শহরের নিচে লুকানো এক জাদুকরি জগৎ

প্যারিস পৃথিবীর সবচেয়ে রোমান্টিক শহর। ওপরে রয়েছে আইফেল টাওয়ার, লুভর, সাঁ শেলপিসের মতো বিখ্যাত নিদর্শন। আর নিচে? নিচে চলছে এক অবিরাম ছুটে চলা জীবনের ছন্দ-প্যারিস মেট্রো।

এই ভূগর্ভস্থ রেলব্যবস্থা কেবল যাতায়াতের জন্য নয় বরং এটি এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে প্যারিসবাসীর জীবনের, ইতিহাসের ও সংস্কৃতির। প্রতিটি স্টেশন যেন একটি ছোট জাদুঘর, প্রতিটি যাত্রা যেন একটি গল্প।

প্যারিস মেট্রোর ইতিহাস: এক শতকের গল্প

প্যারিস মেট্রোর সূচনা ১৯০০ সালে প্যারিস এক্সপোজিশনের সময়। প্রথম লাইনটি ছিল ‘লাইন ১’, ভিনসেন থেকে পোর্ট মাইয়ো পর্যন্ত। নির্মাণ হয়েছিল দ্রুতগতির যাতায়াতের জন্য, কারণ সে সময় প্যারিসের রাস্তাগুলো ছিল ঘোড়ার গাড়ি ও ট্রামের দখলে। প্রথম দিকে স্টেশনগুলো ছিল টাইলস দিয়ে সজ্জিত হালকা আলো ও কাঠের সিটে ভরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এসেছে আধুনিকতা-স্বয়ংক্রিয় দরজা, ডিজিটাল রুট ম্যাপ এবং ড্রাইভারবিহীন ট্রেন। আজ ১৬ প্রধান লাইন ও ৩০০টির বেশি স্টেশন নিয়ে গঠিত এই বিশাল নেটওয়ার্ক।

জ্যামিতিক শিল্পকর্ম প্যারিস মেট্রোর ম্যাপ যেন একটি জ্যামিতিক চিত্রকলা। রঙিন লাইনগুলো শহরের নিচ দিয়ে পরস্পরকে ছেদ করে চলে গেছে। ১৬টি লাইনের প্রতিটি ভিন্ন রঙে চিহ্নিত লাইন ১ হলুদ লাইন ২ নীল লাইন ৪ বেগুনি লাইন ৫ কমলা লাইন ১৪ গাড় নীল। নগরের কেন্দ্র থেকে উপশহর পর্যন্ত বিস্তৃত এই লাইনগুলো শহরের প্রতিটি কোনায় যাত্রীদের পৌঁছে দেয় দ্রুত ও নির্ভরযোগ্যভাবে। এ ছাড়া রয়েছে RER (R seau Express R gional) নামে আরেকটি রেলব্যবস্থা, যা শহরের বাইরের অঞ্চলে পৌঁছাতে সহায়ক।

প্রতিটি লাইনের বৈশিষ্ট্য:

লাইন ১: সবচেয়ে পুরোনো ও আধুনিক স্বয়ংক্রিয় ট্রেন চালু হয়েছে। লা ডিফঁস থেকে ভিনসেন পর্যন্ত।

লাইন ৪: প্যারিসের প্রথম উত্তর-দক্ষিণ সংযোগকারী লাইন। সম্প্রতি এটি আংশিকভাবে স্বয়ংক্রিয় হয়েছে।

লাইন ৬: আইফেল টাওয়ারের পাশ দিয়ে যাওয়া এই লাইন অনেকাংশে ওপেন-এয়ার দৃশ্য মনোমুগ্ধকর।

লাইন ১১ ও ১৪: আধুনিক ও উচ্চগতির, ১৪ সম্পূর্ণ চালকবিহীন।

প্যারিস মেট্রোর স্টেশনগুলো শুধু যাত্রার মাধ্যম নয় তারা নিজেই একেকটি গল্প। কিছু স্টেশন শিল্পকর্মের মতো নকশাকৃত—

· Arts et M tiers: তামার রঙের স্টিমপাংক ডিজাইন যেন কোনো জাহাজের ভেতরে থাকা।

· Louvre–Rivoli: এখানে মেট্রো স্টেশনে রাখা আছে লুভর মিউজিয়ামের কপি ভাস্কর্য।

· Cluny–La Sorbonne: দেয়ালে কবিতা ও সাহিত্যিকদের নাম।

· Concorde: দেয়ালের সাদা টাইলসে লেখা রয়েছে ফরাসি বিপ্লবের মানবাধিকার ঘোষণার শব্দাবলি।

· Franklin D. Roosevelt: আলো ও শব্দ দিয়ে সজ্জিত একটি আধুনিক স্টেশন।

সকাল আটটা গার দ্যু নোর্দ স্টেশনে থেমে থাকা মেট্রোতে ঢুকে পড়ছে মানুষ, কেউ অফিসে যাচ্ছে, কেউ কলেজ কেউ বা শুধুই ভ্রমণ। কেউ বই পড়ছে, কেউ হেডফোনে গানের সুরে হারিয়ে। মাঝে মাঝে রাস্তার সংগীতজ্ঞদের পরিবেশনাও যাত্রার আনন্দ বাড়িয়ে তোলে। এভাবেই প্রতিদিন প্রায় ৫০ লাখ মানুষ যাতায়াত করে এই মেট্রোব্যবস্থায়। এর মধ্যে রয়েছে শিক্ষার্থী, পর্যটক, দোকানদার, কর্মী সবাই একসঙ্গে চলেছে এক ছন্দে।

প্যারিস মেট্রোতে ঢুকতে হলে টিকিট প্রয়োজন। সাধারণ একক টিকিটের দাম প্রায় ২.১৫। তবে স্থানীয়দের জন্য রয়েছে ‘Navigo’ নামক মাসিক বা সাপ্তাহিক পাস। এটি অত্যন্ত সাশ্রয়ী এবং RER, বাস, ট্রাম সবকিছুতেই প্রযোজ্য।

পর্যটকদের জন্য রয়েছে ‘Paris Visite Pass’, যা দিয়ে নির্দিষ্ট দিনসংখ্যার জন্য সব পরিবহনে যাতায়াত সম্ভব হয়।

যদিও প্যারিস মেট্রো বেশ নিরাপদ, তবে মাঝে মাঝে পকেটমারদের উৎপাত দেখা যায়। এ ছাড়া ধর্মঘট, সময়সূচি বিলম্ব, ভিড় এসব কিছুই এর দৈনন্দিন বাস্তবতা। তবে কর্তৃপক্ষ নিয়মিত নিরাপত্তা টহল, সিসিটিভি ও তথ্য সেবা নিশ্চিত করে। নিরাপত্তার জন্য প্ল্যাটফর্মে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় দরজা এবং কিছু লাইনে মহিলা যাত্রীদের জন্য বিশেষ সুবিধাও রয়েছে।

সাহিত্যে, চলচ্চিত্রে ও শিল্পে মেট্রো

সিনেমা: Amélie, Midnight in Paris, Before Sunset, Paris, je t'aime-এ প্যারিস মেট্রো অনন্য রূপে ধরা দিয়েছে।

সাহিত্য: প্যাট্রিক মোদিয়ানোর উপন্যাসে প্যারিসের অলিগলি ও মেট্রো ঘুরেফিরে আসে। মেট্রো যেমন স্থান, তেমনি সময় ও স্মৃতির বাহক।

চিত্রশিল্প: অনেক শিল্পী স্টেশনের দেয়াল বা প্ল্যাটফর্মে তাদের কাজ প্রদর্শনের সুযোগ পান।

প্যারিসে বসবাস শুরু করার পর প্রথম যে জিনিসটি আমাকে এই শহরের নাগরিক করে তোলে তা ছিল Navigo পাস। প্রথম দিকে ম্যাপ বুঝতে সমস্যা হলেও এখন চোখ বন্ধ করে স্টেশন গুনে ফেলতে পারি।

Arts et Métiers স্টেশনটি আমার প্রিয় বিশেষ করে রাতে ফেরার সময় নিঃশব্দ কামরায় বেজে ওঠা এক রাস্তাঘাটের বেহালার সুর এখনো মনে পড়ে। একবার République স্টেশনে এক বৃদ্ধ ভায়োলিন বাদককে দেখেছিলাম, যার সুরে সেই সন্ধ্যা যেন থমকে গিয়েছিল। ২০২৫–২০৩০ সালের মধ্যে চালু হবে ৪টি নতুন লাইন (Ligne 15, 16, 17, 18)। এ প্রজেক্টের নাম Grand Paris Express। এটি প্যারিস শহরের বাইরের অঞ্চলগুলোকে মূল শহরের সঙ্গে আরও গভীরভাবে যুক্ত করবে।

সবকিছুই হবে সম্পূর্ণ স্বয়ংক্রিয়, পরিবেশবান্ধব এবং প্রতিটি স্টেশন হবে নতুন ডিজাইনে। এতে শহরের ভেতরের চাপও কিছুটা হ্রাস পাবে।

প্যারিস মেট্রো শুধু এক স্থান থেকে অন্য স্থানে যাওয়ার যন্ত্র নয়, এটি একটি চলমান ইতিহাস, একটি জীবন্ত সংস্কৃতি। প্রতিটি স্টেশনে জমা রয়েছে অগণিত মানুষের জীবনের খণ্ডচিত্র।

এই মেট্রো যেন এক অন্তহীন কবিতা, যেখানে প্রত্যেক যাত্রী একজন পাঠক। কেউ যাচ্ছে অফিসে, কেউ প্রেমে, কেউ ফিরে আসছে স্মৃতি নিয়ে।

প্যারিস মেট্রো শহরের নিচে ছুটে চলা এক শিল্প-সংস্কৃতির মিছিল।