ওয়াশিংটনে ফ্রিডম প্লাজায় লাখো কণ্ঠের প্রতিধ্বনি—‘গাজায় যুদ্ধবিরতি চাই’
একমুহূর্ত চিন্তা করে দেখুন তো, আপনি আপনার গৃহে বন্দী ছোট্ট ছোট্ট তিন–চারটা বাচ্চা নিয়ে, আপনার পরিবার-পরিজনকে নিয়ে। অন্ধকার ঘর, কোনো আলো নেই, কোনো পানি নেই, কোনো খাবার নেই। দুধের বাচ্চাটার দুধ নেই। তেমনি একটা বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতে ৩৩ দিন ধরে বাস করছে ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার গাজা সিটির অধিবাসীরা। আপনি যে ধর্মের হোন, যে বর্ণের হোন, যে ভাষার হোন, তা আসে–যায় না।
আপনার চোখের সামনে এমন একটা পরিস্থিতি। আপনি কিছুই করতে পারছেন না। এটা অবিচার, এটা বন্ধ হওয়া দরকার। এভাবে চলতে পারে না। আমরা মানবসভ্যতার চরম শিখরে আরোহণ করেছি। আজ একটা বোতাম টিপলেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। কিন্তু এটা কী ধরনের সভ্যতা? পৃথিবী বর্বর যুগেও এর থেকে ভালো ছিল। বনের প্রাণীরা আমাদের থেকে আজ অনেক সভ্য, তারা আমাদের মতো এত নিষ্ঠুর এত বর্বর নয়।
আমাদের মানবতাবাদীদের মতে, আজ মানবতার আলোয় উদ্ভাসিত সারা পৃথিবী। অথচ আজ এ পৃথিবীর একটি জনপদ একটা উন্মুক্ত কারাগারের মতো। তাদের খাবার নেই, পানি নেই, তাদের আলো নেই, বিদ্যুৎ নেই। তাদের সবকিছু বন্ধ করে রাখা হয়েছে তাদের শাস্তি দেওয়ার জন্য। আর মানবতাবাদী বিশ্ব তাদের পক্ষেই সাফাই গাইছে তাদেরই এনডোরস করছে যে তারা ঠিক কাজ করেছে। তারা একপক্ষকে বলছে, ‘তোমাদের বাঁচার অধিকার আছে’। অন্যপক্ষকে বলছে, ‘তোমাদের বাঁচার অধিকার নেই।
তোমরা সন্ত্রাসী।’ এ এক চরম ভণ্ডামি। এ কোন ধরনের মানবতা? এ কোন ধরনের সভ্যতা? আমি এই সভ্যতাকে ঘৃণা করি। আমি এই ভণ্ডামিকে ঘৃণা করি।
ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, এ পৃথিবীতে যারা মানবতার চরম ধ্বজাধারী, যারা মানবতা সারা পৃথিবীতে বিক্রি করছে, তারাই এখানে মানবতার চরম লঙ্ঘনকারী। ধর্মবিদ্বেষী, শিশু হত্যাকারী এবং ৭৫ বছর ধরে ধীরে ধীরে পুরো একটা দেশকে গ্রাস করেছে যারা, আজ তাদেরই শাস্তির বদলে পুরস্কৃত করা হচ্ছে।
অন্যদিকে মুসলমানদের তথাকথিত নেতা, যাঁরা ফতোয়া দেন, এক মুসলমান আরেক মুসলমানের ভাই, বলেন যে, ‘পুরো উম্মাহ একটি দেহের মতো, দুনিয়ার যে প্রান্তেই থাকুক না কেন, ভাইয়ের বিপদে পাশে দাঁড়াবে, ভাইয়ের প্রতি অন্যায়–অবিচারের শর্তহীন প্রতিবাদ করবে, সাহায্য করবে।’ কিন্তু বাস্তবে মুখে বড় বড় কথা বললেও গোপনে বৃহৎ শক্তিকে তৈলমর্দন করেই চলেছে। অথচ মুসলিম বিশ্ব পৃথিবীর দুই–তৃতীয়াংশ তেল সম্পদের অধিকারী।
তারা মিলিতভাবে এতই শক্তিধর যে এক মাস তেল বন্ধ করে দিলে ওই বৃহৎ শক্তি এসে যেকোনো শর্তে সন্ধি করতে চাইবে। কারণ, এক মাস তেল বন্ধ থাকলে বর্তমান আমেরিকায় তেলের দাম তিন থেকে চার ডলার বেড়ে ১৫০ ডলারের ওপরে দাঁড়াবে। পৃথিবীতে মুসলমানের সংখ্যা ১ দশমিক ৯ বিলিয়ন এবং তাদের একটা সংস্থা আছে, নাম ওআইসি। বাস্তবে তারা আছে কি না, তা বোঝা মুশকিল।
আমি পেশায় চিকিৎসক। আমরা একটা শিশুকে বাঁচানোর জন্য কিংবা একটা জীবনকে বাঁচানোর জন্য প্রাণপণ সংগ্রাম করি। কখনো একটা জীবনকে বাঁচানোর জন্য মাসের পর মাস চেষ্টা করি। হাজারো ডলার খরচ করি। কিন্তু এখানে দুই পক্ষেরই শত শত জীবন যাচ্ছে। শত শত মানুষ নিহত হচ্ছে। জীবন যাচ্ছে শত শত শিশুর। তবু যুদ্ধ বন্ধ করা যাবে না। তবু এ যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত হবে না! এ কি মানবতা? এটি সভ্যতা? আমরা সভ্য পৃথিবীতে বাস করি নাকি আফ্রিকার জঙ্গলে বাস করি? এ পৃথিবী বাসযোগ্য নয়। এটা মেনে নেওয়া যায় না।
যুদ্ধাহত একটি রক্তাক্ত শিশু বলেছিল, ‘আমি আল্লাহকে সব বলে দেব।’ কত অসহায় শিশুটি। কত অসহায় আমাদের শিশুরা আজ এ পৃথিবীতে। তারা আমাদের কাছে আর সাহায্য চায় না। কারণ, আমরা সাহায্য করব না কিংবা করতে পারি না কিংবা করার শক্তি আমার নেই কিংবা করার ইচ্ছা আমাদের নেই। তাই তারা আল্লাহর কাছে বিচার দিচ্ছে। তারা এমনি অসহায় এ পৃথিবীতে।
এসব আকুতি, এসব অনুভূতি, এসব প্রার্থনা নিয়েই ৪ নভেম্বর আমেরিকার রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে গিয়েছিলাম স্ত্রী ও কয়েক বন্ধুকে নিয়ে। ফ্রিডম প্লাজায় যুদ্ধ বন্ধের জন্য সভা হলো লাখো মানুষের উপস্থিতিতে। এ সভার আয়োজক ৯টি বড় সংস্থা। আর এ সভার এনডোরস করেছে পাঁচ শতাধিক সংস্থা। এর মধ্যে অর্থোডক্স ইহুদি ও মানবতাবাদী সংস্থাও ছিল। খুব আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করলাম, সভায় সব বর্ণের, সব বয়সের এবং সব ধর্মের মানুষ ছিলেন। উপস্থিত সবার মধ্যে ৫০ শতাংশের বয়স ৩০-এর নিচে।
দুই লাখ মানুষের কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলো—‘ceasefire in Gaza’, ‘stop genocide’, ‘stop funding genocide’। এর ৪০০-৫০০ গজ দূরেই হোয়াইট হাউস। লাখো কণ্ঠের এই ধ্বনি হোয়াইট হাউসের উচ্চ রেলিং পেরিয়ে ওয়েস্ট উড়িয়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছে। আমি, এমনকি বেশির ভাগ আমেরিকান বিশ্বাস রাখতে চান, ‘মানবতাবাদী’ আমাদের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সে ধ্বনি শুনেছেন। তিনি আমাদের এ ধ্বনি–প্রতিধ্বনিকে সম্মান করবেন।
এবার যুদ্ধ বন্ধ হবে। এ আশা নিয়ে এ মিটিংয়ে আমি গিয়েছিলাম। লাখো মানুষের ভেতরে আমিও একজন ছিলাম। একটি উঁচু প্ল্যাটফর্মের ওপর দাঁড়িয়ে স্লোগান দিচ্ছিলাম। হঠাৎ ক্যামেরা কাঁধে বিশাল দেহী এক ভদ্রলোক এসে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, আমি কিছু বলতে চাই কি না।
পরিচয় দিলেন, তিনি বৈরুত টিভির প্রতিবেদক। তাঁর সঙ্গে আমার কথা হলো, যে কথাগুলো আমি আগে বলেছি। সেই কথাগুলোই ওখানে উল্লেখ করলাম। তার একটু দূরেই দাঁড়িয়ে থাকা এক ভদ্রলোক এগিয়ে এসে জানতে চাইলেন, আমি তার জন্য কিছু বলতে চাই কি না। তিনি পরিচয় দিলেন, বিবিসির রিপোর্টার। তাঁর পাশে ক্যামেরা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ক্যামেরাম্যান চীনা নারী।
তাঁর পরিচয়পত্রে দেখলাম—বিবিসি। নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হলো। মুহূর্তে চিন্তা করে নিলাম, খুব ট্যাকটফুলি কথা বলতে হবে। তাই আমি চিকিৎসক পরিচয় দিয়ে শুধু শিশু হত্যার প্রসঙ্গে কথা বললাম, যা এখানে উল্লেখ করেছি। আমার সন্দেহ ঠিক প্রমাণিত হলো।
আমার সাক্ষাৎকারের শেষে রিপোর্টার ভদ্রলোক আমাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেন: Can I ask you a challenging question?
আমি বললাম: Sure.
তিনি বললেন: Are you worried about only the death of the children of Gaza? Are you not concerned about the death of children on their side in Israel?
উত্তরে আমি বললাম: Yes, I am. I am concerned and condemn any death of children anywhere in the world like this. This is our responsibility to make this world safe for our children. You must be a father and you will agree with me.
রিপোর্টার বললেন: You are right doc. Thanks.