আইসক্রিম

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

লোকটার দুই হাতে দুটো কর্কের ছিপি আঁটা বড় মুখের চায়নিজ ফ্লাস্ক। মনে হয় বেশ ভারী। ওগুলো এবার হাত থেকে নামিয়ে গেটের নামফলকটা থেকে চোখ ফিরিয়ে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। হয়তো ঠিক জায়গাটাতেই এল কি না, সেটাই কাউকে জিজ্ঞেস করে নিশ্চিত হতে চায়। চোখেমুখে অস্বস্তি ও কৌতূহলের মিশ্র অভিব্যক্তি। ঘরের ভেতর থেকে এক প্রৌঢ় ভদ্রলোক ব্যাপারটা লক্ষ করেছেন। আজ অনেকেরই আসার কথা, তাই কিছুক্ষণ পরপরই তিনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাচ্ছিলেন। ঠিক এ রকম কাউকে তো তিনি আশা করছিলেন না! আগে কখনো দেখেছেন বলেও মনে হচ্ছে না। পশমি শালের কোনা দিয়ে চশমাটা মুছতে মুছতে ভদ্রলোক বারান্দায় বেরিয়ে এলেন। ‘আপনি কি কোনো ঠিকানা খুঁজছেন?’

‘সালামালাইকুম স্যার, এইটা অ্যাডভোকেট সাহেবের বাসা না, স্যার?’

এ পাড়ায় আরও অনেক অ্যাডভোকেট আছেন। এ গলিতেই  তিনজন, এক শ গজের মধ্যে পাশাপাশি বাড়িতে সুনীল বিশ্বাস আর ইলিয়াস হায়দার সাহেব। আর রাস্তাটার একেবারে শেষ মাথায় রোহিত সরকারের বিশাল বৈঠকখানার দুয়ার তো বারো মাসই ধর্মজালের মতো হাঁ করে খোলা থাকে। এই গেটটাতেও নামের পাশে ‘অ্যাডভোকেট’ কথাটা লেখা আছে। লোকটা কোন অ্যাডভোকেটকে খুঁজছে, কে জানে? ঈদের বকশিশ চাইতে এসে থাকলে যার কাছে ইচ্ছা যাক, এখানে না বাপু। তবে গ্রাম থেকে উকিল খুঁজতে এসে থাকলে অন্য কথা। ইনি এখন আর দালাল দিয়ে রেলস্টেশন থেকে মক্কেল ধরিয়ে আনেন না। ওটার আর দরকার হয় না; বরং একটু একটু করে প্র্যাকটিসটা ছেড়েই দেবেন ভাবছেন। অনেক দিন তো হলো! ঢাকার বাড়িটা থেকে ভালোই ভাড়া আসতে শুরু করেছে। হাউস বিল্ডিংয়ের লোনও প্রায় শেষ। আর এ বাড়ি তো পৈতৃক। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা, বিয়ে—এসবও শেষ। এখন আর দালাল দিয়ে মক্কেল ধরিয়ে আনেন না বটে, তবে কুড়ি বছরের অধিককাল যাবৎ ওদের দেখে দেখে কেমন একটা মায়া পড়ে গেছে। মক্কেলগোছের কাউকে দেখলেই মনটা এখনো কেমন চনমনিয়ে ওঠে।

লোকটা  মক্কেল না বকশিশ প্রার্থী, সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আজ অবশ্য মক্কেল না আসারই কথা, বিশেষ করে হাতে আইসক্রিমের ফ্লাস্ক নিয়ে। তবে বেশি ঠ্যাকা হলে লোকজন তা-ও আসে। জোড়া ইলিশ নিয়ে যদি আসতে পারে, তো আইসক্রিম নিয়েই-বা নয় কেন? যুগ পাল্টাচ্ছে না! এ যদি সে রকমই কিছু হয় থাকে, তো কোনো রকমের রিস্ক না নেওয়াই ভালো। ভদ্রলোক বারান্দার একেবারে ধারে এসে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘কোন অ্যাডভোকেট, আগে সেটা বলেন। এখানে আমিই সব চেয়ে পুরানা উকিল, আমিই সিনিয়র অ্যাডভোকেট। ৩০ বছর এই লাইনে। লাগলে হাইকোর্টেও লোক আছে আমার। আসেন, বসেন, চা খান। আইজ একটা চান্দের দিন না? আইসাই পড়ছেন যখন আসেন।’

লোকটার মধ্যে কী একটা যেন আছে, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। ক্রমেই মনে হচ্ছে, এ লোক নিশ্চয়ই বকশিশের জন্য আসেনি। লোকটাকে ইতস্তত করতে দেখে অ্যাডভোকেট সাহেব আগ্রহভরে আবার বললেন, ‘আরে আসেন, বসেন! আগে বিষয়টা কী ভাইঙ্গা বলেন, আমি সব শুনি। তার পরে আপনের খুশিমতো যার কাছে যান যাইবেন। আমি কি আটাকামুনি আপনেরে? আসেন, কার নাম বলছে ইশটিশন থাইকা?’

লোকটা মুখ তুলে অ্যাডভোকেট সাহেবের দিকে কিছুক্ষণ নিষ্পলক তাকিয়ে থেকে বলল, ‘জি, আমি, মানে আমি, স্যার, আসলে আইসক্রিম বেচি। আপনে আসতে বলছিলেন। আপনেই তো স্যার, আপনে না? আইজ ঈদগাহতে নামাজ পড়ছেন তো? সঙ্গে কয়জন নাতি-নাতনি ছিল। আমি দক্ষিণের গেইটে বসা ছিলাম। আপনে বাইরে চইলা গিয়াও আবার ফিরা আইসা বললেন, পারলে আইজ একবার আপনের বাসায় বেশি কইরা আইসক্রিম লইয়া যাইতে। বুজলাম, আইজ ঈদের দিন তো, বাইচ্চাদেরে খুশি করবেন। বলছিলেন আদালতপাড়াতে গিয়া আপনের নাম আর বাড়ির নাম্বার বললে যে কেউ বাসা দেখাইয়া দিব। আমি নামটা ঠিক মনে করতে পারতেছিলাম না, তবে নম্বরটা মনে আছিল স্যার। ভাবলাম, যাই একবার। আপনের বাসা খুঁইজা না পাইলেও আইসক্রিম আমার ঠিকই বিক্রি হইয়া যাইব। এই পাড়ায় আসি তো, জানি, বড়লোকের পাড়া। আর আইজ বাইচ্চারা ঈদি পাইব না? ঈদের সেলামি আরকি স্যার, দ্যান না আপনেরা? বাইচ্চারা তো হাতে টাকা পাইলে আর, হে হে হে! আইজগা হেরাও খুশি, আমরা আইসক্রিমওয়ালারাও একটু ব্যবসা কইরা লই, এই আরকি!’

লোকটা যতই কথা বলছে, অ্যাডভোকেট সাহেবের ততই যেন একটু একটু করে মুখের ভাব বদলে যাচ্ছে। ক্রমেই যেন একটা অনিশ্চিত ভাবনার ছাপ।
এদিকে লোকটার মুখেও যেন একটু একটু করে সাহস বাড়ার চিহ্ন স্পষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ ঠোঁটের কোণে একটু চাপা হাসির ভাব দেখা গেল কি? আর, এবার ওর কণ্ঠে ওটা কি একটু ঠাট্টার সুর?

আইসক্রিমওয়ালা বলল, ‘গেইটে নামটা দেইখা মনে পইড়া গেল, এই নামটাই বলছিলেন। ভাবলাম, একটু খোঁজ নিয়া যাই। এক জায়গায় কাম হইয়া গেলে সারা দিন হাঁটা লাগব না। একটু আগে আগে বাসায় ফিরলে আমার বাইচ্চাটার সাথে একটু বেশি সময় দিতে পারুম, এই আরকি!’ তারপর কী মনে করে হঠাৎ ভাষা বদলে বলল, ‘এখন আর কোনো সন্দেহ নেই। আপনিই আমাকে আসতে বলেছিলেন, স্যার। মাঝে মাঝে আমার জায়গা চিনতে ভুল হয়ে যায়। তবে আজ দেখছি কেমন আশ্চর্যভাবে একেবারে ঠিক জায়গাটাতেই এসে গেছি! একটু ভালো করে দেখুন তো, স্যার! আমার চেহারাটা মনে পড়ছে না?’

অ্যাডভোকেট সাহেবও হঠাৎ ভাষা বদলে ফেললেন। একটু যেন থতমত খেয়েই বললেন, ‘তা মনে পড়ছে বৈকি! মানে, ঠিক আপনার চেহারাটা মনে নেই, তবে আমি আজ ঈদগাহতে এক আইসক্রিমওয়ালাকে ঠিকই বাসায় আসতে বলেছিলাম। তাহলে আর কে হবে? ঠিক আছে, তুমি বারান্দায় এসে দাঁড়াও। বাচ্চারা তো সবাই একসাথে তৈরি নেই, আমি ভেতরে একটু দেখে আসি। সব্বাইকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দেব। তুমি একটা একটা করে ওদের হাতে আইসক্রিম দেবে, আর কটা হলো তা গুনে রাখবে। শেষে আমি সব পয়সা বুঝিয়ে দেব। ও নিয়ে কোনো চিন্তা কোরো না। সবই দুই আনা দামের স্পেশালগুলো দেবে। ছোট মানুষ তো, সবার এক রকম না হলে আবার কেউ মন খারাপ করবে। যথেষ্ট আছে তো?’

লোকটা সুবোধ বালকের মতো ঘাড় কাঁত করে সব শুনল। তারপর সোজাসুজি অ্যাডভোকেট সাহেবের চোখের দিকে স্থির তাকিয়ে থেকে ধীরে ধীরে বলল, ‘তাহলে তুমি আমাকে সত্যিই চেনোনি বন্ধু! অবশ্য সত্যি বলতে কি, আমিও একেবারে চট করে চিনতে পারিনি। নামটা দেখেও কিছু মনে হয়নি। কত বছর হলো! আমাদের কেঁচো উকিল হয়েছে শুনেছিলাম, কিন্তু তার অনেক আগে থেকেই তো দেখা-সাক্ষাৎ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কত লোকেরই তো একই নাম থাকে! একি মানুষ না হলেও নাম আর পেশা, একসাথে দুটোই মিলে গেল, এমনও হতে পারে বৈকি, যদিও তার সম্ভাবনা বোধ করি একটু কম। মনে আছে? বছরের পর বছর ক্যারমে চ্যাম্পিয়ন হতে বলে সবাই তোমাকে ক্যারম চ্যাম্পিয়ন বলেই জানত। আসলে তা-ও না, ক্যারমের “ক্যা” আর চ্যাম্পিয়নের “চ্যা” নিয়ে সবাই ডাকতে শুরু করে দিয়েছিল “ক্যাচ্যা”। শেষে কাছের বন্ধুদের কাছে ওই “ক্যাচা” থেকে “কেঁচো”, মনে নেই? আজ কিন্তু আমিও দেখে প্রথমে চিনতে পারিনি, তবে খুব চেনাচেনা লাগছিল। দেখো তো আরেকবার ভালো করে, লাস্ট বেঞ্চের পাগলা সুনীলকে মনে পড়ে কি না?’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘আরে পসু, তুই! পাগলা রে, তুই, তুই বেঁচে আছিস? আমি শুনেছিলাম পদ্মায় নৌকাডুবিতে...তারপর আর কাকে খুঁজব বল, কেনই-বা খুঁজব? পাগলারে, এ রকম তো গল্পে অনেক হয় জানি, কিন্তু বাস্তবেও?  আমায় মাফ করে দেরে পাগলা, মাফ করে দে। আয় ভেতরে আয়’, বলে কেঁচো পসুকে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে রেখেই অনেকটা পিছু হেঁটে বারান্দার দিকে টানতে লাগল। পসু কোনোমতে আলিঙ্গন ছাড়িয়ে নিয়ে ফ্লাস্ক দুটি আবার দুই হাতে তুলে নিল। কেঁচোর মতো পাগলা সুনীলও প্রথমে পাগলার “পা” আর সুনীলের “সু” থেকে হয়েছিল “পাসু”। তারপর “পাসু” থেকে একেবারে “পসু”। কী সব দিন ছিল সে সময়ে, আহা!
... ...
এবার দুজনে মুখোমুখি বসেছে। কেঁচো পসুর হাত দুটো চেপে ধরে আছে, যেন ছেড়ে দিলেই পালিয়ে যাবে। কথা আর থামে না। এত দিন কোথায়, কেমন করে কাটল, তার এ রকম দশাই-বা কেন, এসব জানার কৌতূহলে মরে যাচ্ছে। পাগলা বেশ শান্তভাবেই বলে, ‘নৌকাডুবির পর থেকেই তো আর দেখা হয়নি, তা-ই না? ডুবেছিলাম তো সেই ক্লাস নাইনে। তোরা নিশ্চয়ই জেনেছিলি আমি মরে গেছি? বেশ কিছুদিন পর্যন্ত সবাই তাই- জানত। কিন্তু আসলে সেদিন আমি ডুবে মরিনি; মরলাম বেঁচে গিয়ে। জীবিতদের একটা বিপদ কী জানিস তো, জানে বাঁচলে জীবনেও বাঁচতে চায়। দুটি এক হলো, বল? সব জীবিতেরই জান থাকে, কিন্তু জীবন সবার জন্য না। কিন্তু সবাই কি আর তা বোঝে? তবে সত্যি বলতে কি, আমার আসলে নালিশ নেই কোনো। একটা মেয়ে আছে। একটা বউ আছে। মাথার ওপর একটা ছনের চাল আছে, যার নিচে বছরের বেশির ভাগ দিনই নিশ্চিন্তে ঘুমোতে পারি, হা-হা-হা।  আর কী চাই, বল? নে ডাক, তোর পুঁচকে বাহিনীটাকে, ডাক। আমি বিদেয় হই। আজ তোদের পার্বণ, অন্য আরেক দিন এসে গল্প করব। নে ডাক ওদের এবার। ভয় নেই, ওদের সামনে তুই-তুকারি করব না। পসু হতে পারি, তবে উল্লুক না!’

ঠিক এ সময়ে একটা বছর পাঁচেকের দুরন্ত ছেলে হুড়মুড় করে এসে ঘরে ঢুকেই একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। অ্যাডভোকেট সাহেব ডাকলেন, ‘এসো নানাভাই, দেখো তোমাদের জন্যে কী এসেছে আজ!’ ছেলেটি যেন হঠাৎ একেবারে লজ্জায় মরে যাচ্ছে। একটু দুরন্ত টাইপের বাচ্চারা বিশেষ বিশেষ মুহূর্তে যেমন বাকহারা হয়ে কী করবে না করবে বুঝে উঠতে পারে না, সে রকম। এতক্ষণে সে দরজার ভারী পর্দাটা জড়িয়ে ধরে প্রায় ঝুলতে ঝুলতে, ভেঙে ভেঙে, থেমে থেমে বলল, ‘নানাভাই, দেখো, আইসক্রিমওয়ালাটা তোমার সোফায় বসেছে!’ তারপর ঝট করে ওর দিকে তাকিয়ে বলল, ‘তুমি ওখানে বসেছ কেন?’

আইসক্রিমওয়ালার হাঁটুতে যেন স্প্রিং আঁটা। যন্ত্রচালিতের মতো ঝট করে উঠে দাঁড়াল। কিছু একটা বলার জন্যে মুখ খুলতে যাবে, তৎক্ষণাৎ বন্ধু তাঁকে হাত ধরে টেনে বসাতে বসাতে বললেন, ‘না ভাইয়া, ইনি তোমার আরেকজন নানাভাই। আগে দেখোনি তো, তাই চিনতে পারছ না। সবার জন্যে আইসক্রিম নিয়ে এসেছেন। অনেক আইসক্রিম! যাও, সবাইকে খবর দিয়ে এসো। না হয় এক কাজ করো, তোমারটা আগে নিয়ে যাও। এসো এসো, লজ্জা কিসের? আরেকটা নানাভাই তো, এসো!’। কিন্তু ছেলেটি লজ্জায় আসছে না। কেবল ওখানে দাঁড়িয়ে থেকেই পর্দাটা হাতের মধ্যে দড়ির মতো করে পেঁচাতে শুরু করে দিল। তারপর হঠাৎ বলল, ‘আমার টাকা আছে। নানু দিয়েছে’।

অ্যাডভোকেট সাহেব বললেন, ‘বাহ, তা-ই? ওটা দিয়ে কী করবে নানাভাই? আচ্ছা, আগে যাও, সবাইকে আসতে বলো।’

ছেলেটি এক ছুটে বাড়ির ভেতর নিরুদ্দেশ হয়ে গেল। তারপরই সেখানে একটা হইচই, কিচিরমিচির।  
... ...

দুই বন্ধু পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। বাচ্চারা একেক করে এগিয়ে আসছে। একজনের হাতে একজন আইসক্রিম তুলে দিচ্ছে তো অন্যজনের হাতে অন্যজন। আইসক্রিম হাতে পেয়েই ছুটে পালাচ্ছে বাচ্চারা। একেবারে ছোট্ট ফুটফুটে একটা মেয়ে তার মুঠো হাতটা খুলে ওর মধ্যে ঘামে ভিজে যাওয়া একটা দুমড়ানো পাঁচ টাকার নোট আইসক্রিমওয়ালার সামনে তুলে ধরল। ভারী লাজুক। মুখে কিছুই বলছে না। আইসক্রিমওয়ালা লোকটা হেসে বলল, ‘বাহ, তোমার তো অনেক টাকা! ওটা আজ লাগবে না। মায়ের কাছে রেখে দিয়ো, তিনি যত্ন করে তুলে রাখবেন। পরে তুমি ওটা দিয়ে অনেক আইসক্রিম কিনতে পারবে, খুকি।’ মেয়েটি ঘাড় কাঁত করে সম্মতি জানাল। তারপর খুব আস্তে করে বলল, ‘আমার নাম তো ফ্লোরা।’ লোকটা মুচকি হেসে ওর হাতে একটা গোলাপি রঙের আইসক্রিম ধরিয়ে দিয়ে মাথায় আদর করে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল, ‘বাহ, কী সুন্দর নাম! আমি তো জানতামই না, তুমি যে আসলে খুকি না, ফ্লোরা। বলো তো, ফ্লোরা মানে কী?’ মেয়েটি দুপাশে মাথা নাড়ায়। তারপর একটু চুপ করে থেকে হঠাৎ গম্ভীর হয়ে বলে, ‘মা তো শাড়ি পরে, তার পকেট নাই!’ দুই বন্ধুতে এক সঙ্গে হো হো করে হেসে ওঠে। মেয়েটি হকচকিয়ে একটু ত্রস্ত পায়ে বাড়ির ভেতর অদৃশ্য হয়ে যায়।  কেঁচো আর পসু হাসতেই থাকে।

আইসক্রিম বিতরণের পালা শেষ। পসুকে এবার যেতে হবে।

মানুষের অবচেতন মন বড্ড শক্তিশালী। আলাপে আলাপে কখন যে দুই বন্ধু ‘আপনি’ থেকে ‘তুই’ হয়ে, শেষে ‘তুমি তুমি’তে এসে নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে নিয়েছে, তারা তা টেরও পায়নি। অল্প কটা আইসক্রিম তখনো বাকি ছিল। সেগুলো একটা ফ্লাস্কে করে কেঁচোর হাতে তুলে দিয়ে পসু বলল, ‘যাও, এক্ষুনি ফ্রিজে রেখে এসো, না হলে গলে যাবে।  ফ্লাস্কটা খালি হলেই আমি যাব।’

কেঁচোর তীব্র আপত্তি, ‘আরে না, না, সে কী করে হয়, বসো,  দুপুরে খেয়ে যাবে।’

কিন্তু দুপুরে খেয়ে যাওয়া তো ওর পক্ষে সম্ভব না! বাড়িতে মেয়েটি অপেক্ষা করে থাকবে। স্ত্রীও দুপুরে একা খাবে না কিছুতেই, তা সে যৎসামান্য খাবারই হোক। বলল, ‘না ভাই, আজ থাক। যাওয়ার পথে আবার ফ্লাস্ক দুটি ফ্যাক্টরিতে জমা দিয়ে যেতে হবে। আমার ঘরটার যা অবস্থা, ভালো করে দরজাটা পর্যন্ত বন্ধ করা যায় না। শেষে একটা ফ্লাস্ক চুরিটুরি হয়ে গেলে খেসারত দেওয়ার মুরোদ আমার নাই। আচ্ছা আসি।’ কথাটা বলেই সে উঠে দাঁড়াল।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

কেঁচো জোর করে ওর পকেটে এক দলা টাকা ঢুকিয়ে দিতে গেল। কিন্তু নিয়মিত ভারী ফ্লাস্ক বয়ে বেড়ানো মজবুত বাহুর সাথে জোরাজুরিতে সে পারবে কেন? মুঠো হাতটা জোরে চেপে ধরে রেখেই পসু বলল, ‘ওটা কী দিচ্ছো বন্ধু, দাম না দান?’ কেঁচো এর কী জবাব দেবে? হঠাৎ চুপসে গেছে দেখে হয়তো মায়া করেই সে আবার বলল, ‘দান তো আমি এখনো গ্রহণ করতে শিখিনি। একদিন অবশ্য এ দম্ভ চূর্ণ হয়ে যেতেও পারে। সেদিন হয়তো নিজেই চাইতে আসব। তা বলে আজই, এই মুহূর্তে, তোমার হাত দিয়েই শুরু হোক, তা-ই কি চাও?’

এরপর কথাবার্তা একটু খেইহারাই হয়ে গেল যেন। অ্যাডভোকেট সাহেবের ওকালতি বুদ্ধির মারপ্যাঁচ হঠাৎ সব গুলিয়ে যাচ্ছে। আমতা-আমতা করে কোনোমতে বলল, ‘তা কেন? তুমি কষ্ট করে এতগুলো আইসক্রিম নিয়ে এলে, মানে, তোমার সারা দিনের পরিশ্রম!’

‘তাহলে দামই দিতে চাচ্ছো? ওদের কাছে নানাভাই সাজিয়ে যে আনন্দ আজ আমাকে দিলে, কটা আইসক্রিমের মূল্য মিটিয়ে সেটি আবার জোর করে ফিরিয়ে নিতে চাচ্ছো তো?  জানো না, ভালোবাসা ফেরতযোগ্য নয়? তা ছাড়া এ তো শুধু তোমার ভালোবাসা নয় বন্ধু, ওদের। ওদেরকে জিজ্ঞেস করছ? ওরাও কি তা-ই চায়? সব চেয়ে বড় কথা, উপেন যদি এখন তার শেষ দুই বিঘে জমি বিক্রি করতে রাজি না হয়, তাহলে?’ বলে একটু শব্দ করে হাসল। তারপর বেশ ভাবুকের মতো করেই বলল, ‘এর চেয়ে ভালো, আইসক্রিমের দাম নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে বরং পুরো ট্রানজেকশনটার মূল্যটুকু দুজনে শেয়ার করে নিই। সমাজ পড়াতে গিয়ে মোখলেস স্যার যেমন প্রায়ই বলতেন, “লেট আস থিঙ্ক ভ্যালু, নট প্রাইস, ফর গডসসেইক!” মনে আছে? সে রকম। আমি কটা অপ্রত্যাশিত অমূল্য মুহূর্ত বুকে করে নিয়ে চলে যাই। আর তুমি…মানে, এটা দুজনের জন্যেই ভালো হলো না, বলো?’

জীবনভর ক্লাসের ব্যাক বেঞ্চে থেকেও পসুটা কথাবার্তায় বরাবরই পটু ছিল। কেঁচো বুঝে গেছে, ওর সেই পুরোনো দিনের দার্শনিক দার্শনিক ভাবটা আজও একেবারে মরে যায়নি। ওর সঙ্গে তর্ক বৃথা। এবারও কেঁচো পসুর কথাটার কোনো উপযুক্ত উত্তর খুঁজে পায় না। কোনোরকমে বলল, ‘তোমাকে আজ “আরেকটা নানা” বানিয়ে আমি যে আসলে কার মান রক্ষা করার চেষ্টা করলাম, সেটাই ভাবছি। তখন ভেবেছিলাম, বুঝি তোমার আমার দুজনেরই। এখন বুঝতে পারছি, তোমার আসলে মান রক্ষার দরকার ছিল না, আমার ছিল। তোমার আত্মসম্মানবোধটুকু মজবুত, আমারটা ঠুনকো। তুমি কারণের যোদ্ধা, আমি অকারণের। তোমার হয়তো ক্ষতিই করে ফেললাম বরং। কিন্তু যা হবার তো হয়েই গেছে, বলো! কিছু মনে কোরো না ভাই।’

পরিবেশটা একটু হালকা করতে পসুও চায়। বলল, ‘না না, ক্ষতি আর কী? অবশ্য এরপর আর এ পাড়ায় আইসক্রিমের ফ্লাস্ক নিয়ে বেশি ঘোরাঘুরি করা যাবে না, সে কথাই ভাবছ তো? তা অবশ্য ঠিক। বাচ্চাদের তো জানোই, কোথায় কখন বেফাঁস বলে ফেলবে, “ওই যে আইসক্রিমওয়ালাটা, সে না আমার নানাভাইয়ের বন্ধু, আমাদের আরেকটা নানাভাই হয়!” তাহলেই হয়েছে! তোমার মান-ইজ্জতের একেবারে  দ্বাদশ ঘটিকা আসন্ন, হা-হা-হা। অবশ্য সে সুযোগ আমি তাদের দিচ্ছি না। এমনিতেও ভাবছিলাম ধীরে ধীরে কাজের এলাকাটা একটু গুটিয়ে আনব। এখন আর বেশি হাঁটতেও পারি না ভাই, রোদ-বৃষ্টির ধকলও আর বেশি নিতে পারি না। ও নিয়ে তুমি ভেবো না।  চলি তাহলে? ভালো থেকো। ঈদ মোবারক!’

দুই হাতে দুটি ফ্লাস্ক দোলাতে দোলাতে আইসক্রিমওয়ালা চলে গেল। অ্যাডভোকেট সাহেব আনমনে ওই দোলা চেয়ে চেয়ে দেখছিলেন। হঠাৎ খেয়াল হলো, দুপুরের খাবার সাজিয়ে সবাই অপেক্ষা করছে। আর দেরি করা যায় না।