আমাদের চামড়া আসলে পুরু হয়ে গেছে

ছবি: প্রতীকী

যে বাংলাদেশ নিয়ে আগে গর্ব করতাম, সেই দেশ কি অন্যান্য দেশের কাছে এখন হাসির খোরাক হয়ে গেছে? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’। কোনো কথার কথা নয় বা চমক দেওয়ার কথা নয়। প্রায় ৩০ বছরের প্রবাসজীবন শেষে ১০ মাস দেশে থাকার উপলব্ধি কী?
আগে মানুষকে আত্মসমালোচক হতে হবে। আমরা নিজেরা কতটা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি! কেবল নিজেরটুকু নিয়ে থাকব, নিজের ঘর পরিষ্কার রাখব, আশপাশের কিছু দেখব না আর আশা করব সব ঠিক থাকবে, তা তো হয় না। আমাদের চামড়াটা আসলে পুরু হয়ে গেছে। অন্যায় দেখলে আমরা হাসছি, মজা নিচ্ছি। কেউ প্রতিবাদ করছি না। আমরা মধ্যবিত্ত মানসিকতা ছেড়ে বেরোতে পারছি না। এটাই আমাদের মেরে ফেলছে।

আমাদের নীতিবোধ, আদর্শ, সৌজন্য কিংবা মানবিকতা বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সেইটা আমাকে ভাবায়। আমায় একা করে। এই শহরে মেশার মতো মানুষ পাই না। হয় তাঁরা অন্তঃসারশূন্য, নয়তো দুর্নীতিতে আকণ্ঠ ডুবে আছেন। আমরা মানুষ হতে পারিনি, শুধু নুনের পুতুল হয়ে নুনসাগরে মিশে গেলাম। ধর্মভেদ, জাতিভেদ নিয়ে প্রবল গর্জন তুললাম, কিন্তু কী পেলাম? শুধু দ্বেষই রইল সম্বল, আমার দেশ কোথায় দূরে হারিয়ে গেল। আমি আর ‘মানুষ’ পরিচয়ে বাঁচি না, কোনো বহুমাত্রিক পরিচয়েও নয়, শুধু একক পরিচিতির সংকীর্ণ পরিসরে থাকি এই আমার আমি।

রাষ্ট্র স্বয়ং যখন জনগণের প্রতি সমদর্শন থেকে বিচ্যুত হয়, তখন তা সাধারণের পক্ষে বিপজ্জনক বার্তা বহন করে বৈকি। আসলে এটা সেই বহুল চর্চিত কথা যে মানুষ ধর্ম ছাড়া বেঁচেবর্তে থাকতে পারবে, কিন্তু রাষ্ট্র পারবে না। বাংলাদেশের রাজনীতি বারবার প্রমাণ করছে যে ধর্মই তার বেঁচে থাকার অক্সিজেন। বাংলাদেশে বর্তমানে সেক্যুলারিজম মানে এক সোনার পাথরবাটির মতো ধারণা। অথচ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পরবর্তী যুগে বাংলাদেশের রাজনীতির মূল ভিত্তিভূমি ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। আজ ক্রমে যে ধর্মনিরপেক্ষতা এক ধূসর পাণ্ডুলিপিতে পরিণত হচ্ছে। এটা অত্যন্ত দুঃখের। ধর্মনিরপেক্ষতা আসলে পরধর্মসহিষ্ণুতার কথাই বলে। পরধর্মের ছিদ্রান্বেষণ না করেও যে নিজ ধর্মের উন্নয়ন ঘটানো যায়, এ কথা জানা চাই, মানা চাই। রাজনীতিতে নৈতিকতার অভাব দিন দিন প্রকট হচ্ছে। তাই রাজনীতিকে ধর্মের বাইরে না রাখলে যে বিপদ, তা এ দেশের মানুষ বারবার ও হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। আচার-বিচারে, খাদ্যে, পোশাক-পরিচ্ছদে, অনুষ্ঠানে বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে তফাত থাকবে এবং সেটাই উপভোগ্য হওয়ার কথা। কিন্তু তা যে হয়নি, সে আমাদের দুর্ভাগ্য। বরং সেই তফাতকে কৌশলে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে লড়িয়ে দিয়ে জ্বলন্ত সমস্যা তৈরি করা হয়েছে এবং আক্ষরিক অর্থেই। সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার সংজ্ঞা একবিংশ শতাব্দীর শিক্ষিত মানুষকেও পইপই করে বোঝাতে হচ্ছে।

বলুন তো, দেশের মধ্যে বাস করে স্বাধীনতার কোন স্বাদ পেয়েছে কোটি কোটি দেশবাসী? নাগরিকত্ব কি শুধু একটা ‘এনআইডি’ নম্বর? দারিদ্র্য ঘুচল না। সবার হাতে কাজ নেই। স্বাস্থ্য পরিষেবা অপ্রতুল। খাদ্যের নিরাপত্তা নেই, শিক্ষাব্যবস্থা বিপর্যস্ত। কোটি কোটি ভবিষ্যৎ নাগরিকের জীবন অনিশ্চিত। যুবসমাজ পথভ্রষ্ট। মানুষের সামাজিক সুরক্ষা লুণ্ঠিত। সামান্য ব্যক্তিপরিসরটুকুও দখল হয়ে গেছে। তাদের বেদনার ভাগ আজ কে নেবে?

সন্দেহ নেই, ১৯৭১ দেশে যে পালাবদল ঘটেছিল, তার শরীরের অনেকটা জুড়ে এখন ক্ষমতার মেদ এবং লোভ-লালসা-দুর্নীতির কাদা। কে এক শতাংশ অসৎ, আর কে নিরানব্বই শতাংশ, তার তুল্যমূল্য বিচার এখানে অর্থহীন। সরকারের সচিব থেকে সামন্ত আর রাজনৈতিক দলগুলো এমন এক সর্বনাশের কিনারায় পৌঁছেছে, যেখান থেকে আর ফেরা যাবে না। সর্বনাশ আসন্ন বুঝেই কি তারা নিজের আখের গোছানোর ব্যবস্থা করতে তৎপর হলো? এত দিন যে সরকারের আর দলের ওপরতলায় বসে সব ক্ষমতা ও সুযোগ ভোগ করল, দুর্দিনে পরিত্যাগ করবে, তা এখন কঠিন বাস্তবতা। আর তা কি নির্লজ্জ অনৈতিকতার পরিচয় নয়?

বামপন্থী হয়ে আমি জীবনে হয়তো আখের গোছাতে পারিনি, তাই আমি আমার মতো থাকি। তবে দিনের শেষে মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখেছি, নিজের পরিবারকে শিখিয়েছি। রাজনৈতিক নেতা কিংবা আমলাদের কাছে গিয়ে আমায় হাত কচলাতে হয় না। জীবনের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?