সিঙ্গাপুরের ৬০তম জন্মবার্ষিকীতে রাষ্ট্রপতির অতিথি বাংলাদেশের প্রবাসী কবি মুকুল

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রপতি থারমান শানমুগারত্নমের সঙ্গে মুকুলছবি: সংগৃহীত

শ্রমিক থেকে হয়েছেন কবি। যে খবর বিশ্বের নামীদামি গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে অনেকবার। সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশের শ্রমিক মো. মুকুল হোসেনের লেখা, সুর করা ও কণ্ঠে ধারণ করা গান ‘ও সিঙ্গাপুর’ এবং আঁকা চিত্রকর্ম ‘Through the Woods’-এর সিঙ্গাপুরের প্রেসিডেন্ট থারমান শানমুগারত্নমের উপস্থিতিতে মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠিত হয়েছে দ্য সালবেসন আর্মির ফান্ডরেইজিং অনুষ্ঠানে। যেখানে উপস্থিত ছিলেন সিঙ্গাপুরের ফার্স্ট লেডিসহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা। এ সময় মো. মুকুল হোসেন তাঁর দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেন এবং তাঁর গানের লিরিক বাঁধাইটি প্রেসিডেন্টের হাতে তুলে দেন। যেখানে বাংলা সংস্কৃতি এবং প্রবাসী বাংলাদেশি শিল্পীর অবদানও তুলে ধরা হয় অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে। এর আগে কবি মুকুল হোসেনের সিঙ্গাপুরের নামকরা পাবলিকেশন থেকে প্রকাশিত বই ‘Me Migrant’ ও ‘Braving Life’ ২০১৬ ও ২০১৭ সালে আলোড়ন তুলেছিল সিঙ্গাপুরের সাহিত্য অঙ্গনে।

মুকুল হোসেন বহু বছর ধরে নন-প্রফিট সংগঠনের সঙ্গে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে প্রবাসীদের জন্য কাজ করে চলেছেন, সমাজের উন্নয়ন ও মানবিকতার সেবায় নিজেকে উৎসর্গ করে। তিনি বিখ্যাত সিঙ্গাপুরিয়ান আর্টিস্ট বেরি ইয়ুর কাছ থেকে শিখেছেন চিত্রশিল্প। তাঁর শিল্পকর্ম শুধু সৌন্দর্যই নয়, তা বাঁচিয়ে রেখেছে আশাহত প্রাণ। এই চিত্রকর্মের জন্য ইতিমধ্যে তিনি তুরস্কের ইস্তাম্বুল, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুরসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণ করেছেন, করেছেন বেশ কিছু কাজ।

দিনভর খাটুনির ক্লান্তি শেষে গভীর রাতে যখন শহর নিস্তব্ধ, তখনই কবি মুকুলের কলমে গুঞ্জন তোলে বাংলার ধ্বনি। তাঁর কবিতা নিয়ে ইংরেজি ও চায়নিজ ভাষায় বই প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মানের পাবলিকেশন ‘Ethos Books publication Singapore’ থেকে, ‘Me Migrant’ ও ‘Braving Life’ শিরোনামে, যা শুধু তাঁর সাহিত্যিক প্রতিভার স্বীকৃতি নয়, পুরো বাংলাদেশের জন্য গর্ব।

কবি মুকুল হোসেন সিঙ্গাপুর প্রবাসের বুকে এক জ্যোতির্ময় আলোকস্তম্ভ। তিনি প্রমাণ করেছেন, প্রবাস শুধু রেমিট্যান্সের নয়, প্রবাস হতে পারে সংস্কৃতির বাহক, হৃদয়ের কাব্যিক ছন্দের এক অনন্য উৎস।

মুকুল হোসেন বলেন, ‘সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রপতির সান্নিধ্য যেন আমার জীবনের বর্ণিল ক্যানভাসে রঙের ঝলক। ওনার সঙ্গে বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে। এর মধ্যে ২০২৪ সালের এক সন্ধ্যায়, Gardens by the Bay-এ একসঙ্গে বসে ডিনার করার অভিজ্ঞতা ছিল অবিস্মরণীয়। আমার দেওয়া বইগুলো রাষ্ট্রপতির হাতে পৌঁছানোর সেই মুহূর্তে, আমার শ্রমজীবী হৃদয়ের প্রতিটি স্পন্দন যেন আশীর্বাদে মুখরিত হচ্ছিল।

অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিচ্ছেন মুকুল হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

‘এই শহরে আমি স্বপ্ন বুনতে এসেছি পরিবারকে একটি নিরাপদ আশ্রয় দেওয়ার আশায়, ভবিষ্যতের আশার প্রদীপ জ্বালানোর চেষ্টায়। লেখালেখি, গান গাওয়া এবং আঁকার যে জার্নি, তা আমার অস্তিত্বের শিকড়ে ধীরে ধীরে ইতিহাস হয়ে উঠছে। আমি আমার ফাঁকা সময়গুলো কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছি এবং আজও করে যাচ্ছি।

‘The Salvation Army-এর তহবিল সংগ্রহ আয়োজনে আমার আঁকা ‘Through the Woods’ যখন রাষ্ট্রপতির উপস্থিতিতে উন্মোচন করা হয়, সে মুহূর্তে বুকের ভেতর যেন ঝড় বয়ে যায়। আমার শিল্প, আমার আর্ট মানুষের জীবন বদলে দিতে পারে, এটা আগে ভাবিনি। কিন্তু সত্যি তা-ই হলো। নিলামের পর ভালো দামে বিক্রি হলো, কারও জীবনে আলোর আভা ছড়াল। এটি আমার জন্য এক পরম তৃপ্তি।’

অনুষ্ঠানে মুকুল হোসেনের চিত্রকর্ম
ছবি: সংগৃহীত

মুকুল হোসেন বলেন, ‘পারফরম্যান্স চলাকালীন স্টেজ থেকে যখন আমার নাম ঘোষণা করা হয়, সেটিও এক দুর্দান্ত মুহূর্ত। সম্মানিত রাষ্ট্রপতির সামনে কয়েক মিনিট কথা বলার সুযোগ পেয়েছিলাম। ইংরেজিতে আমার হৃদয়ে জমে থাকা কিছু কথা বলার চেষ্টা করেছিলাম। তারপর মহেন্দ্র খান আমার গানের মোড়ক উন্মোচন করেন। আমার লেখা ও সুর করা গান “ও সিঙ্গাপুর”-এর মিউজিক ভিডিও প্লে করা হয়। রাষ্ট্রপতির দৃষ্টিতে যখন আমার গানে মুগ্ধতা দেখি, সেই দৃশ্য আমাকে গর্বিত করে তোলে। আমার ভিডিও অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হয়। গানের লিরিক ফ্রেম করে রাষ্ট্রপতির হাতে তুলে দেওয়া হয়। তিনি মৃদু কণ্ঠে বলেন, “মুকুল, বেশ কয়েকবার দেখা হয়েছে এবং তোমার সম্পর্কে আমি অনেক কিছু জেনেছি। তোমাকে নতুন করে রোজ দেখছি। তুমি আমাদের দেশের জন্য এক অনন্য অবদান রেখেছ। চালিয়ে যাও। খুব শিগগির হয়তো আবার ডাকব এবং দেখা করব।” রাষ্ট্রপতির মুখে এ ধরনের আশ্বাস পেয়ে আমি সত্যিই খুব আনন্দিত। এই গর্ব শুধু আমার নয়, সব প্রবাসী বাংলাদেশির, আমাদের ঐক্যবদ্ধ স্বপ্নের, বাংলাদেশের। একজন শিল্পী, একজন লেখক, একজন স্বেচ্ছাসেবী দিনের শেষে আমি এমন একজন মানুষ, যে বিশ্বাস করে, মহান সৃষ্টিকর্তার রহমতেই নিজ চেষ্টায় আজ এতটুকু সামনের দিকে এগোতে পেরেছি। আমার প্রতিটি শব্দের ছায়ায় রয়েছে কৃতজ্ঞতা। আমার গল্প, আমার গান, আমার ক্যানভাস—এ সবই যেন বাংলাদেশ থেকে সিঙ্গাপুর পর্যন্ত বিস্তৃত এক আত্মপ্রকাশ।’