পৃথিবী গোল
লাঞ্চ রুমে ঢোকার মুখেই ডান দিকের টেবিলে বসে থাকা লোকটির সঙ্গে চোখাচোখি হয় সুস্মিতার। ও মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে অন্য টেবিলে বসে। খাবার বের করতে করতে মাথা তুলতেই দেখে লোকটি তাকিয়ে আছে, তারপর আবারও হালকা হেসে নিজের খাবারের দিকে মনোযোগ দেয় সুস্মিতা।
কারও সঙ্গে চোখাচোখি হলে মুখে একটা স্মিত হাসির রেখা দেখা দেয় সুস্মিতার। সেটা মনে হয় ওর ছোটবেলার স্বভাব! এ জন্য কম বিপত্তিতেও পড়তে হয়নি! অনেকেই এটাকে সহজভাবে নিতে পারেন না, কেউ কেউ ভিন্ন অর্থ খোঁজেন, কেউ আবার অবাক চোখে বা বিরক্তি নিয়ে তাকান।
লোকটি প্রশ্ন করেন, আপনি বাঙালি, বাংলাদেশের?
জ্বি।
বাংলাদেশের কোথায় আপনার বাড়ি?
জ্বি ঢাকাতেই।
আমারও ঢাকায়। ঢাকার কোথায়?
সুস্মিতা জবাব দিয়ে পরের প্রশ্ন শোনার প্রস্তুতি নেয়। কথা এগোতে থাকে।
আগে সুস্মিতা নিজেও বাঙালি দেখলেই এভাবে প্রশ্ন করে যোগাযোগ খোঁজার চেষ্টা করত, একটু কাছাকাছি কিছু পেলেই যেন বেশ চেনা হয়ে গেল মনে হতো, ভালো লাগত নতুন পরিচিত মানুষটি সম্পর্কে জানতে। নিজের দেশের মানুষকে বন্ধু বানাতে। প্রবাসজীবনের এ দীর্ঘ সময়ে ও দেখেছে, অনেকেই এটিকে অতি আগ্রহ ভাবেন, আবার অনেকেই ঠিক সেভাবে পছন্দও করেন না নতুন সম্পর্ক তৈরি। মুখের ওপর বলে বসেন, এত তথ্য জানার দরকার কী! ধীরে ধীরে নিজেকে সংবরণ করতে শিখেছে সুস্মিতা।
সে জন্য নিজে সেভাবে প্রশ্ন না করে ওনার প্রশ্নেরও সংক্ষিপ্ত উত্তর দিচ্ছে সুস্মিতা। কিন্তু লোকটি বেশ কথা বলছেন, নিজের সম্পর্কেও প্রচুর তথ্য দিচ্ছেন।
শুনতে শুনতে হঠাৎই সুস্মিতার মনে হলো এ তথ্যগুলো আগেও যেন শোনা, কিন্তু কোথায়! ওনাকে তো আগে দেখেছে বলে মনে পড়ছে না। এবার সুস্মিতা আগ্রহ নিয়েই কথা বলে, কোনোভাবে চেনে কি না মনে করার জন্য। ভালো একটা পরিচিতির মাধ্যমেই লাঞ্চের সময়টা শেষ হয়।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে, বাকিটা সময় স্মৃতির পাহাড়ে ওঠানামা করে যোগসূত্র খুঁজে বেড়ায় সুস্মিতা, কোথায় শুনেছিল, ঠিক এই একই রকম পরিচিতি!
বাসে বাড়ি ফেরার পথেও মাথায় চিন্তা উঁকি দিতে থাকে। বিকেলের সোনারোদে আকাশ হাসছে। আরে হ্যাঁ! সেদিনও শেষ বিকেলের কনে দেখা আলো ছিল। মনে পড়ে গেল ২৮ বছর আগের সেই দিনের কথা! ঠিক এ পরিচিতিগুলোই নিজের সম্পর্কে বলেছিল এক তরুণ।
বড় ভাইয়ের সঙ্গে সিলেট থেকে ভর্তি পরীক্ষা দিয়ে ঢাকায় ফিরছিল সুস্মিতা। প্রচণ্ড ভিড়ের কারণে ট্রেনে উঠতে পারেনি! টিকিট বদলানো বা পরের ট্রেনে যাওয়া যাবে কি না, সেটার খোঁজখবর নিতে গিয়েছিল ওর ভাই। সুস্মিতা তখন একা একা আপনমনে পায়চারি করছিল স্টেশনে। চকিতে খেয়াল করেছিল, দুটি ছেলে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। উপেক্ষা করার উদ্দেশ্যে উল্টো দিকে ফিরে কিছুটা পথ গিয়েছিল, তারপর ঘুরতেই দেখে ছেলে দুটি ওর দিকেই হেঁটে আসছে। একটা অস্বস্তি আর দুশ্চিন্তা ঘিরে ধরেছিল ওকে।
কাছে এসেই তাদের একজন বেশ ভদ্রভাবেই জানতে চেয়েছিল ট্রেনে উঠতে পারেনি কেন। তারপর সে নিয়েই টুকটাক আলোচনা চলছিল, এর মধ্যেই ওর ভাই এসে হাজির। ‘আমার ছোট বোন’—এই বলেই ও কথা শুরু করেছিল।
ছেলে দুজন ওখানকার রেলওয়েতে নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। সুস্মিতাদের পরবর্তী ট্রেনের অবস্থা জানিয়ে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ওদের অফিসে গিয়ে বসতে। অফিসে সামান্য আপ্যায়নও করেছিল। বলেছিল, এখানে বেশ একা লাগে, তেমন কাউকে চেনে না। ঢাকার যাত্রীদের কাছ থেকে ঢাকার খবর শুনতে নাকি ভালো লাগে, আপনজনের খোঁজ নেওয়া হলো বলে তাদের মনে হয়।
তখনই বেশ আগ্রহ নিয়ে নিজের পরিচয় দিয়েছিল তাদের একজন। সে ঢাকারই ছেলে, বুয়েট থেকে পাস করে মাত্র কাজে ঢুকেছে, মা–বাবার একমাত্র সন্তান, ঢাকার শাহজাহানপুরে দোতলা বাড়ি—এ রকম আরও সব তথ্য নিজের সম্পর্কে দিয়েছিল সে; এমনকি কোন স্কুল, কোন কলেজ। মা-বাবার নানা তথ্য। বারবার বলছিল, ঢাকায় এলে সুস্মিতাদের বাড়িতে আসবে। সেদিন তাদের সাহায্য নিয়ে মোটামুটি ভালোভাবেই ফেরার ট্রেন ধরতে পেরেছিল ওরা দুই ভাই-বোন।
অদ্ভুত ব্যাপার! একদম সেই একই পরিচিতি আজকে এই ব্যক্তি দিলেন! এখানে কবে এসেছেন, এই কাজে কবে যোগদান করেছেন, সেসব বলতে গিয়ে বাংলাদেশের সেই প্রথম কাজের কথাও বললেন। এসব তথ্য অবশ্য নতুন পরিচয়ে অনেক বাঙালিই বলেন। সে জন্য ওনার আজকের কথোপকথনও তেমন অস্বাভাবিক লাগেনি।
অতীতের সে দিনটিতেও, প্রথমে শুনতে এত বেশি কিছু মনে হয়নি। ঠিক যেন অনাবাসী কেউ নিজের আদি বাসস্থানের মানুষের সঙ্গে একাত্ম হতে চাচ্ছে, তেমনই লেগেছিল।
তবে ভয়ের কারণ ঘটেছিল যখন সে সত্যি সত্যি বাসায় এসেছিল বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। শোনার পর সুস্মিতার হৃৎকম্পন এত জোরে আর দ্রুত হচ্ছিল, যেন ওর সামনে থাকা যে কেউ সে শব্দ শুনতে পাবে, ওর হৃদয়ের ওঠানামা দেখতে পাবে। দুশ্চিন্তায় ওর চোখ-মুখ ভারাক্রান্ত হয়েছিল।
সুস্মিতা তখন একজনের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে, ওরা ঘর বাঁধার স্বপ্নে বিভোর। এর মধ্যে এ রকম যোগ্যতম পাত্র থেকে বিয়ের প্রস্তাব এলে ভয় তো পাওয়ারই কথা! কী যে সেই দিন, কীভাবে যে ম্যানেজ করেছিল! রাগে, দুঃখে গা জ্বলে গিয়েছিল, এ রকম এক বেলার দেখায় কেউ বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসে! কাছের বন্ধুরা এ নিয়ে বেশ কৌতুক করছিল। অনেক ঝড়-ঝঞ্ঝা পেরিয়ে দুজন এক হয়েছিল। তারপর আরও নানা বোঝাপড়ার পথ পেরিয়ে আজকের সুখী শান্তির নীড় ওদের।
সে ঘটনার পর পার হয়ে গেছে বহু বছর। ওই লোকের চেহারাও মনে নেই, কিন্তু যেহেতু বেশ আলোচনা হয়েছিল, তাই তার দেওয়া তথ্যগুলো কীভাবে যেন মনে রয়ে গেছে!
এমনিতেই সুস্মিতার স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো। দেশ ছাড়ার কারণেই কিনা দেশে কাটানো সময়গুলো যেন বেশি স্পষ্ট! স্মৃতিকাতরতা বারবার আক্রান্ত করে। বাংলাদেশিদের সঙ্গে কথোপকথনে কিংবা এমনিতেও দিনে কতবার করে যে পুরোনো কথা মনে পড়ে! মাঝেমধ্যে অবাক লাগে এই স্মৃতিকাতরতা কি দেশ ছেড়ে আসা সবারই, নাকি ওর একার!
পৃথিবীর ভৌগোলিক অবস্থানে বাংলাদেশের ঠিক উল্টো পাশে ও থাকে, অথচ কী তীব্র টান! এ রকম অপ্রত্যাশিতভাবে কারও সঙ্গে আবার দেখা হয়ে গেলে কিংবা স্মৃতিময় কিছুর সঙ্গে মিল পেলে মনে হয় পৃথিবী সত্যিই গোল! ঘুরেফিরে সব মানুষ যেন তার স্মৃতিময় জায়গার কাছেই ফিরে আসে।
সুস্মিতা এখন ভাবছে এই গোল পৃথিবীতে মানুষে মানুষে বারবার কি দেখা হয়ে যায়, নাকি একজীবনে কারও কারও সঙ্গে আর কখনোই দেখা হয় না!
*লেখক: আফরিন জাহান হাসি, ক্যালগারি কানাডা
(দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected])