আমি কেন? আপনি নয় কেন?’ তিনি বিস্ময়ের সঙ্গে উত্তর দিলেন, ‘আমি!’ বললাম, ‘সমস্যা কোথায়?’ তিনি বললেন, ‘আপনার মতো হবে না তো!’ আমি বললাম, ‘না হোক, তবু শুরু করুন। আপনি আপনার জীবনের গল্প আপনার মতো করে লিখুন, দেখবেন হয়ে গেছে।’ সেই থেকে তার লেখার শুরু।
পল্লবের বসবাস কানাডার নোভাস্কোশিয়া প্রদেশের সাগরপাড়ের হ্যালিফ্যাক্সে। বন্দরনগরীর সব সময় প্রশংসা করেন। অনেকবার ওখানে বেড়িয়ে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। প্রায় প্রতিটি শহরের ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস সমৃদ্ধ স্থানে দর্শনের ইচ্ছা আমার অনেক দিনের। হ্যালিফ্যাক্সে ঘটনাটি ঘটে ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে।
সেই দিন ফরাসি পণ্যবাহী জাহাজ এসএস মন্ট-ব্ল্যাঙ্ক, কানাডার নোভাস্কোশিয়া প্রদেশের হ্যালিফ্যাক্স বন্দরে। নরওয়ের জাহাজ এসএস ইমোর সঙ্গে সংঘর্ষ হয়। ফরাসির জাহাজ বহন করছিল উচ্চতর বিস্ফোরক দ্রব্যাদি। জাহাজে আগুন ধরে বিশাল বিস্ফোরণ ঘটে। এই বিস্ফোরণ রিচমন্ড জেলাকে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। আনুমানিক সতেরো শ মানুষের মৃত্যু হয় এবং ধসে পড়া দালানের দ্বারা আনুমানিক ৯ হাজার লোক আহত হয়। বিস্ফোরণটি ছিল তৎকালীন মানবসৃষ্ট সবচেয়ে বড় বিস্ফোরণ। আমি অবশ্য আরও বড় মানবসৃষ্ট বিস্ফোরণের নিদর্শন জাপানের হিরোশিমা-নাগাসাকি দেখেছি। কানাডায় বসবাস করে এ দেশের পুবের প্রদেশ নোভাস্কোশিয়ার, হ্যালি ফ্যাক্স দেখব না, তা কি হয়? সেই ঐতিহাসিক শহর না দেখলে চলবে না। আমরা প্রায়ই পরিকল্পনা করি টরন্টো থেকে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ব কানাডার পূর্ব সীমান্তে। ভ্রমণের সবচেয়ে ভালো সাথি হচ্ছে আমার বন্ধু ড. মোজাম্মেল হক খোকন, বিশ্ববিদ্যালয়জীবনে ছাত্রাবাসের কক্ষসাথি। ওদের সঙ্গে কানাডা–আমেরিকাসহ অনেক ভ্রমণের স্মৃতি আছে। এই বন্ধুপরিবারের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অনেক গভীর। আমাদের দুই পরিবারের সম্পর্ক স্বামী-স্ত্রীর মতো। খুনসুটি হয়, কিন্তু বন্ধন ছিন্ন হয় না। আমার বন্ধুকে হ্যালিফ্যাক্স বেড়ানোর প্রস্তাব দিয়েছিলাম। সে রাজি। বলেছে, ‘শুধু তোদের আসতে যে সময় লাগে। তবে আমাকে আগে থেকে জানালে প্রস্তুতি নিতে সুবিধা হয়।’ বন্ধুর আশ্বাসের ভিত্তিতে আমার ফেবু বন্ধুকে বলেছিলাম, ‘একদিন যাব নিশ্চয়।’ উনি বলেন, ‘হ্যাঁ আসবেন জানি, তখন তো আমি না–ও থাকতে পারি।’ আমি বললাম, ‘কেন?’ তিনি বললেন, ‘আমি এক জায়গায় বেশি দিন থাকি না।’
এক জায়গায় বেশি দিন থাকেন না, এমন একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে, নাম মানিক। বিয়ে করেছেন পাঞ্জাবি মেয়েকে। দেখতে বেশ সুন্দরী। তাঁর সুশ্রী চেহারার সঙ্গে মিল রেখেই হয়তো বাবা–মা নাম রেখেছিলেন সুদর্শনা। আমি মানিককে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আপনি এক জায়গায় বেশি দিন থাকেন না কেন। তিনি বলেছিলেন, ‘আরে ভাই, আমার নাম মানিক, এক জায়গায় বেশি দিন থাকলে যদি মাইনক্যার চিপায় পড়ে যাই?’ সবাই হেসে উঠলেও সুদর্শনা না বুঝেই হেসেছিলেন। মানিক চেষ্টা করেও মাইনক্যার চিপার সঠিক অর্থ বোঝাতে পারেননি সেদিন। আর আমি তো তখন খাঁটি বাঙালি। বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা বেড়াতে গিয়েছিলাম।
মাইনক্যার চিপার কোনো সঠিক অনুবাদ তো দূরের কথা, সাধারণ ইংরেজি বলতেই দাঁত ভেঙে যাওয়ার দশা। মাইনক্যার চিপার ইংরেজি শেষমেশ ট্র্যাপ বলেছিলেন। ট্র্যাপ দিয়ে মাইনক্যার চিপার সঠিক অর্থ বোঝায় কি? সঠিক বোঝানো খুব জরুরি। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন, ‘অনুবাদ সাহিত্য মানেই কাশ্মীরি শালের উল্টো দিকের মতো, মূল নক্সাটি বোঝা যায়মাত্র, আর সব রসের সন্ধান পাওয়া যায় না। (রাষ্ট্রভাষা, সৈয়দ মুজতবা আলী) এই অর্থের ঝামেলার জন্য আমি যখন কানাডায় বসবাস শুরু করলাম, তখন খুঁজে খুঁজে বাঙালি ডাক্তার বের করতাম। আমার বন্ধুরা বলল, ‘তুই বাঙালি ডাক্তার খুঁজিস কেন?’ আমি বললাম, ‘সবই মাইনক্যার চিপা, বুঝলি।’ ওরা বলল, ‘মানে কী, এখানে মাইনক্যার চিপা আসল কোত্থেকে?’ আমি বললাম, ‘মাইনক্যার চিপার ইংরেজি বল।’ সবাই চুপ করে রইল। আমি বললাম, ‘মনে কর, আমার শুঁটকি মাছের ভর্তা খেয়ে পেটে সমস্যা দেখা দিল, তখন যদি এদেশীয় ডাক্তারকে বলি, আমি ড্ৰাই ফিশ খেয়েছিলাম। তিনি কিন্তু শুঁটকি মাছের রেসিপি নিয়ে চিন্তা করবেন না, কিন্তু একজন বাঙালি ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গেই বুঝে যাবেন আমার সমস্যা কোথায়।’
আমি প্রবালকে বললাম, ‘আপনি এক জায়গায় থাকেন আর না–ই থাকেন, লেখা কখনোই বন্ধ করবেন না।’ আমি হঠাৎ তাঁকে প্রশ্ন করলাম, ‘আচ্ছা আপনি কথা বলার সময় ঘাড় চুলকান কেন?’ তিনি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন, ‘আমি খুবই অবাক! আপনি তো আমাকে দেখছেন না, তাহলে বুঝলেন কীভাবে যে আমি ঘাড় চুলকাচ্ছি?’ আমি বললাম, ‘বিষয় তা না। আপনি ঘাড় চুলকিয়েছেন কি না?’ তিনি এবার হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ। কিন্তু আপনি কীভাবে দেখলেন।’ আমি বললাম, ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমাকে জানান দিয়েছে।’ বলেই হেসে উঠলাম। তিনি আরও বিস্ময়ের সঙ্গে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি কি ধ্যানবিদ্যাচর্চা করেন?’ আমি হ্যাঁ–না কিছুই না বলে তাঁকে একটা রহস্যের মধ্যে রেখে বললাম, ‘হায়! সর্বনাশ! আমাকে তো এক্ষুনি বের হতে হবে। আচ্ছা, আরেক দিন কথা হবে।’ ...চলবে
*লেখক: বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি, কানাডা