প্রবাসীর ঈদ আর আমার স্বপ্নে বাড়ি ফেরা
মানুষের জীবন অনেক রঙিন, কিন্তু আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, আমাদের প্রবাসীদের জীবনের সাদা আর কালো রঙের উপস্থিতি হয়তো অনেক বেশি, অন্য সব রং প্রবাসীদের জীবনে লুকিয়ে থাকে। এই তো কিছুদিন আগে সবচেয়ে বেশি প্রবাসী আয় বাংলাদেশে ব্যাংকে পাঠালেন প্রবাসীরা, কিন্তু তাঁদের শুধু স্বপ্নে বাড়ি ফেরা হয়, প্রিয় মানুষগুলো নতুন জামা পরবে, ঈদ করবে। আর প্রবাসীরা? আমাদের প্রিয় মানুষেরা কি আমাদের মনে রাখে, যখন রংবেরঙের জামা পরে ঈদগাহে যায়? হয়তো না, হয়তোবা হ্যাঁ।
সেই ২০১৩ সালে পড়ালেখা জন্য সাত হাজার মাইল দূরে রাশিয়াতে পাড়ি জমানো। কিন্তু তখনো ভাবিনি যে আমার এই পথচলা কখনো আর বাড়ি ফেরার পথ ধরবে না। ডেটা সায়েন্স অ্যান্ড আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স শেষে এখন পোল্যান্ডে থিতু। দেখতে দেখতে প্রায় ১০টি বছর প্রবাসে কেটে গেছে আলো–আঁধারের খেলায়। জীবনসংগ্রামের প্রতিটি মুহূর্ত আমি উপভোগ করেছি। হ্যাঁ, আমি উপভোগ করেছি, যখন জীবনে অন্য কোনো উপায় নেই, তখন সেই সময়টা উপভোগ করাই শ্রেয়।
আমার ছোটবেলা কেটেছে তিতাস নদীর পারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলা শহরে। তিতাস নদীর পারে এখনো আমি অল্প সময়ের জন্য দেশে ফেরা হলে সেই সব সময় খুঁজি। শান্ত তিতাসের পাড়ে বসে হারানো ছোটবেলাকে খুঁজে বেড়াই আনমনে। একদম মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার বেড়ে ওঠা। আর মধ্যবিত্ত পরিবারে যা হয়, সবকিছু সুন্দর একটা বাজেটের মধ্যে হয়ে থাকে, আমারও ব্যতিক্রম ছিল না। জাতীয় সংসদে যখন বাজেট ঘোষণা করা হয়, যেমন ভাবে, তেমনি আমরা ভাইবোনেরা সবাই অপেক্ষা করতাম, কখন আমাদের বাবা ঈদের বাজেট ঘোষণা করবেন। প্রায় সময় ২০ রোজার পর আমরা অপেক্ষায় থাকতাম, আজ হয়তো বাবা বাসায় ফিরে বাজেট ঘোষণা করবেন, কিন্তু অনেক সময় তা চাঁদরাত পর্যন্ত সময় নিত। আর অনেক সময় একদম শেষ মুহূর্তে গিয়ে আমরা কেনাকাটা করতাম। আর সেই বাজেটের সময়ে মায়ের ভূমিকা অনেক বেশি ছিল। কারণ, মা সেই বাজেট পাস করতেন। ঈদের আগমুহূর্তটা উত্তেজনায় ভরা ছিল। কারণ, আমরা সবাই অধীর আগ্রহে থাকতাম, কার ভাগ্যে কত টাকা জুটবে? কিন্তু আমরা সবাই মোটামুটি একটা পরিকল্পনা করে রাখতাম। শুধু আমার বাবার কোনো প্রকার পরিকল্পনা থাকত না। কারণ, সবার বাজেট দেওয়ার পর তাঁর জন্য আর কিছু অবশিষ্ট থাকত না। কিন্তু তা নিয়ে আমাদের কারও কোনো প্রকার ভ্রুক্ষেপ কখনো ছিল না, এখনো নেই।
এই প্রজন্মের অনেকেই ইউটিউব, ফেসবুক, স্যাটেলাইটের ভিড়ে আমাদের একসময়ের সবার প্রিয় ‘বিটিভি’র ঈদের অনুষ্ঠান হয়তো দেখার সুযোগ পায় না। তখন কিন্তু আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারে একমাত্র বিনোদনের মাধ্যম ছিল বিটিভি। প্রতিদিন বিটিভির অধিবেশন শুরু হতো বেলা তিনটায়। আর প্রতি রমজানের শেষ ২০ রোজার পর অপেক্ষা করতাম, কখন ঈদের অনুষ্ঠানসূচি শুরু হবে। যখন শুরু হতো, তখনই খাতা–কলম নিয়ে বসে যেতাম ঈদের অনুষ্ঠানসূচি লেখার জন্য। সে যেন এক অন্য রকম ঈদের খুশি ছিল। বাসার সবাই আমার কাছ থেকেই বিভিন্ন নাটক আর ঈদ অনুষ্ঠানমালা জেনে নিত। আর আমি খাতা বের করে বিটিভির ঈদের অনুষ্ঠানসূচি জানিয়ে দিতাম, যেন এক রকম বিটিভির ঈদ অনুষ্ঠানের সূচি লেখক।
অনেক দিন মায়ের হাতের সেমাই খাওয়ার সৌভাগ্য হয় না। এখানে ঈদের দিন সকালে সেমাই রান্নার এক অপচেষ্টা করি আমি। হ্যাঁ, একদম অপচেষ্টা, কিন্তু প্রতিবার হয়তো চিনি বেশি হবে, না হয় সেমাইতে লবণ দিয়ে এক ভিন্ন স্বাদের কিছু একটা রান্নার চেষ্টা করা।
প্রতি ঈদের দিন সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে আমি গণনা করতাম যে আর কয়টি ঈদ আমার জীবনে আসবে। যেহেতু ঈদ দুটি, তাহলে ৫০ বছর বেঁচে থাকলে ১০০টি ঈদ হবে। আর আমি ইতিমধ্যে ২০টি ঈদ করে ফেলেছি। আক্ষেপ হতো, ঈদ কেন অনেকগুলো হয় না। তাহলে এক জীবনে অনেক খুশি পেতাম। কিন্তু হায়, ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস, ইতিমধ্যে যখন লিখতে বসেছি, তখন ২০টি ঈদ জীবন থেকে কেড়ে নিয়েছে প্রবাস নামের সুন্দর এক কারাগার।
প্রবাসীদের কান্না করতে নেই। কারণ, কান্না আমাদের মানায় না। আমরা যে এ সমাজের সামনে এক টুকরা হীরক খণ্ড, তাই মুখ লুকিয়ে কাঁদতে হবে কোন এক দীর্ঘ রাতের শেষ দিকে, আর হাসতে হবে দিনের আলোতে, যেটা সমাজ দেখে খুশি হয়। ভালো থাকুক দেশে থাকা প্রিয় মানুষগুলো, ভালো থাকুক প্রিয় প্রবাসীরা পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর কারাগার ‘প্রবাস কারাগারে’।
লেখক: এম আর আহমেদ রাজ, পোল্যান্ড