বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলোর উন্নয়ন পদ্ধতি আসলে কেমন

ছবি: রয়টার্স

বিশ্বের প্রথম সারির দেশগুলো সব সময় নতুন নতুন পদ্ধতি ব্যবহার করে নাগরিকের জীবনের সার্বিক উন্নতির পরিকল্পনা করে। বিভিন্ন বিষয়ে তারা জরিপ করে কীভাবে দেশকে এবং দেশের মানুষকে সর্বোত্তম সেবা প্রদান করা সম্ভব। এ জরিপ রিপোর্টে স্টকহোমের পৌরসভার শীর্ষে রয়েছে লিডিংও, দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে তাবি এবং তৃতীয় স্থানে নাক্কা। অন্যদিকে ওরে ও ইস্তাদ পৌরসভা তালিকার নিচের দিকে। স্টকহল্ম অঞ্চলের মোট ২৬টি পৌরসভার মধ্যে সবচেয়ে নিচে রয়েছে উপপ্লান্ডসভ্রু, যা সারা দেশের মোট ২৯০ পৌরসভাগুলোর মধ্যে ২০৪তম স্থানে রয়েছে। আমি এই মুহূর্তে উপপ্লান্ডসভ্রু পৌরসভায় বসবাস করছি।

লিডিংও পৌরসভা সুইডেনে সদ্য এই জরিপে শীর্ষস্থান অর্জন করেছে। পুরো ঘটনাটি জানার পর আমার ভাবনায় কিছু প্রশ্ন উঠেছে, যেমন কী পরিবর্তন বা পরিবর্ধন করবে সরকার এবং কবে নাগাদ আমি দেখব যে আমার পৌরসভা তালিকার নিচে থেকে ওপরে উঠতে শুরু করেছে। একই সঙ্গে জানতে ইচ্ছে করছে এ ধরনের জরিপ বাংলাদেশে কখনো করা হয় কি? করা হলে, তারা কী সুইডেনের মতো পদক্ষেপ নেবে বলে মনে হয় ইত্যাদি।

সুইডেন সদ্য এমন একটি জরিপ করেছে, যা সে দেশের জীবনযাত্রার মান নিয়ে। নিচে সেটা তুলে ধরা হলো—
বসবাসের মান নির্ধারণে স্টকহোমের সেরা পৌরসভা লিডিংও; লিডিংও পৌরসভা সুইডেনের মধ্যে বসবাসের জন্য চতুর্থ সেরা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে এবং রাজধানী স্টকহোমে এটি প্রথম স্থানে রয়েছে।

সুইডেনের মিউনিসিপ্যালিটিগুলো বসবাসের মান নির্ধারণের জন্য যে চারটি দিক বিবেচনা করা হয়েছে, তা হলো প্রাইভেট ফাইন্যান্স, নিরাপত্তা, শিক্ষার অ্যাক্সেস, ও স্বাস্থ্যসেবা। এ ছাড়া পরিবেশগত দিকও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

চারটি মূল দিকের বিশ্লেষণ

১. প্রাইভেট ফাইন্যান্স (Private Finance)
  গুরুত্ব: ব্যক্তিগত আর্থিক স্থিতিশীলতা মানুষের জীবনে সুরক্ষা ও মানসিক শান্তি নিশ্চিত করে। এটি মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা, সঞ্চয়, বিনিয়োগ ও ভবিষ্যতের জন্য পরিকল্পনা করার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে।
  প্রতিকার: নাগরিকদের আর্থিক শিক্ষায় প্রশিক্ষিত করা, ট্যাক্স নীতি সহজতর করা এবং বিনিয়োগের সুযোগ বাড়ানো।

২. নিরাপত্তা (Safety)
 গুরুত্ব: মানুষের জীবনে নিরাপত্তা অপরিহার্য। কারণ, এটি মানসিক শান্তি, আস্থা ও সামাজিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করে।
  প্রতিকার: পুলিশ বাহিনীকে শক্তিশালী করা, জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং অপরাধ দমনে কঠোর আইন প্রয়োগ করা।

৩. শিক্ষার অ্যাক্সেস (Access to Education)
  গুরুত্ব: শিক্ষার সুযোগ মানুষের ব্যক্তিগত উন্নতি এবং দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে সহায়ক।
  প্রতিকার: শিক্ষার সুযোগ বাড়ানো, বৃত্তি প্রদান এবং শিক্ষার মান উন্নয়ন।

৪. স্বাস্থ্যসেবা (Healthcare)
  গুরুত্ব: স্বাস্থ্যসেবা মানুষের জীবনের অন্যতম প্রধান প্রয়োজন।
  প্রতিকার: স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র স্থাপন, সবার জন্য স্বাস্থ্যবিমা নিশ্চিত করা এবং চিকিৎসাব্যবস্থার উন্নয়ন।

পরিবেশগত দিকের গুরুত্ব

একটি পরিচ্ছন্ন ও সবুজ পরিবেশ মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য। পরিষ্কার বাতাস, পানীয় জল এবং সবুজ এলাকার প্রাচুর্য নাগরিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নত করে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশে অনেক ক্ষেত্রে হিংসা এবং প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের কারণে সত্যিকারের উন্নতি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। ভালো কাজ করার চেয়ে কে কাকে কত ঠকাবে তার প্রতিযোগিতা বেশি দেখা যায়। তাই বহির্বিশ্বের ভালো দিকগুলো থেকে শিক্ষা নেওয়া এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত জরুরি। সর্বোপরি বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে দুর্নীতি দমন। কিন্তু দমন করবে কে বা কারা? পুরো জাতির মেরুদণ্ডে দুর্নীতি ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এমন একটি সময়ে দুর্নীতিকে হাস্যকরভাবে উপেক্ষা না করে জব্দ করতে সব ধরনের প্রযুক্তিগত টেকনোলজি ব্যবহারসহ কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কোনো রকম আপস যেন না করা হয়, সেদিকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। তা না হলে বাংলাদেশ সময়ের সঙ্গে অন্ধকারে ঢাকা পড়ে যাবে—যা কখনোই কাম্য নয়। কারণ, দেশ স্বাধীন করার আন্দোলনে আমিও ছিলাম সেই জাগ্রত জনতার একজন।

উন্নতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ

নিম্নোক্ত বুলেটিন পয়েন্টগুলো বাংলাদেশের সার্বিক উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ, যেমন
শিক্ষার মান উন্নয়ন: শিক্ষার গুণগত মান বৃদ্ধি করা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনী

চিন্তার প্রসার ঘটানো;

নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ: আইনশৃঙ্খলার উন্নয়ন এবং কমিউনিটি পুলিশিং ব্যবস্থা চালু করা;
অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা: ছোট ও মাঝারি উদ্যোগের জন্য ঋণসুবিধা ও আর্থিক সহায়তা প্রদান;
স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়ন: স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন;
পরিবেশ রক্ষা: পরিবেশের সুরক্ষা ও সংরক্ষণে কঠোর আইন প্রণয়ন এবং বাস্তবায়ন;
সামাজিক সচেতনতা: সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি করা এবং জনগণকে নাগরিক দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করা; বিনিয়োগ আকর্ষণ: বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে বিনিয়োগবান্ধব নীতি প্রণয়ন।

বহির্বিশ্ব থেকে শিক্ষা গ্রহণ

বহির্বিশ্বের ভালো দিকগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং সেগুলো বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশ তার সার্বিক উন্নতি করতে পারে। এ জন্য প্রয়োজন ইতিবাচক মনোভাব এবং সক্রিয় পদক্ষেপ গ্রহণ। প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবের পরিবর্তে সহানুভূতিশীল ও সহযোগিতামূলক মনোভাব গড়ে তোলা জরুরি।

সুইডেনের মতো দেশগুলো থেমে নেই; তারা দেশকে ভালো থেকে আরও ভালো করার ধারাবাহিক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ধরনের উন্নয়ন সব সময় চলমান প্রক্রিয়ার অংশ। বাংলাদেশ যদি এ ধরনের ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে এবং ধারাবাহিক উন্নয়নের পথে এগিয়ে যায়, তবে আমি নিশ্চিত এটি একটি উন্নত ও শান্তিপূর্ণ দেশ হিসেবে বিশ্বদরবারে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবে।

*রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন। [email protected]