সব বাবার স্মরণে: শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্রকাশ

১৬ জুন বাবা দিবস। পাঠকের পাঠানো লেখা থেকে বাছাইকৃত লেখা প্রকাশিত হচ্ছে দূর পরবাসে।

বাবা দিবসের ধারণাটি প্রথম যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভাবিত হয়। সনোরা স্মার্ট ডড নামের একজন নারী দিনটি প্রথমবারের মতো ১৯০৯ সালে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। তাঁর বাবা উইলিয়াম জ্যাকসন স্মার্ট একজন সিভিল ওয়ার ভেটেরান ছিলেন এবং সনোরার মা মারা যাওয়ার পর তিনি একাই ছয়টি সন্তানকে লালন-পালন করেন। মায়েদের সম্মানে মা দিবস পালনের পর সনোরা তাঁর বাবা ও অন্যান্য বাবাদের সম্মান জানানোর জন্য একটি বিশেষ দিনের প্রস্তাব করেন।

১৯১০ সালের ১৯ জুন, ওয়াশিংটনের স্পোকানে প্রথম বাবা দিবস পালিত হয়। এরপর ধীরে ধীরে এ দিবসটি জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন এই দিনটিকে জাতীয় ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করেন।

বাবা দিবসের গুরুত্ব এবং উদ্‌যাপন

বাবা দিবস শুধু আমাদের বাবাদের জন্য বিশেষ একটি দিন নয় বরং এটি আমাদের জীবনের সব পুরুষ অভিভাবক এবং পথপ্রদর্শকদের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের একটি সুযোগ। এ দিনে আমরা শুধু জীবিত বাবাদেরই নয়, প্রয়াত বাবাদের প্রতিও শ্রদ্ধা জানাই। তাঁদের স্মৃতিচারণা করে এবং তাঁদের দেওয়া শিক্ষাকে জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করি।

বিশ্বব্যাপী বাবা দিবসের উদ্‌যাপন

বাবা দিবস শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই নয়, বিশ্বজুড়ে পালিত হয়। বিভিন্ন দেশে এই দিনটি ভিন্ন ভিন্ন দিনে পালিত হয় এবং উদ্‌যাপনের ধরনও ভিন্ন। যেমন যুক্তরাজ্য ও কানাডায় যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই দিনে পালিত হয়। অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম রোববার পালিত হয়। জার্মানিতে খ্রিস্টের স্বর্গারোহণের দিনে পালন করা হয়, যা প্রায় ৪০ দিন পর আসে।  থাইল্যান্ডে ৫ ডিসেম্বরে বাবা দিবস, রাজা ভূমিবল আদুল্যাদেজের জন্মদিন পালন করা হয়। সুইডেনে বাবা দিবস পালিত হতে শুরু হয় ১৯৩১ সালে। প্রথমে এটি জুন মাসে পালিত হতো, কিন্তু পরে মে মাসের শেষ রোববারে পালিত মা দিবসের কাছাকাছি হওয়ায় নভেম্বরের দ্বিতীয় রোববারে স্থানান্তরিত করা হয়। বাবা দিবসটি মা দিবসের চেয়ে কিছুটা সহজভাবে পালিত হয়।

একটি হৃদয়স্পর্শী গল্প: বাবার সাথে প্রথম চাকরির দিন

একদিন সকালে আমি প্রথম চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যাচ্ছিলাম। আমি খুবই নার্ভাস ছিলাম এবং আমার মনে আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। বাবা তা বুঝতে পারলেন এবং আমাকে বললেন, ‘আজকের দিনটা তোর জীবনের একটি নতুন অধ্যায়। সব সময় মনে রাখিস, সৎভাবে পরিশ্রম করবি, কখনো হাল ছাড়বি না। তুই সফল হবি, কারণ, তোর মধ্যে সেই সামর্থ্য আছে।’

বাবার কথাগুলো আমাকে সাহস দিল এবং আমি ইন্টারভিউতে ভালো করলাম। আমার চাকরি হলো এবং সেই দিনটি আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিল। আজ আমি সফলভাবে আমার পেশাগত জীবন পরিচালনা করছি, যার পেছনে বাবার প্রেরণা ও আশীর্বাদ ছিল। বাবার সেই কথাগুলো আমার জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে একটি পথপ্রদর্শক হয়ে আছে।

বাবার অনুপ্রেরণায় বিশ্বভ্রমণ
আমার মা–বাবার সঙ্গে হজযাত্রার স্মৃতি আগে উল্লেখ করেছি, কিন্তু বাবার সঙ্গে অন্য ভ্রমণগুলোও বিশেষ ছিল। বাবার কাজের সুবাদে আমরা বিশ্বের নানা দেশ ঘুরেছি। তিনি সব সময় চাইতেন, আমরা নতুন নতুন সংস্কৃতি এবং জীবনধারা সম্পর্কে জানি। সুইডেন থেকে শুরু করে ক্যালিফোর্নিয়া, প্রতিটি ভ্রমণ আমাদের জীবনের মূল্যবান অভিজ্ঞতা ছিল।

বাবার স্নেহময় আচরণ
বাবা সব সময় আমাদের কাছে স্নেহময় এবং বন্ধুর মতো ছিলেন। তাঁর কঠোর শাসনের পেছনে লুকিয়ে ছিল আমাদের প্রতি তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা। আমার জীবনের একটি ঘটনা উল্লেখ করতে চাই যেখানে বাবার সেই স্নেহময় দিকটি প্রকাশিত হয়েছিল।

কীভাবে বাবাকে সম্মান ও ভালোবাসা দেখাব
বাবাকে সম্মান ও ভালোবাসা দেখানো মানে শুধু বিশেষ দিনেই নয় বরং প্রতিদিনই তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা এবং ভালোবাসা প্রকাশ করা। নিচে কিছু উপায় দেওয়া হলো, যেগুলোর মাধ্যমে আমরা বাবাদের প্রতি

সম্মান ও ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি

১. সময় দিন
বাবার সঙ্গে সময় কাটান। ব্যস্ত জীবনের মধ্যে একটু সময় বের করে বাবার সঙ্গে কথা বলুন, তাদের সঙ্গে বসে গল্প করুন, তাদের প্রিয় কাজগুলোতে অংশ নিন। এ সময়টুকু তাদের জীবনে অনেক গুরুত্ব বহন করে।

২. কৃতজ্ঞতা প্রকাশ
ছোট ছোট কাজের মাধ্যমে বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করুন। তাদের করা ছোট ছোট কাজগুলোর জন্য ধন্যবাদ জানান। যেমন রান্নার পরিষেবা বা কোনো কাজের জন্য ধন্যবাদ জানাতে পারেন।

৩. স্বাস্থ্যের খোঁজখবর
বাবার শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য সম্পর্কে খোঁজখবর রাখুন। তাদের প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যপরীক্ষা করানোর ব্যবস্থা করুন এবং সময়মতো ওষুধ খাওয়ার জন্য নজর দিন।

৪. স্মৃতিচারণা
পুরানো স্মৃতিগুলো নিয়ে আলোচনা করুন এবং সেই স্মৃতিগুলোকে নতুন করে জীবিত করুন। একসঙ্গে ফটো অ্যালবাম দেখুন বা পুরানো দিনের গল্প করুন। এটি শুধু বাবাকে আনন্দ দেবে না বরং সম্পর্ককেও আরও গভীর করবে।

৫. সাহায্য ও সমর্থন
বাবাকে তাঁদের কাজকর্মে সাহায্য করুন এবং তাঁদের যেকোনো সমস্যায় পাশে দাঁড়ান। তাঁরা কোনো কাজে সাহায্য চাইলে উৎসাহিতভাবে তাঁদের সাহায্য করুন।

৬. উপহার দিন
বাবাকে তাদের প্রিয় কোনো উপহার দিন। এটি ছোট কিছু হতে পারে যেমন প্রিয় বই, প্রিয় খাবার, অথবা কোনো স্মারক। উপহারের মাধ্যমে আপনি আপনার ভালোবাসা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারেন।

৭. শিখুন এবং অনুসরণ করুন
বাবার শিক্ষা ও আদর্শ অনুসরণ করুন। তারা যেসব মূল্যবোধ এবং নীতি আমাদের শেখান, সেগুলো মেনে চলুন এবং তাদের জীবনধারার অনুসরণ করুন।

৮. বিশেষ দিনে বিশেষ আয়োজন
বাবা দিবস বা জন্মদিনে তাদের জন্য বিশেষ কিছু করুন। যেমন, একটি সারপ্রাইজ পার্টি আয়োজন করতে পারেন, প্রিয় খাবার রান্না করতে পারেন বা একসঙ্গে কোনো সুন্দর স্থানে ভ্রমণ করতে পারেন।

৯. শুনুন
আপনার বাবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনুন। তাঁদের মতামত, পরামর্শ এবং অনুভূতিগুলো গুরুত্ব সহকারে নিন। এটি তাঁদের মনে করাবে যে তাঁরা আপনার কাছে গুরুত্বপূর্ণ এবং আপনার জীবনে তাঁদের স্থান রয়েছে।

১০. ভালোবাসা প্রকাশ
প্রতিদিন বাবাকে ভালোবাসার কথা বলুন। কথায় এবং কাজে তাঁদের প্রতি আপনার ভালোবাসা প্রকাশ করুন। একটি সাধারণ ‘তোমাকে ভালোবাসি, বাবা’ বলাও অনেক বড় ব্যাপার হতে পারে।

১১. দায়িত্ব ভাগ করে নিন
বাবার দায়িত্বগুলো ভাগ করে নিন। বিশেষত যদি আপনার বাবা বয়স্ক হন বা অসুস্থ হন, তবে তাঁদের দৈনন্দিন কাজগুলোতে সাহায্য করুন।

১২. শিক্ষা ও পরামর্শ নিন
বাবার কাছ থেকে শিক্ষা ও পরামর্শ নিন। তাঁরা জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, সেগুলো থেকে শিখুন এবং তাঁদের পরামর্শ মেনে চলার চেষ্টা করুন।

১৩. সহনশীলতা
বাবার মতামত এবং সিদ্ধান্তের প্রতি সহনশীল হোন। তাঁরা যেকোনো ব্যাপারে অভিজ্ঞ এবং তাঁদের মতামতকে সম্মান করা উচিত।

১৪. পরিবারে সম্পর্ক উন্নয়ন
পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গ বাবার সম্পর্ক উন্নয়নে সাহায্য করুন। পরিবারে একতা এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে বাবার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।

১৫. প্রযুক্তিগত সহায়তা
যদি আপনার বাবা প্রযুক্তির সঙ্গে তেমন পরিচিত না হন, তবে তাদের প্রযুক্তিগত সমস্যায় সাহায্য করুন। ফোন, কম্পিউটার বা ইন্টারনেট ব্যবহারে সহায়তা করুন।

সংক্ষিপ্ত প্রতিফলন

আমাদের মা–বাবা আমাদের জীবনের প্রধান রোল মডেল এবং পথপ্রদর্শক। তাঁদের ভালোবাসা এবং ত্যাগের মূল্যায়ন করতে এবং তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাতে আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি।
আজ বাবা দিবসে আমি আমার বাবার প্রতি গভীর শ্রদ্ধা ও কৃতজ্ঞতা জানাই। বাবার প্রতিটি শিক্ষার মর্ম আমি বুঝতে পেরেছি এবং তা আমার জীবনের মূলমন্ত্র হিসেবে গ্রহণ করেছি। বাবা, আপনি আমার জীবনের প্রকৃত রোল মডেল। আপনার মতো হতে পারাই আমার জীবনের সবচেয়ে বড় সাফল্য হবে। আপনার প্রতি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।

প্রতিটি সন্তানের কাছেই তার বাবা পৃথিবীর সেরা। বাবার কাছে আমাদের প্রতি যে ভালোবাসা, যত্ন এবং ত্যাগ থাকে, তা অনন্য ও অমূল্য। যখন আমরা বলি, ‘আমার বাবা বিশ্ব সেরা’, তখন এটি অন্যদের বাবার প্রতি কোনো অবমূল্যায়ন নয়। বরং এটি আমাদের প্রতি বাবার ভালোবাসা এবং যত্নের প্রশংসা।

অন্যান্য বাবাদের অনন্যতা এবং শ্রেষ্ঠত্ব

১. অবিরাম সমর্থন: অনেক বাবা আছেন, যাঁরা দিনের পর দিন কঠোর পরিশ্রম করে যান শুধু তাঁদের সন্তানদের সুখ এবং সাফল্য নিশ্চিত করতে। তাঁদের অবিরাম সমর্থন এবং উৎসাহ সন্তানদের জীবনের পথে এগিয়ে নিতে সাহায্য করে।

২. মানসিক শক্তি: কিছু বাবা আছেন, যাঁরা জীবনের নানা চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে ধৈর্য্য এবং মানসিক শক্তির উদাহরণ স্থাপন করেন। তাঁদের এই গুণাবলি সন্তানদের জীবনের প্রতিটি চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রেরণা জোগায়।

৩. জ্ঞান ও শিক্ষা: কিছু বাবা আছেন, যাঁরা তাঁদের সন্তানদের জীবনের প্রতিটি স্তরে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেন। তাঁদের দেওয়া মূল্যবোধ এবং শিক্ষা সন্তানদের সঠিক পথে চলার নির্দেশনা দেয়।

৪. বন্ধুর মতো আচরণ: অনেক বাবা আছেন, যাঁরা তাঁদের সন্তানদের সঙ্গে বন্ধুর মতো আচরণ করেন। তাঁরা সন্তানদের জীবনের সব সমস্যায় পাশে দাঁড়িয়ে সমাধানের পথ দেখান এবং বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক স্থাপন করেন।

৫. উদারতা ও উদার মন: কিছু বাবা আছেন, যাঁরা তাঁদের উদারতা এবং উদার মনের মাধ্যমে সন্তানদের হৃদয়ে জায়গা করে নেন। তাঁদের উদারতা সন্তানদেরও উদার হতে শেখায়।

৬. নীরব ত্যাগ: কিছু বাবা আছেন, যাঁরা তাঁদের সন্তানের জন্য নীরবে ত্যাগ করেন। তাঁরা নিজের স্বার্থ ত্যাগ করে সন্তানের স্বপ্ন পূরণে সর্বদা প্রস্তুত থাকেন।

সব বাবার প্রতি শ্রদ্ধা

সব বাবাই তাঁদের সন্তানদের কাছে বিশেষ ও সেরা। আমাদের বাবা যেভাবে আমাদের ভালোবাসেন, অন্য বাবারাও তেমনভাবেই তাদের সন্তানদের ভালোবাসেন। সবার ভালোবাসার প্রকাশ ভিন্ন হতে পারে। কিন্তু সবার ভালোবাসা সৎ এবং নিঃস্বার্থ।

নিজের বাবার প্রতি কৃতজ্ঞতা

আমাদের বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ, কারণ, তাঁরা আমাদের জীবনে সবচেয়ে মূল্যবান স্থান ধরে রেখেছেন। আমাদের বাবার ত্যাগ, ভালোবাসা ও যত্নের জন্য কৃতজ্ঞ। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে তাঁরা আমাদের পাশে ছিলেন এবং থাকবেন।

উপসংহার

প্রতিটি বাবা তাঁর নিজের সন্তানের কাছে পৃথিবীর সেরা। তাঁদের ভালোবাসা, ত্যাগ ও সমর্থন আমাদের জীবনের মূল ভিত্তি। আমাদের সব সময় মনে রাখতে হবে, বাবার ভালোবাসা অমূল্য এবং অসীম। তাই প্রতিটি দিন আমরা তাঁদের প্রতি আমাদের ভালোবাসা এবং শ্রদ্ধা প্রকাশ করতে পারি।
শুভ বাবা দিবস!

*লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন।

*দূর পরবাসে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]