টিটলিস: সুইজারল্যান্ডের বরফের রাজ্য

সুইজারল্যান্ডের আল্পস পর্বতমালার মধ্যে অবস্থিত টিটলিস, বিশ্বের অন্যতম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের একটি নিদর্শন। এ পাহাড়ের উচ্চতা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১০,৬২৩ ফুট উঁচুতে, যা এটিকে ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু স্থানে পরিণত করেছে। বরফের স্তুপ, পাহাড়ের চূড়া এবং চারপাশের মনোরম দৃশ্য টিটলিসকে পর্যটকদের জন্য একটি তীর্থস্থান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

জুরিখের যাত্রা

২০২২ সালের ৪ জানুয়ারি, নতুন বছরের প্রথম ভ্রমণের উদ্দেশ্যে বের হলাম। জার্মানি থেকে সুইজারল্যান্ডের জুরিখ শহরে পৌঁছালাম ৫ তারিখ সকালে। জুরিখ, সুইজারল্যান্ডের অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতির প্রাণকেন্দ্র, যেখানে আধুনিক স্থাপত্যের সঙ্গে প্রাচীন ঐতিহ্যের মিশ্রণ ঘটেছে। হোটেলে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিয়ে স্থানীয় ব্যবসায়ী বাকী উল্ল্যাহ ভাইয়ের নিমন্ত্রণে গিয়েছিলাম। সেখানে দেশীয় খাবারের সঙ্গে পরিচিত হয়ে আমার মন ভরে গেল।

টিটলিসের পরিকল্পনা

জুরিখে কাটানো সেই সন্ধ্যায়, বাকী ভাইয়ের উৎসাহে টিটলিস ভ্রমণের পরিকল্পনা করলাম। উনার বর্ণনায় টিটলিসের সৌন্দর্য এবং এর উচ্চতা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। পরের দিন সকালে, জুরিখের সেন্ট্রাল রেলওয়ে স্টেশনে গিয়ে টিটলিসের জন্য ট্রেন ও ক্যাবল কারের টিকেট কিনলাম। স্টেশনটির স্থাপত্য সৌন্দর্য আমাকে আকৃষ্ট করেছিল—মাঠির ওপরে-নিচে বিশাল প্ল্যাটফর্ম, আধুনিক স্থাপত্যের নিদর্শন।

লুজার্নের পথে

পরের দিন সকাল ৭টা ২০ মিনিটের ট্রেনে উঠলাম। জুরিখ থেকে লুজার্ন হয়ে ইংগেলবার্গের পথে যাত্রা শুরু করলাম। পথের দুই পাশে বরফে ঢাকা পাহাড় ও লেকের দৃশ্য আমাকে বিমোহিত করেছিল। লুজার্নে পৌঁছানোর পর, ইংগেলবার্গের যাওয়ার জন্য ট্রেন পরিবর্তন করলাম। ট্রেনের জানালা দিয়ে বরফে ঢাকা বাড়িগুলো দেখে মনে হচ্ছিল যেন একটি সাদা স্বপ্নের দেশে প্রবেশ করেছি।

ক্যাবল কারের অভিজ্ঞতা

ইংগেলবার্গে পৌঁছে বাসে করে টিটলিস ক্যাবল কার স্টেশনে গেলাম। দীর্ঘ লাইনে অপেক্ষার পরে ক্যাবল কারে উঠলাম। এটি ছিল আমার প্রথম ক্যাবল কার ভ্রমণ। এই ক্যাবল কার বিশ্বের প্রথম ঘূর্ণায়মান ক্যাবল কার স্টেশন, যা ১৯৯২ সালে নির্মিত। ওপরে উঠতে উঠতে অনুভব করছিলাম এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ—আমি ইউরোপের সবচেয়ে উচ্চতম স্থানে যাচ্ছি।

টিটলিসের চূড়ায়

টিটলিসের চূড়ায় পৌঁছানোর পর আমার মনে হচ্ছিল আমি স্বপ্ন রাজ্যে চলে এসেছি। চারপাশে শুধু বরফের স্তুপ, মাথার ওপরে মেঘ। সেখানে একটি ঝুলন্ত ব্রিজ ছিল, যা ইউরোপের সবচেয়ে উঁচু ব্রিজ। সেই ব্রিজে হাঁটতে গিয়ে এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ অনুভব করছিলাম। টিটলিসের চূড়ায় কিছু সময় কাটানোর পর, ক্যাবল কারে করে নিচে নামার সময় মনে হচ্ছিল যেন আমি এক নতুন দুনিয়ায় ফিরে যাচ্ছি। নিচে নামার সময়, আমি ভাবছিলাম আমাদের দেশের কেওক্রাডং পাহাড়ের কথা। যদি আমাদের দেশে এমন ক্যাবল কারের ব্যবস্থা থাকতো, তাহলে আমাদের পর্যটন শিল্প আরও বিকশিত হতো।

লুজার্নে ফিরে আসা

নিচে ফিরে এসে ইংগেলবার্গ থেকে লুজার্নে গেলাম। সেখানে একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টে খাবার খেতে গিয়ে বুঝলাম, সুইজারল্যান্ডে খাবারের দাম কতটা ব্যয়বহুল। লুজার্ন লেকের পাশে বসে খাবার খেতে খেতে লেকের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।

জুরিখের ফিফা জাদুঘর

সন্ধ্যায় জুরিখে ফিরে এসে ফিফা মিউজিয়ামে গেলাম। এখানে পৃথিবীর সব দেশের ফুটবল জার্সির মধ্যে বাংলাদেশ ফুটবল দেখে আমার হৃদয়ে গর্বের অনুভূতি জেগে উঠল। তারপর একে একে দেখলাম ফুটবল জগতের কিংবদন্তিদের জার্সি, বুটসহ নানা কিছু। তারপর চোখে পড়ল পাশাপাশি রাখা বিশ্বকাপ ফুটবল কাপ ও বিশ্বকাপ মহিলা ফুটবল কাপে। খালি চোখ একেবারে কাছ থেকে কাপ দুটি দেখে কি যে এক আনন্দকর এক অনুভূতি এল নিজের মধ্যে!

টিটলিসের অভিজ্ঞতা আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে। এই ভ্রমণ আমাকে প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য, আধুনিক স্থাপত্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে। টিটলিসের বরফের রাজ্যে কাটানো সময়, আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে।

সুইজারল্যান্ডের এই অভিজ্ঞতা আমাকে শিখিয়েছে—প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করতে হলে, আমাদের অবশ্যই সেই সৌন্দর্যকে রক্ষা করতে জানাতে হবে। এই ভ্রমণ আমাকে আরও বেশি করে ভ্রমণের প্রতি আকৃষ্ট করেছে এবং ভবিষ্যতে আরও নতুন নতুন স্থান ভ্রমণের জন্য অনুপ্রেরণা সৃষ্টি করেছে।

*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]