ঘাস, শিশির ও রৌদ্রের স্পর্শ—

ফাইল ছবি

রাতভর বৃষ্টি হয়েছিল। প্রকৃতি ভিজে কেমন সজীব ও স্নিগ্ধ হয়ে আছে। ঝোপঝাড়ের পাশ ঘেঁষে সামনে এগিয়ে যাই। দেখি, সরু একটা পথ একা শুয়ে আছে। পথের দুই পাশ থেকে ছোট ছোট গাছগুলো কেমন যেন মাথা নুয়ে পথটাকে আলিঙ্গন করে রেখেছে। এটা কী গাছ ও পথের সাময়িক সখ্য, নাকি নিবিড় মিতালি, নাকি প্রণয়—কিছুই বোঝা যাচ্ছে না! হয়তো কিছু। হয়তো কিছুই নয়। দুটি ভিন্ন সত্তার পাশাপাশি অবস্থানমাত্র। যাকে সখ্য বলে আমার ভ্রম হয়। গাছগুলোর চোখেমুখে ক্লান্তি, নাকি তন্দ্রালুতা, বোঝার চেষ্টা করি। কিছুই বুঝতে পারি না! আমার মনোযোগটা কেড়ে নেয় ওই সরু, একচিলতে পথের নিস্তব্ধতা। তার একাকিত্ব ও অখণ্ড মৌনতা।

কাছে কোথাও থেকে থেমে থেমে দু-একটা পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে। ভাঙা, অস্ফুট। হয়তো প্রিয়জনকে ডেকে তোলার চেষ্টা। কিংবা মধুর কোনো সম্বোধন—পাখিদের ভালোবাসার পঙ্‌ক্তিমালা। কিংবা অন্য কিছু।

অলডার গাছটার নিচে গিয়ে খানিকটা দাঁড়াই। এ শীতেও তার সৌন্দর্য এতটুকু ম্লান হয়নি। পাতাভর্তি শরীরজুড়ে। গাছের সৌন্দর্য পাতায়। সবুজ পাতায় গাছেদের সবচেয়ে যৌবনা মনে হয়। ওরা মানুষের নজর কাড়ে। পথচারী মুগ্ধ হয়। তাদের ছায়াতে দাঁড়ায়। কিছুটা বিশ্রাম নেয়। মানুষ তার ক্লান্তি জমা করা দেয় গাছেদের কাছে, প্রকৃতির কাছে। তারপর আবার শক্তি সঞ্চয় করে পা বাড়ায় গন্তব্যের পথে।

আমার অবশ্য আজ কোনো গন্তব্য নেই। আমি বের হয়েছি অজানা গন্তব্যের উদ্দেশে। হারিয়ে যেতে। হারিয়ে যেতে নিবিড় কোনো নিসর্গে। গভীর ছায়াঢাকা বনের অনুপম মমতায়। মানুষের চেয়ে প্রকৃতির মমতা অনেক বেশি নিখাদ, শর্তহীন। প্রকৃতি নির্মল ভালোবাসা দেয়, কিন্তু বিনিময়ে কিছুই চায় না সে। মানুষ জানে না কিসে প্রকৃতির সন্তুষ্টি, কিসে তার তৃপ্তি। এটা হতে পারে শর্তহীন দানই তার জীবনের একমাত্র ব্রত।

আপেলগাছটার ডাল বেয়ে একটা কাঠবিড়ালি তরতর করে নিচে নেমে আসে। আমার সঙ্গে একেবারে মুখোমুখি দেখা। এই সাতসকালে আগন্তুককে দেখে বিস্মিত মনে হয়। চোখ দুটি চঞ্চল। লেজটা বার কয়েক নেড়ে ডানে-বাঁয়ে দেখে নেয়। ভীষণ মিষ্টি চেহারা। আমার ইচ্ছা করে কোলে তুলে নিই। আস্তে করে সামনে এগিয়ে যাই। মুখ দিয়ে চোঁ চোঁ শব্দ করে মায়াটা বোঝানোর চেষ্টা করি। না, কাজ হয় না। আমি তার বিশ্বাস অর্জন করতে ব্যর্থ হই। এ ব্যর্থতা অবশ্য নতুন কিছু নয়। পুরো জীবনটাই যার সুদীর্ঘ ব্যর্থতার ওপর দাঁড়ানো, এ সামান্য ব্যর্থতা তাকে আর কতটাই-বা কষ্ট দেবে!

কাঠবিড়ালিটা দৌড়ে আবার গাছে উঠে যায়। কী চালাক! একেবারে মগডাল পর্যন্ত উঠে পেছনে তাকিয়ে দেখে আমি কত দূরে। হয়তো বোঝার চেষ্টা করে, নিরাপদ দূরত্বে সে পৌঁছাতে পেরেছে কি না। যে কোনো প্রাণীই সবচেয়ে বেশি শঙ্কিত থাকে তার নিরাপত্তা নিয়ে। সারা জীবন ধরে তার সব রকমের চেষ্টা থাকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কি পারে? পারে না। মৃত্যু এসে তার সারা জীবনের সব নিরাপত্তাবেষ্টনী ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। ছিনিয়ে নিয়ে যায় তাকে।

উত্তরের দিকটায় দেখি কয়েকটা বিচ কপার সারিবদ্ধভাবে দাঁড়ানো। তারপরই অপরিসর মাঠ। মাঠে কয়েকটা ঘোড়া আনমনে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করছে। ওরা জানে ওদের সীমানা নির্দিষ্ট। কারণ, পুরো মাঠটাতে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়া। বেশ উঁচু। এগুলো টপকিয়ে তারা বের হতে পারবে না। ওদের স্বাধীনতার সীমানা নির্ধারণ করে দিয়েছে মানুষ। ঘোড়াগুলোকে দেখলে মনে হয়, কেমন যেন মন খারাপ অবস্থা ওদের। একে অপরের সঙ্গে কেমন খাপছাড়া। মাঝেমধ্যে ঘাসে মুখে দিয়ে খেয়ে চলেছে। মাঝেমধ্যে সামনের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

একেবারে সামনে যাই আমি। একদম কাঁটাতারের বেড়ার কাছে। মাত্র কয়েক হাত দূরত্বে। চোখে চোখ রাখি। দেখি দুনিয়ার অসহায়ত্ব তার চোখে। এত ক্ষিপ্রগতিসম্পন্ন দীর্ঘদেহী ঘোড়ার চোখে অসহায়ত্ব মোটেই মানায় না। তবে কি ক্ষিপ্রতা তার রাগ, নাকি নিজের সামর্থ্য প্রমাণের আপ্রাণ চেষ্টা? কে জানে! কিছু একটা হবে হয়তো।
চারদিকে একটু একটু রোদ উঠছে। ঘাসের ডগায় চিকচিক করছে শিশিরবিন্দু। এ সৌন্দর্য ক্যামেরায় ধারণ করা সম্ভব নয়। সকালের প্রথম রোদ শিশিরগুলোকে উষ্ণ আলিঙ্গনে কাছে টেনে নিচ্ছে যেন।

নাকি আমি ভুল করি। এগুলো হয়তো শিশির নয়, বৃষ্টি; গত রাতের বৃষ্টি ভালোবেসে তার কিছু চিহ্ন রেখে গেছে ঘাসের ডগায়।

আমি হাত দিয়ে ঘাসগুলোকে ছুঁই। আমার হাতটা ভরে যায় মিষ্টি একটা অনুভূতিতে। স্পর্শের অনুভূতি! এ অনুভূতির কোনো ব্যাখ্যা চলে না শব্দের উপমায়। আমি শুধু অনুভব করি। গভীর অনুভব। আমার অনুভূতির সমস্ত তন্ত্রীতে নাড়া দিয়ে যায় ঘাস, শিশির ও রৌদ্রের স্পর্শ।

লেখক: কবি ও সাংবাদিক