পাঠশালার বিজয় দিবসে আলোচনা: ৩০ লাখ শহীদ বাহুল্য নাকি বাস্তবতা
টরন্টোভিত্তিক শিল্পসাহিত্যচর্চার প্ল্যাটফর্ম পাঠশালার ৪৮তম ভার্চ্যুয়াল আসরটি ডিসেম্বর মাসের একুশ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এ আসরে আলোচক ছিলেন ‘ত্রিশ লক্ষ শহীদ: বাহুল্য নাকি বাস্তবতা’সহ মুক্তিযুদ্ধ-গণহত্যাবিষয়ক একাধিক বইয়ের লেখক আরিফ রহমান ও যুক্তরাষ্ট্রের ডেনভার বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্ডি ইনস্টিটিউটের জ্যেষ্ঠ সমাজবিজ্ঞানী মোহাম্মদ ইরফান।
জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে বড়, শ্রেষ্ঠ ও গর্বের অর্জন ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ আর এ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিতর্ক সম্ভবত শহীদের সংখ্যা নিয়ে। দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পেরোলেও ইতিহাসের যেসব মৌলিক বিষয় অনায়াসেই মীমাংসিত হতে পারত শাসকের আন্তরিকতায়, সেসব বিষয়ের ন্যারেটিভ-কাউন্টার ন্যারেটিভ হয়েই চলছে আজ অবধি কমবেশি প্রতিটি সরকারের কার্যকর-নির্মোহ সহযোগিতার অভাবে ও স্বাধীনতাবিরোধীদের লাগাতার অপপ্রচারের কারণে। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক করে, কমিয়ে দেখিয়ে জামায়াতে ইসলামীসহ মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির অপরাধ লঘু করে দেখানোর একটা চেষ্টা বরাবরই হয়ে আসছে।
গণহত্যার খতিয়ান, জনমিতি থেকে পাওয়া জন্ম-মৃত্যুর হার–সংক্রান্ত উপাত্ত, দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম, আন্তর্জাতিক স্বীকৃত একাডেমিক গবেষণাসহ আরও বিভিন্ন তথ্যসূত্র ব্যবহার করে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সম্ভাব্য সংখ্যা নিয়ে বলেন আরিফ রহমান এবং ’৭১–এর গণহত্যার মতো ব্যাপক মাত্রার ঐতিহাসিক হত্যাযজ্ঞে কিংবা স্বল্প সময়ে ব্যাপক পরিমাণে অনিবন্ধিত মৃত্যু ঘটানো কোনো ঘটনায়, মৃতের সংখ্যা নিরূপণে পরিসংখ্যান মডেলের প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা করেন মোহাম্মদ ইরফান।
আলোচক আরিফ বলেন, শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কটি খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রাচীন একটি বিতর্ক। তবে এ ধরনের বিতর্ক শুধু ’৭১–এর গণহত্যা নিয়েই নয়, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে, রুয়ান্ডা গণহত্যা নিয়ে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে এবং সাম্প্রতিক জুলাই অভ্যুত্থানের নিহতদের সংখ্যা নিয়েও দেখতে পাই। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে এই ‘বিতর্ক’–এর পেছনের সবচেয়ে প্রচলিত মিথটি হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মিলিয়ন ও লাখের পার্থক্য বুঝতে পারেননি এবং পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে লন্ডনে সাংবাদিকদের কাছে শহীদের সংখ্যা ‘থ্রি লাখ’ বলতে গিয়ে ‘থ্রি মিলিয়ন’ বলে ফেলেছিলেন। কিন্তু আমরা যদি যুদ্ধের প্রাথমিক সময় থেকে গণহত্যার বিষয়ে উল্লেখ করা সংখ্যাগুলো দেখি তাহলে দেখতে পাব, মাওলানা ভাসানী যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়েই ১০ লাখ হত্যাকাণ্ডের কথা তাঁর ‘বিশ্ববাসীর কাছে ফরিয়াদ’-এ বলেছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় মেজর খালেদ মোশাররফ কানাডার গ্রানাডা টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘ইতিমধ্যে ১০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।’ কবি আসাদ চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় ‘বারবারা বিডলারকে’ কবিতায় লিখেছেন, ‘তোমাদের কাগজে নিশ্চয়ই ইয়াহিয়া খাঁর ছবি ছাপা হয়/ বিবেকের বোতামগুলো খুলে হৃদয় দিয়ে দেখো/ ওটা একটা জল্লাদের ছবি/ পনেরো লক্ষ নিরস্ত্র লোককে ঠান্ডা মাথায় সে হত্যা করেছে…।’ তিনি আরও বলেন, যুদ্ধ চলাকালে বিদেশি উল্লেখযোগ্য কিছু পত্রিকায় শহীদের সংখ্যা নিয়ে লেখা হয়: ‘টাইমস’ একাত্তরের এপ্রিলের শুরুতেই লিখেছে নিহতের সংখ্যা ৩ লাখ ছাড়িয়েছে এবং বাড়ছে, নিউজউইক এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে লিখেছে নিহত ৭ লাখ, দ্য বাল্টিমোর সান ১৪ মে লিখেছে সংখ্যাটা ৫ লাখ, দ্য মোমেন্টো কারাকাস জুনের ১৩ তারিখে লিখেছে ৫ থেকে ১০ লাখ, জুনে জার্মান সরকারের ইশতেহারে লেখা হয় ১০ লাখ, কাইরান ইন্টারন্যাশনাল ২৮ জুলাই লিখেছে ৫ লাখ, ওয়াল স্ট্রিট জার্নাল ২৩ জুলাই রিপোর্টে দেখিয়েছে সংখ্যাটা প্রায় ১০ লাখ, টাইমস সেপ্টেম্বরে লিখেছে ১০ লক্ষাধিক, দ্য হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড হাইগেট এক্সপ্রেস ১ অক্টোবর লিখেছে শহীদের সংখ্যা ২০ লাখ। গণহত্যা চলমান অবস্থায় অসম্পূর্ণ তথ্যসূত্র দিয়েই এসব নিউজ করা হয়েছে। কারণ, ডিসেম্বরের আগে পূর্ণ খবর পাওয়া অসম্ভব ছিল। যুদ্ধের সময় শহীদের সংখ্যা যে ক্রমে বাড়ছিল, তা এই তথ্যগুলো প্রমাণ করে।
আলোচক আরিফ যোগ করেন, ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত চরমপত্রের শেষ পর্বে এম আর আখতার মুকুল ৩০ লাখ শহীদের কথা বলেছিলেন, যখন বঙ্গবন্ধু জানতেনই না দেশ যে স্বাধীন হয়েছে। এর ছয় দিন পর; অর্থাৎ ২২ ডিসেম্বর দৈনিক পূর্বদেশ পত্রিকায় ‘ইয়াহিয়া জান্তার ফাঁসি দাও’ শিরোনামে লেখা হয়, ‘হানাদার দুশমন বাহিনী বাংলাদেশের প্রায় ৩০ লাখ নিরীহ লোক ও দু’শতাধিক বুদ্ধিজীবীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে’। রাশিয়ার কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র প্রাভদা পত্রিকা ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের ৩ তারিখ ৩০ লাখ শহীদের বিষয়টি প্রকাশ করে। জানুয়ারি মাসের ৪ তারিখ ৩০ লাখ শহীদের কথা প্রকাশ করে মর্নিং নিউজ, ‘ওভার ৩০ লাখ পারসনস ওয়্যার কিলড থ্রো–আউট বাংলাদেশ বাই দ্য পাকিস্তানি অকুপেশন ফোর্সেস ডিউরিং দ্য লাস্ট নাইন মান্থস’, ঢাকার পত্রিকা দৈনিক অবজারভার জানুয়ারির ৫ তারিখে শিরোনাম করে, ‘ পাক আর্মি কিলড ওভার ৩০ লাখ পিপুল’। উল্লিখিত প্রতিটি দেশি-বিদেশি পত্র–পত্রিকায় শহীদের সংখ্যা প্রকাশের সময় বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার আগে।
বক্তব্যে আরিফ বলেন, তুলনামূলক জনসংখ্যা বিচারে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের গণহত্যার সঙ্গে তুলনা করলে বোঝা যায়, ‘একাত্তর সালে আমাদের গণহত্যায় নিহতের সংখ্যাটা মোটেও অবিশ্বাস্য নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কম্বোডিয়ার খেমারুজরা ২৬০ দিনে তাদের দেশের ২১ শতাংশ মানুষকে হত্যা করে, রুয়ান্ডায় ১০০ দিনে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ মানুষ গণহত্যার শিকার হয়, চীনের নানকিং ম্যাসাকারে মাত্র এক মাসে ৩ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটে, আর্মেনিয়ার গণহত্যায় ৪৩ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে মারা হয় ১৫ লাখ, নাইজেরিয়ার ৩৫ হাজার সৈনিক ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে। ফলে সাড়ে সাত কোটি জনগণের দেশে আর ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সেনা (আত্মসমর্পণকারী) ও দুই লাখ প্রশিক্ষিত রাজাকার নিয়ে নাইজেরিয়ার মতো একই ৩০ লাখ ফিগার; অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার ৪ শতাংশ মানুষের হত্যাকাণ্ড মোটেও অবিশ্বাস্য নয়।’
পাঠশালার এ আসরের আরেক আলোচক মোহাম্মদ ইরফান বলেন, যুদ্ধের ময়দানে এবং যুদ্ধের নানাবিধ অভিঘাতের কারণে ৯ মাসের সশস্ত্র সংগ্রামে প্রাণ হারানো বাঙালিদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে পাওয়া স্বাধীন দেশে মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের বিজ্ঞানসম্মত সমাধান জরুরি। যুদ্ধ বা বড় ধরনের কোনো দুর্বিপাকে স্বল্প সময়ে ব্যাপক হতাহতের সংখ্যা পরিমাপে বিতর্ক ওঠা অস্বাভাবিক নয়। বিবদমান এক বা একাধিক রাজনৈতিক পক্ষ এ ধরনের বিতর্ককে দীর্ঘদিন জিইয়ে রাখতে সক্ষম হওয়ার উদাহরণের ক্ষেত্রেও আমরাই একমাত্র জাতি নই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক সময়ে নিহত ইহুদি জনগোষ্ঠীর প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে আজও প্রশ্ন তোলে ইহুদিবিদ্বেষীরা, নাৎসি জার্মানির মেটিকুলাস রেকর্ডকিপিংয়ের পরও। তিনি বলেন, স্বীকৃত গবেষণাপদ্ধতি ব্যবহার করলেই শহীদের সংখ্যা সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব না–ও হতে পারে। সংবাদ বিশ্লেষণ, সরকারি-বেসরকারি প্রতিবেদন এবং বিভিন্ন তথ্য-উপাত্তের মাধ্যমে ৩০ লাখের যে সংখ্যা মুক্তিযুদ্ধের দেশজ বয়ানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তা বৈজ্ঞানিক গবেষণার মাধ্যমেই কেবল আরও গ্রহণযোগ্য করা সম্ভব। শর্মিলা বোস বা ক্রিস্টোফার গারল্যাকের মতো পশ্চিমে সুপরিচিত গবেষকদের কাজের জবাব দিতে হলে কঠোর এবং রিগোরাস গবেষণাই একমাত্র পথ। এ ধরনের গবেষকদের কেবল জাতীয় ভিলেন বানিয়ে সন্তুষ্ট থাকলে হবে না। একাত্তরের গণহত্যাকে বিশ্বের অন্যতম উচ্চমাত্রার গণহত্যা হিসেবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃত করতে হলে আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্রে প্রকাশের যোগ্য উচ্চমানের গবেষণায় হাত দিতে হবে আমাদের নিজেদের গবেষকদের।
মোহাম্মদ ইরফান আরও বলেন, কেবল আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভই যে গণহত্যা শুমারির একমাত্র বা আসল উদ্দেশ্য, তা কিন্তু নয়। যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা নির্ধারণ করার বিষয়টি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন—
১. ক্ষতির ব্যাপকতা অনুধাবন: সঠিক মৃত্যু-পরিসংখ্যান সংঘাতে মানবিক ও সম্পদের ক্ষতি সম্পর্কে একটি স্পষ্ট চিত্র তুলে ধরে। মোটামুটি সঠিক পরিমাপ থাকলে নানা নীতিগত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সম্পদ বরাদ্দের ক্ষেত্রে অপচয় কিংবা ঘাটতির আশঙ্কা কমে।
২. উদ্ধার ও পুনর্বাসন তৎপরতার পরিকল্পনা: নির্ভরযোগ্য পরিসংখ্যান মানবিক সংগঠনগুলোকে প্রয়োজন নির্ধারণ, কার্যক্রম পরিকল্পনা এবং সহায়তার কার্যকারিতা পর্যবেক্ষণে সহায়তা করে। উদাহরণস্বরূপ, ইরাক যুদ্ধের সময় মৃত্যুর পরিসংখ্যান নির্ধারণ ইরাকি জনগণের প্রয়োজন বুঝতে এবং আরও বেশি সহায়তার পক্ষে সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। মৃত্যুর তথ্য জনস্বাস্থ্য হুমকি চিহ্নিত করতে, প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ পরিকল্পনা করতে এবং সংকট চলাকালে ও পরবর্তী সময়ে প্রাণহানি রোধে গুরুত্বপূর্ণ। ৩. ন্যায়বিচার ও জবাবদিহি: সঠিক মৃত্যুর পরিসংখ্যান যুদ্ধাপরাধ, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং অন্যান্য অপরাধের তদন্তে প্রমাণ হিসেবে কাজ করতে পারে, যা হতাহত ও তাদের পরিবারের ন্যায়বিচারপ্রাপ্তি এবং অপরাধীর জবাবদিহি নিশ্চিত করে।
৪. ক্ষতিপূরণ: মৃত্যুর পরিসংখ্যান ভুক্তভোগী এবং তাঁদের পরিবারের জন্য যথোপযুক্ত ক্ষতিপূরণের পরিমাণ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ এবং সহিংসতার কারণে হওয়া মৃত্যুর সঠিক মূল্যায়ন ক্ষতিপূরণ এবং সংশোধনের জন্য সমর্থন আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
৫. ভবিষ্যৎ সংঘাতে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতির পূর্বাভাস: ইতিপূর্বে ঘটে যাওয়া সংঘাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাপ ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সংঘাতে ক্ষতির পরিমাণের পূর্বাভাস দিতে সাহায্য করে।
ইরফান বলেন, ব্যাপক মাত্রার হত্যাযজ্ঞ, তথা স্বল্প সময়ে ঘটে যাওয়া ব্যাপক পরিমাণ অনিবন্ধিত মৃত্যুর সংখ্যা নিরূপণে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি এবং গাণিতিক মডেলের ব্যবহার আজকাল সুপ্রচলিত। একাত্তরের গণহত্যায় ৩০ লাখ বা ততধিক শহীদ হওয়ার মতো একাধিক প্রমাণ হাতে থাকার পরও এ ধরনের একটি গবেষণা স্বীকৃত আন্তর্জাতিক জার্নালে প্রকাশ করতে পারেননি বাংলাদেশি কোনো গবেষক। এ পদ্ধতিগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. জন্ম-মৃত্যুনিবন্ধন: যুদ্ধকালীন মৃত্যুর সঠিক এবং নিরবচ্ছিন্ন তালিকাভুক্তি যুদ্ধে প্রাণ হারানো লোকেদের সংখ্যা হিসাব করার সর্বোত্তম পদ্ধতি। তবে এটি ক্ষেত্রবিশেষে বাস্তবসম্মত নয়। যেকোনো সংঘাতে নিবন্ধনব্যবস্থা ব্যাহত হওয়ার ব্যাপারটি হিসাবে না নিলে মৃত্যুর হার নির্ধারণে ভুলের পরিমাণ বেড়ে যায়। সংঘাতকালীন নিবন্ধনব্যবস্থার সীমাবদ্ধতা পূরণে অনেক সময় সংঘতোত্তরকালে প্রশিক্ষিত সাক্ষাৎকারগ্রহণকারীদের বাড়ি বাড়ি পাঠিয়ে নিবন্ধন তালিকা পুনর্নির্মাণের চেষ্টা করা হয়। গুয়াতেমালায় দীর্ঘদিনের সামরিক শাসনের নিপীড়নে প্রাণ হারানো আদিবাসী সম্প্রদায়ের মৃত্যুর কোনো ধরনের ময়নাতদন্ত বা সনদ না থাকায় পরবর্তী সময়ে এ ধরনের মৌখিক ময়না তদন্তের মাধ্যমে মৃত্যুর হিসাব সম্পূর্ণ করা হয়। ২. ফরেন্সিক প্রমাণ: যুদ্ধকালে ব্যবহৃত নানা নথিপত্রের বিশ্লেষণ করে পরবর্তী সময়ে যুদ্ধে হতাহতের ক্ষয়ক্ষতির সংখ্যা নির্ধারণ করা যায়। যুদ্ধকালীন বন্দিশালা বা শ্রমশিবিরে জার্মানরা তাদের জঘন্য নির্যাতনের যেসব রেকর্ড রেখেছিল পরবর্তী সময়ে হলোকস্টে জীবন হারানোদের তথ্য–উপাত্ত সংগ্রহে সেসব কাজে লাগে। এ ছাড়া আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে যুদ্ধ ময়দানে বা গণকবরে শহীদদের দেহাবশেষ শনাক্ত এবং শুমারি করা আগের চেয়ে সহজ হয়েছে এখন। ৩. জরিপ: যুদ্ধের সময়ে বা যুদ্ধের পর জীবিত স্বজনের মধ্যে জরিপ করে মৃতের সংখ্যা নির্ধারণ করা যেতে পারে। এ ধরনের জরিপ আনুষ্ঠানিক ব্যবস্থায় নিবন্ধিত না হওয়া তথ্যের ঘাটতি পূরণ করতে পারে। এ ধরনের জরিপে নমুনা জনগোষ্ঠী থেকে প্রাপ্ত উপাত্ত ব্যবহার করে বৃহত্তর জনসাধারণে মৃতের সংখ্যা নির্ণয় করা যায় প্রায় অভ্রান্তভাবে। জরিপে নমুনা চয়নের বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির ব্যবহার, জরিপের প্রশ্নপত্র প্রণয়নে সতর্কতা এবং প্রাপ্ত উপাত্তের সঠিক অনুধাবন ও বিশ্লেষণ এ ক্ষেত্রে জরুরি। এ ধরনের জরিপের নানা অসুবিধা এবং গণনার ফলাফলে সম্ভাব্য পক্ষপাতের কথাও মাথায় রাখা দরকার। স্মৃতিভ্রমজনিত পক্ষপাত এ ধরনের একটি সমস্যা। যুদ্ধকালীন শারীরিক ট্রমা বা বাস্তুচ্যুতি এসব নানা কারণে উত্তরদাতারা মৃত্যুর সঠিক তথ্য মনে রাখতে বা রিপোর্ট করতে না–ও পারে। ৪. জনমিতি মডেলিং: জনসংখ্যাবিদ্যায় পরিমাপ ও পরিসংখ্যানের কাজে নানা ধরনের জনমিতি মডেল ব্যবহৃত হয়। এসব মডেলের বিভিন্ন সূত্র ও সমীকরণ ব্যবহার করে স্বাভাবিক সময়ে সংগৃহীত উপাত্তের সাহায্যে যুদ্ধের সময়ে মৃত্যুর অলব্ধ পরিসংখ্যান নির্ণয় করা যায়। জনসংখ্যার উপাত্তের জন্য বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত জাতিসংঘের জনসংখ্যা বিভাগের গড় আয়ুর টাইম সিরিজ ডেটাবেজ অনুযায়ী ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের গড় আয়ু তার আগের ও পরের বছরের প্রায় অর্ধেক। গড় আয়ুতে এই হঠাৎ পরিবর্তন কী নির্দেশ করে? বিপুলসংখ্যক অপেক্ষাকৃত তরুণ বয়সের এবং শিশুদের ব্যাপক মৃত্যুর ফলেই কেবল গড় আয়ু ৪৯ দশমিক ৬ বছর থেকে ২৬ দশমিক ৫ বছরে নেমে আসা সম্ভব এক বছরের মধ্যে। একাত্তরের আগে-পরের বছরগুলোর বয়সভিত্তিক মৃত্যুহারের ডিস্ট্রিবিউশন ও লাইফ টেবল থেকে এ ধরনের বড় মাপের গড় আয়ু পরিবর্তনের জন্য কত মৃত্যু দরকার, সেটি হিসাব করে বের করা যায়। এ ধরনের মডেল থেকে পাওয়া হিসাব জরিপ বা অন্যান্য উপায়ে পাওয়া হিসাবের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে শুমারির ফল আরও নির্ভুল করা যায়।
সর্বশেষ ইরফান বলেন, ৩০ লাখ শহীদ যে বস্তুনিষ্ঠ বাস্তবতা, এটি একাত্তরের ভয়াবহতা সম্পর্কে ওয়াকিবহাল বাঙালির মনে সন্দেহ না থাকলেও বাঙালি গবেষকদের সুসংবদ্ধ গবেষণার মাধ্যমে আন্তর্জাতিক জার্নালগুলোতে সত্যটি তুলে ধরার দৃষ্টান্ত প্রায় দেখাই যায়নি। সে ধরনের গবেষণাকাজ করার জন্য কী ধরনের প্রচেষ্টার প্রয়োজন, সেটি আলচনায় তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। আশা করা যায়, আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের গবেষকেরা এ কাজে এগিয়ে আসবেন।
বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করে আলোচক আরিফ রহমান ’৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সম্ভাব্য সংখ্যা যে ৩০ লাখের বেশি, সেটি উপস্থাপন করেন। এ ছাড়া আরিফ আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় আলোচনায় তুলে আনেন, যেমন শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কের উৎস, শহীদের বিভিন্ন সংখ্যার দাবির পেছনের যুক্তিসহ ব্যাখ্যা, শহীদের সংখ্যাকে ঘিরে বিতর্কের রাজনীতি, শহীদের সংখ্যা নিরূপণে সংজ্ঞায়নের সমস্যা, সংজ্ঞায়নের রাজনীতি, শহীদের সংখ্যা ঘিরে জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ গড়ে ওঠার পেছনের যুক্তি, নিজের মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতার আলোকে শহীদের সংখ্যা নিরূপণের পদ্ধতিগত সমস্যা-সীমাবদ্ধতা ইত্যাদি।
আরিফ রহমান তাঁর আলোচনায় গবেষণার তথ্যসূত্র উল্লেখ ছাড়াও কয়েকটি গবেষণা নিয়ে সবিস্তার আলাপ করেন। সর্বোপরি তাঁর আলোচনায় প্রাসঙ্গিকভাবে উঠে আসে মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গণহত্যার মর্মস্পর্শী কিছু বিবরণ। আলোচক ইরফানের আলোচনাও শুধু পরিসংখ্যান মডেলের প্রয়োগে সীমাবদ্ধ ছিল না। এর সঙ্গে আন্তর্জাতিক একাডেমিক পরিমণ্ডলে আমাদের গণহত্যার উপস্থাপনের প্রয়োজনীয়তা, উপযোগিতা ও সম্ভাব্য করণীয় নিয়েও বিশদে বলেন তিনি। আলোচক আরিফ রহমান এবং মোহাম্মদ ইরফানের তথ্যনির্ভর, যুক্তিনিষ্ঠ ও প্রাণবন্ত আলোচনা ঋদ্ধ করে শ্রোতা-দর্শকদের। সর্বশেষ একাত্তরের ৩০ লাখ শহীদসহ বাঙালি জাতির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির আন্দোলনের বিভিন্ন সন্ধিক্ষণে প্রাণ বিসর্জন দেওয়া সব শহীদকে গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত পাঠশালার আসরের সমাপ্তি হয়।
আসরের সঞ্চালনায় ছিলেন ফারহানা আজিম শিউলী।
*দূর পরবাস-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]–এ