আধুনিক কৃষির মশাল যিনি জ্বালিয়েছিলেন
ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা ছিলেন এ দেশের ক্ষুধার্ত লাখো মানুষকে বাঁচাতে আধুনিক কৃষিব্যবস্থা তৈরির একজন কিংবদন্তি পুরুষ। ছাত্রজীবনে বরাবরই মেধাবী মানুষটির ব্রতই ছিল কীভাবে এ দেশের মানুষের খাদ্যের চাহিদা নিশ্চিত করা যায়। আর তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন একজন কৃষিবিজ্ঞানী হওয়ার। হয়তো ১৯৪৩-র মন্বন্তর তাঁকে প্রস্তুত করেছিল পেশাটিকে বেছে নেওয়ার জন্য।
১৯৪৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীন বেঙ্গল কৃষি ইনস্টিটিউটে (বর্তমান শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন কাজী এম বদরুদ্দোজা। যথাক্রমে ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালে বিএজি ও এমএজি সম্পন্ন করেন। তিনি ১৯৪৮ সালে ঢাকার অ্যাগ্রিকালচারাল রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে রিসার্চ অ্যাসিস্ট্যান্ট হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ফুলব্রাইট স্কলার হিসেবে তিনি ১৯৫৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লুইসিয়ানা স্টেট ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। মুক্তিযুদ্ধ-উত্তর বাংলাদেশে কৃষি গবেষণা ও উন্নয়নে তাঁর সুপরিকল্পিত ও সফল নেতৃত্ব বাংলাদেশের খাদ্যচাহিদা মেটাতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে।
সম্ভবত ১৯৪৭ সাল। কাজী বদরুদ্দোজা তখন বেঙ্গল কৃষি ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করেন। ইনস্টিটিউটের শেরেবাংলা আবাসিক হলের ছাত্র ও প্রিফেক্ট। শেখ মুজিবুর রহমান, সে সময়ের পরিচিত নবীন নেতা, ছাত্রদের প্রিয় নেতা মুজিব ভাই, রাজনীতির কারণে হলে এসেছিলেন। কর্মীদের সঙ্গে মিটিং শেষ করতে অনেক রাত হয়ে গেল। ছাত্রদের অনুরোধেই তিনি হলে থাকতে রাজি হলেন। প্রিফেক্ট হিসেবে কাজী বদরুদ্দোজার রুটিন কাজ ছিল ১০টার পরে হলের রুমগুলো পরিদর্শন করা। পরিদর্শন করতে গিয়ে কাজী বদরুদ্দোজা মুজিব ভাইকে তাঁরই সতীর্থ নুরুল হক চৌধুরীর রুমে পেলেন। সেই সময় আবাসিক হলে বহিরাগত ব্যক্তিদের অবস্থানের অনুমতি ছিল না। এই কারণে তিনি মুজিব ভাইকে হল থেকে চলে যেতে বললেন। শেখ মুজিব হলের নিয়মনীতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে সেই রাতেই হল ত্যাগ করলেন।
তারপর দীর্ঘ সময় পেরিয়েছে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। কাজী বদরুদ্দোজা পাকিস্তানের বন্দীদশা থেকে ১৯৭৩ সালে দেশে ফিরেছেন। এর কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দপ্তরে ডাক পড়ল তাঁর। অতীতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তাঁর আচরণের কথা মনে করে কাজী বদরুদ্দোজা দ্বিধাগ্রস্ত ও শঙ্কিত হলেন। বঙ্গবন্ধুর সামনে গিয়ে তিনি অকপটে অতীতের কথা মনে করে দুঃখ প্রকাশ করলেন। কিন্তু প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বললেন, সেদিনের সেই ঘটনার পর থেকে কাজী সাহেবের অগোচরেই তাঁর কাজকর্ম ও পেশাগত উন্নতির খবর রেখেছেন তিনি। বঙ্গবন্ধু ডায়েরিতেই তা লিপিবদ্ধ করেছেন। আর সে জন্যই তিনি আজ তাঁকে ডেকেছেন দেশের কৃষি গবেষণা ও খাদ্যচাহিদা মেটাতে কৃষি গবেষণাকে আধুনিক প্রাতিষ্ঠানিক রূপদানের নেতৃত্বটি তাঁর হাতে অর্পণের জন্য।
মহান মুক্তিযুদ্ধের পর নড়বড়ে কৃষিব্যবস্থার সংস্কার ও পুনর্গঠন করে সুষ্ঠু গবেষণাব্যবস্থার মাধ্যমে দেশের কৃষির উন্নতি ব্যাপক পরিকল্পনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। এমনিতেই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন খাদ্যশস্য উৎপাদন ব্যাপক বিঘ্নিত হয়েছিল। উপরন্তু পাকিস্তান বাহিনী পরাজিত হওয়ার আগমুহূর্তে সরকারি খাদ্যগুদামের মজুত, শস্যবীজসহ কৃষি উপকরণ, সেচব্যবস্থা, হালের গরু সব ধ্বংস করে দিয়েছিল। তা ছাড়া সেই সময় আবাদি জমির দুই-তৃতীয়াংশই ছিল এক ফসলি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব দ্রুততার সঙ্গে বাংলাদেশের খাদ্যঘাটতি মোকাবিলা আর খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার পরিকল্পনা ও কর্মকাণ্ড অগ্রাধিকার ভিত্তিতে হাতে নিয়েছিলেন। তিনি তাঁর পরিকল্পনার কথা বিভিন্ন সভা-সমাবেশে বলেছেন। বিশেষত, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৩ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি তিনি কৃষিকে নিয়ে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তা ছাড়া কীভাবে প্রাদেশিক প্রতিষ্ঠানগুলো জাতীয় প্রতিষ্ঠানের রূপান্তর করা যায়, তার পরিকল্পনাও করছিলেন তিনি। বঙ্গবন্ধু জানতেন, ড. কাজী এম বদ্দরুদ্দোজাকে দিয়েই কৃষিকে নিয়ে তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। বঙ্গবন্ধু প্রথমে কাজী এম বদ্দরুদ্দোজাকে কৃষি পরিচালক (গবেষণা ও শিক্ষা) হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে রাষ্ট্রপতি অধ্যাদেশ-৬২ জারির মাধ্যমে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিণত করে এর প্রধান (পরিচালক) করা হয় তাঁকে।
রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ ৩২ জারির মাধ্যমে কৃষি গবেষণা সমন্বয় করার জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল প্রতিষ্ঠান করা হয়। এর নির্বাহী প্রধানের (ভাইস চেয়ারম্যান) দায়িত্বটিও কাজী বদরুদ্দোজার ওপর দেওয়া হয়। মূলত প্রতিভাবান এই কৃষিবিজ্ঞানীর কাঁধে বর্তায় সদ্য স্বাধীন হওয়া বাংলাদেশের কৃষি গবেষণার পুরো নেতৃত্ব। কৃষির উন্নতি ও খাদ্যঘাটতি নিরসনে কৃষি গবেষণার অবকাঠামোগত ও সার্বিক উন্নয়নের সাধনের কঠিন দায়িত্বটা।
লুইসিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি অর্জনের পর যুক্তরাষ্ট্রে শিক্ষক হওয়ার প্রস্তাব উপেক্ষা করে কাজী এম বদরুদ্দোজা জন্মস্থান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে এসে অর্থনৈতিক উদ্ভিদবিদ হিসেবে তাঁর গবেষণা কর্মজীবন শুরু করেছিলেন। এরপর ১৯৬০ সালে সুইডেনের লুন্ড ইউনিভার্সিটিতে পোস্টডক্টরাল ফেলো হিসেবে কাজ করার সুযোগ পান কাজী বদরুদ্দোজা। ১৯৬১ সালে তিনি দেশে ফিরে আসেন এবং এ সময়ই তিনি এ দেশে প্রথম গম ও ভুট্টা চাষের ব্যাপারে আগ্রহী হন। এর কয়েক বছর পর ১৯৬৪ সালে করাচিতে পাকিস্তান কৃষি গবেষণা কাউন্সিলে গবেষণা পরিচালকের দায়িত্ব পান। পরে এই প্রতিষ্ঠানের নির্বাহী পরিচালক পদে পদোন্নতি পান। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি এই পদ থেকে ইস্তফা দেন। কৃষি গবেষণায় অসামান্য কৃতিত্বের জন্য কাজী এম বদরুদ্দোজাকে পাকিস্তান আমলে তঘমা-ই-পাকিস্তান ও তঘমা-ই-ইমতিয়াজ খেতাবেও ভূষিত করা হয়েছিল।
কাজী বদরুদ্দোজা দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই এক এক করে বাংলাদেশের কৃষি গবেষণার দ্বার উন্মোচন ও আধুনিক কৃষির পথযাত্রা শুরু হয়। কাজী এম বদরুদ্দোজা মনে করতেন বাংলাদেশের কৃষকেরা সারা বিশ্বের কৃষকদের চেয়ে ফসল চাষের সিদ্ধান্ত অনেক দক্ষতার সঙ্গে নিতে জানেন। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যা ও ফসলি জমির পরিমাণ প্রতিনিয়ত কমে যাওয়ার কারণে কাঙ্ক্ষিত ফসল উৎপাদন কৃষকের জন্য দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। শুধু বিজ্ঞান ও কৃষি গবেষণা এই দুঃসাধ্য সাধনে মুখ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
তাই তিনি গবেষণা ও কৃষিশিক্ষায় গবেষণাকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়েছিলেন। আর এই কারণে তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে এই অঞ্চলের উচ্চতর কৃষিশিক্ষার প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ কৃষি ইনস্টিটিউটকে (বর্তমানে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) সংযুক্ত করেছিলেন। কৃষিশিক্ষায় গবেষণাকে আরও বেশি সম্পৃক্ত করার জন্য তিনি অত্যাধুনিক কৃষিশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রথমে কলেজ অব অ্যাগ্রিকালচারাল সায়েন্সেস এবং পরে নাম পরিবর্তন করে ইনস্টিটিউট অব পোস্টগ্র্যাজুয়েট স্টাডিজ ইন অ্যাগ্রিকালচার (বর্তমানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠা করেন। জাপানের শিক্ষা, কারিগরি ও আর্থিক সহায়তায় গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠার জন্য দুই পক্ষীয় বিস্তারিত এক আলোচনা হয় ১৯৮৩ সালের এপ্রিলে। বাংলাদেশের পক্ষে তিনি, ড. আয়ুবুর রহমান, ড. আমজাদ হোসেন ও পরিকল্পনা কমিশনের ড. আলতাফ আলী এবং জাপানের পক্ষে জাপানের কিউসু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কেইজু সুচাইয়া, অধ্যাপক সাতশি ওয়াকিমোটো এবং জাপান সরকারের কর্মকর্তারা অংশগ্রহণ নেন। এর আগে তিনি জাপান ও বিশ্বের অন্যান্য উন্নত দেশের সঙ্গে কৃষি গবেষণায় দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কও গড়ে তোলেন।
কাজী বদরুদ্দোজা শুধু একজন সফল বিজ্ঞানী ও ব্যবস্থাপকই ছিলেন না, প্রতিদিনই তিনি তাঁর জ্ঞানের ভান্ডারকে পরিপূর্ণ করতেন বিজ্ঞানের নতুন বিষয়ের সন্ধান করে। কৃষিবিজ্ঞানের নতুন নতুন তথ্য তাঁর নখদর্পণে থাকত, যেমন ৮০-র দশকের মাঝামাঝি তাঁর বক্তৃতাগুলোয় তিনি নির্ভুল কৃষি, জিনপ্রযুক্তির বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরতেন। তিনি যেমন কৃষিতে প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎসাহী ছিলেন, তেমনি তিনি প্রযুক্তির টেকসইয়ের কথাও ভাবতেন সমানভাবে।
সহজ-সরল জীবন পালন করতেন কাজী বদরুদ্দোজা এবং সহজেই সবাইকে আপন করে নিতেন। আর তাই তিনি বাংলাদেশের কৃষিগবেষণার কিংবদন্তি পুরুষ হতে পেরেছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিটি কৃষি গবেষণা ও সম্প্রসারণ কাজের সঙ্গে জড়িত কৃষিবিদের কাছে তিনি ছিলেন নক্ষত্রের মতো। তাঁরা তাঁর কাছে না গিয়েও তাঁর কৃতিত্বের গল্প শুনে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন। বাংলাদেশের কৃষিবিজ্ঞানীরা তাঁকে সম্মানিত করেছেন বিভিন্নভাবে। যেমন ১৯৮০ সালে বাংলাদেশ ও জাপানি বিজ্ঞানীদের যৌথভাবে উদ্ভাবিত একটি সুস্বাদু ও উচ্চফলনশীল জাতের পেয়ারার নাম সম্মান জানিয়ে তাঁর নামে করা হয়েছিল।
বাংলাদেশে ২০২১ সালে পাওয়া নতুন একটি ছত্রাকের জিনাসের নাম কাজী বদরুদ্দোজাকে সম্মান জানিয়ে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশের কৃষির আজকের যে অর্জন, তাঁর স্বপ্নদ্রষ্টা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে মনে করা হয়। তাঁর এই স্বপ্নকে যেসব বাস্তবায়নকারী কাঠামো দিয়েছেন, বাস্তবে রূপ দিয়েছেন, তাঁদের নেতৃত্ব দিয়েছেন ও নির্দেশক ছিলেন ড. কাজী এম বদরুদ্দোজা। বাংলাদেশের আধুনিক কৃষির প্রাণপুরুষ ছিলেন তিনি।
লেখক: বিজ্ঞানী ও কলামিস্ট
দূর পরবাসে লেখা পাঠাতে পারবেন আপনিও। ঠিকানা [email protected]