সোনালু ফুল নয়, রৌদ্রগন্ধা চিঠি

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

১.

নদীর পাড়ে বটগাছ। পাতার ফাঁক ফোকর দিয়ে পৌষের রোদ নেমেছে মাটিতে। অল্প কিছু পাকা বটফল এখনো রয়ে গেছে। সেই ফল খেতে ঝগড়ায় লিপ্ত হরিয়াল আর কাঠশালিকের দল। দূর থেকে বেলবাটির টুং টাং শব্দ ভেসে আসে। ডাকপিয়ন বেণু সওদাগর সাইকেল চালিয়ে হারিয়ে যায় বটতলার বাঁকে।

তার কাঁধে চিঠির ঝোলা। মনের মধ্যে নানান কথা, ‘৩০ বছর ধরে চিঠি বিলি করলাম। কত মুখ, কত কান্না, কত আশা। কিন্তু...আমার নিজের কথাগুলো কখনো কেউ পড়েনি। অন্যের খবর, আশা, অভিমান, প্রেম...সবই ছিল অন্যের। আমার কিছু ছিল না। আগামী পরশু চাকরিতে শেষ দিন...আর আমার নিজের শুরু।’

অফিসঘরের পুরোনো জানালার খড়খড়ি তুলতেই আলো এসে পড়ে বেণুর মুখে। ৬২ বছরের শুকনো মুখ।

কাঁচা–পাকা চুল। চোখে ক্লান্তির ছাপ।

আলমারির পেছন থেকে একটি পুরোনো, ধুলা জমা বাক্স টেনে বের করে বেণু। বাক্স খুলতেই ভেসে ওঠে কিছু চিঠি। পোস্টকার্ড। যেগুলো বিলি হয়নি কখনো। অনেক পুরোনো। একটার সাল ১৯৯৭।

চায়ের দোকানে তখন আলোচনা বেণুর রিটায়ারমেন্ট নিয়ে। রইস উদ্দিন হাসতে হাসতে বলেন, ‘ভালো সময়েই অবসর নিছেন জেঠা! এখন আর চিঠির দরকার নেই, সবাই হোয়াটসঅ্যাপে প্রেম করে!’

তবারক লাঠি বিস্কুট চুবিয়ে খেতে খেতে হেসে ওঠে।

তবে বেণু সওদাগর এখনো মনে রাখেন কার বাড়িতে কয়টা কুকুর আছে!

বেণু ঘোলা চোখে তবারকের দিকে তাকায়। চশমার কাচে ধুলো জমেছে অনেক। মানুষের মতো চশমাও কি বুড়ো হয়? বেণু বিড়বিড় করে বলে,‘চিঠির কালি শুকিয়ে গেলেও, মানুষের অপেক্ষা শুকোয় না...!’

তবারক হাসে। বুঝে অথবা না বুঝে।

বেণু চুপচাপ চা খায়। রইসের রেডিওতে আবদুল আলীমের গান বাজে।

‘পিঞ্জিরার পাখির মতো

আমি তারে উইরা যাইয়া দেখি

কোথায় গো আমার কালো পাখি।

শিকল কাটিয়া গিয়াছে উড়িয়া গিয়াছে কোন অজানা দেশে

আমারে ভুলিয়া কার প্রেমে মজিয়া

কেবল আমারে বানাইল চির দুঃখী।’

অফিসঘরের পুরোনো জানালার খড়খড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বেণু। তার হাতে এক মায়ের চিঠি। যে চিঠি কখনো বিলি হয়নি। ২৫ বছর আগে লেখা, ‘মেয়ে যদি কষ্ট দেয়, সেই কষ্ট কি ঠিক কাগজে লেখা যায়? তুই চলে যাওয়ার পর প্রতিদিন তোর মুখটাই খুঁজি। ক্ষমা করে দিলাম। দেখতে আসবি মাকে...!’

বেণু সওদাগর চিঠির ব্যাগ কাঁধে নিয়ে সাইকেল চালিয়ে যায়। তার চোখেমুখে অনুতাপ। বেণুর কানে ভাসছে চিঠির কথাগুলো। ঘর পালানো মেয়েকে উদ্দেশ্য করে মায়ের কথাগুলো।

পুরোনো এক বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বেণু। ঘুলঘুলিতে ঝগড়া করে ধূসর চড়ুই। বাতাসে ভেসে বেড়ায় শিমুলের তুলো। বেণু দরজায় কড়া নাড়ে। দরজা খোলে এক বৃদ্ধা নারী। সেই মেয়ে এখন বৃদ্ধা হয়েছে। বেণু চিঠি দিয়ে চুপচাপ চলে যায়। বৃদ্ধা নারী চিঠি খুলে পড়ার পর কাঁদে, ‘মা... তুমি লিখেছিলা? এত বছর কেন আসেনি এই চিঠি। কেন লুকিয়ে রেখেছিল...!’

হাতে হলুদ খাম। বাড়িয়ে দিয়ে বলে, মুকিতের চিঠি। ১১ বছর আগের লেখা। শিউলির ঠোঁট কাঁপে। চিঠি পেয়ে মেয়েটি স্তব্ধ। তার চোখ জলে ভরে যায়।

২.

লাইব্রেরিতে বসে বৃদ্ধ আতাউর চিঠি লেখে। মাথার ওপর কান্নার মতো শব্দ তুলে ঘুরতে থাকে সিলিং ফ্যান,

‘শেষবার তোর মুখ আমি দেখেছিলাম নদীর ধারে, যেদিন তুই আমার বই ছিঁড়ে ছুড়ে ফেলেছিলি।

তুই রাগ করেছিলি, আর আমি অভিমান!’

সিলিং ফ্যানটা ঘুরতেই থাকে। দূরের রাস্তায় হেঁটে যায় হাওয়াই মিঠাইওয়ালা। তার হাতে ঘণ্টা বাজে টুং টুং টুং।

বেণু নদীর পাড়ে বসে থাকে। একটা পানকৌড়ি টুপ করে ডুবে যায় কালো জলে। বেণুর হাতে আতাউরের চিঠি। তার কানে বাজে আতাউরের কথাগুলো, ‘সেদিন রাতেই আমি তোকে মাফ করে দিয়েছিলাম।

তোকে আবার ডাকার সাহস হয়নি, শুধু একবার চেয়েছিলাম তোকে পাশে বসাতে, নীরবে। কোনো অভিযোগ ছাড়াই!’

জলের গভীর থেকে পানকৌড়িটা ওঠে। খালি ঠোঁটেই উড়ে যায় বহুদূর।

আতাউরের পুরোনো বাড়ি। বেণু দাঁড়ানো দরজার সামনে। দরজায় তালা। চারপাশে স্তব্ধতা। তখন এক বৃদ্ধ এসে দাঁড়ায়, ‘তিন মাস হয়ে গেল। আতাউর আর নেই বাবা…। ক্যানসার। চলে গেল একা একা…!’

দূরে কোথাও একটা কাঠঠোকরা ঠক্‌ ঠক্‌ শব্দে কাঠ কাটে। বেণু সওদাগরের কাঁপা হাত চিঠিতে থমকে থাকে। মুখ পাথরের মতো স্থির। সে ধীরে ধীরে খালি বারান্দায় গিয়ে বসে। অযত্নে পড়ে আছে পুরোনো ক্যারমবোর্ড। ধুলোমাখা। এক কোণে রোদ পড়ে আছে নিঃশব্দে। বেণু চিঠিতে চোখ বুলায়। এই প্রথম শেষ লাইনগুলো পড়ে, ‘যদি পারিস, মৃত্যুর আগেই চলে আয়। তোর মুখ দেখে গেলে মনে হবে, জীবনের সবকিছু বৃথা যায়নি।

পুনশ্চ: এই চিঠির কাগজে হয়তো তোর স্পর্শ পড়বে না কখনো...

রাগ যে অনেকটা শীতের কুয়াশার মতো, দূরত্ব ঢাকা দেয়, ছোঁয়ার আগেই মিলিয়ে যায়। তবু কিছু শব্দ রেখে গেলাম বাতাসে ভাসিয়ে—যদি কোনো একলা বিকেলে তুই হঠাৎ কান পেতে শুনিস আমার নীরবতা!’

বেণুর চোখ জলে ভরে। একা একাই কথা বলে মৃত বন্ধুর সাথে, ‘তুই মাফ করেছিলি…কিন্তু আমি করিনি,বন্ধু। তোকে না বলেই আমি অনেক দূরে চলে গিয়েছিলাম। আর আজ এলাম…যখন তুই আর ডাকতে পারিস না।’

খামওয়ালাদের কান্না বলে কিছু নেই জেনেও চোখ মোছে বেণু। উঠে দাঁড়ায় ক্যারমবোর্ডের কাছে। ওপরে একটি সাদা ঘুঁটি রাখে, যেন অনেক অনুচ্চারিত কথা রেখে গেল বন্ধুর জন্য, ‘আজ খেলি না বন্ধু…হেরে গেছি আগেই!’

৩.

জলপাইগাছের নিচে আলপনা এঁকেছে বিকেলের মরা রোদ। সেখানেই শিউলির ঘর। সেই ঘরে থাকতে চেয়েছিল মুকিত নামের বোকা ছেলেটি। এখন সেখানে থাকে শিউলি আর তার পুরোনো সেলাই মেশিন। সেলাই মেশিনের শব্দ ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। কাজ করে শিউলি। তার সামনে এসে দাঁড়ায় বেণু। হাতে হলুদ খাম। বাড়িয়ে দিয়ে বলে, মুকিতের চিঠি। ১১ বছর আগের লেখা।

শিউলির ঠোঁট কাঁপে। চিঠি পেয়ে মেয়েটি স্তব্ধ। তার চোখ জলে ভরে যায়।

মেঠো পথ ধরে সাইকেল চালিয়ে যায় বেণু। তার কানে বাজে আত্মহত্যা করার আগে মুকিতের লেখা শেষ চিঠির কথাগুলো, ‘তুমি বলেছিলে, আমার জন্য তুমি জীবন দেবেও না, নেবেও না। আমি রাখলাম কথা। শুধু চলে যাচ্ছি, চিরতরে...ভালো থেকো, শিউলি।’

বটগাছের নিচ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে চলে যায় বেণু। তার চোখের সামনে ভাসতে থাকে সেই দৃশ্য, যেখানে গামছা দিয়ে ফাঁস লাগিয়ে ঝুল ছিল মুকিতের দেহ। পা দুটো তখনো দুলছিল। যেমন দোল খায় সোনালু ফুল, জ্যৈষ্ঠের গোপন দুপুরে!

শিউলি চোখ ভেজায়। চিঠিটা নাকের কাছে এনে ঘ্রান নেয়, ‘ও মরে যায়নি… মরেছিল এই চিঠিটা। সময়মতো এলে…হয়তো বাঁচত ও।’

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

৪.

বেণুর ঘর। কাঠের টেবিলের ওপর ফ্রেমে বাঁধা মানুর ছবি। কলেজ ড্রেসে হাসিমুখে মানু। বেণুর হাতে একটা হলুদ খাম। সে খামের দিকে তাকিয়ে থাকে।

‘এ চিঠি আমি কাকে দেব? আমার নিজের ছেলেকে? সে তো গেছে...চলে গেছে রাগ নিয়ে,অভিমান নিয়ে। আমি তো কখনো বলিনি তাকে...আমি ভালোবাসি তোকে। বিয়ে আমি করেছিলাম, তবে সংসারী হওয়ার জন্য নয়। সমাজে একজন ধর্ষিতা নারীকে সম্মান দিতে।’

চিঠিতে হয়তো সেই কথাটুকুই লেখা ছিল। টেবিলে হলুদ চিঠির খামটা রাখে বেণু। খামের ওপর স্পষ্ট পোস্ট অফিসের সিল দেওয়া তারিখ। ডাকটিকিট। চিঠিটা সে লিখেছিল ৯ বছর আগে। কিন্তু ছেলেকে কখনো পোস্ট করা হয়নি সেই চিঠি।

ডাকপিয়ন বেণু সওদাগর এবার সিদ্ধান্ত নেয়, চাকরির শেষ দিনে শেষ চিঠিটা নিজের হাতেই বিলি করবে তার একমাত্র পুত্র মানু সওদাগরের হাতে। বেণু মোটা ফ্রেমের চশমাটা পরে। জানালার বাইরে ঝুলে থাকে আতাফলগাছের ডাল। অন্ধকারে মিটিমিটি জ্বলে কিছু জোনাকি। দূর থেকে ভেসে আসে শিয়ালের ডাক, বেণুর কাছে কান্না বলে মনে হয়।

ট্রেনটা ছুটে চলে পাহাড়ের গা ঘেসে। বেণু জানালার ধারে বসা। একে একে পেছনে চলে যায় চা–বাগান, সাঁওতালের দল, লাল ইটের ব্রিজ। পেছনে চলে যায় ডাকপিয়ন বেণু সওদাগরের স্মৃতিও।

৯ বছর আগের বেণুর ঘর। কাঠের টেবিলের ওপর ফ্রেমে বাঁধা মানুর ছবি। টেবিলে মিটমিট করে জ্বলে হারিকেন। বেণু ছেলের কাছে চিঠি লেখে।

‘মানু, আমি জানি, আমি কখনো তোকে “ভালোবাসি” বলিনি।

আমি জানি, মাকে হারানোর পর তুই আমায় দোষ দিয়েছিলি। মানতে পারিসনি মায়ের জায়গায় অন্য একজনকে। জানিস, সেই অন্য একজনও তোর মায়ের মতো হারিয়ে গেছে। তুই জানিস না কত কিছু! না জেনেই আর কোনো দিন বাবার কাছে ফিরে আসিসনি। আমি তোর খেলার মাঠে গিয়েছিলাম চুপিচুপি…। আমি তোকে দেখতে গিয়েছিলাম মেডিকেলের ভর্তি পরীক্ষায়…আমি তোকে ভালোবাসি, রে। তুই হয়তো শুনতে পাবি না, তবু বলছি—তুই আমার ছেলে, আমি তোকে ভালোবাসি।’

ছেলের বাসার দরজায় গিয়ে দাঁড়ায় ডাকপিয়ন বেণু। দরজা খোলে মানু। এখন ৩৮ বছরের ডাক্তার। দুজনই দীর্ঘ সময় চুপ। বেণু শুধু খামটা এগিয়ে দিয়ে বলে, ‘এটা…পৌঁছে দিতে পারিনি সময়মতো।’

ছেলের হাতে হলুদ খামটা দিয়ে চলে যায় বেণু। মানু চিঠির খামটার দিকে তাকায়। পোস্ট অফিসের সিল আর তারিখটা ৯ বছর আগের। ধীরে ধীরে চিঠিটা পড়ে মানু। কিছুক্ষণের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। চোখে জল জমে।

ডাকপিয়ন বেণু তখন কুঁজো হয়ে হাঁটে। সরকারি কোয়ার্টারের বাঁকা গলিতে মিলিয়ে যাচ্ছিল সে। মানু দৌড়ে রাস্তায় নামে। চিৎকার করে বাবাকে ডাকে, ‘বাবা!’

বেণুর পা থেমে যায়। পেছনে তাকালে ঘোলা চোখে মানুকে দেখে। দূরে দাঁড়ানো। কাছে আসে মানু। বাবার বুকের কাছে দাঁড়ায়, গলা কাঁপে, ‘তুমি তো কোনো দিন বলোনি...বাবা…!’

বেণু মাথা নিচু করে। দূরে কোথাও ট্রেনের হুইসেল বাজে, ‘আমি চিঠি বিলি করতাম। কিন্তু নিজের কথাগুলো কখনো পৌঁছে দিতে পারিনি...।’

মানু এগিয়ে এসে বাবাকে জড়িয়ে ধরে। দুজনের চোখেই জল। দূর থেকে গানের কথা ভেসে আসে। গাইছে অন্ধ কোনো ভিখারী, ‘যদি গো পাইতাম হৃদয়ে বসাইতাম, শুনিতাম মধুরও বুলি... ’

গোধূলির আলোয় গ্রাম ডুবে যায় বিষণ্নতায়। দারুচিনিগাছের পাতা ওড়ে বাতাসে। হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে দূরের পাহাড়ে–নদীতে! এক কুঁজো বৃদ্ধ ডাকপিয়ন হাঁটতে থাকে ধীর পায়ে।

সব চিঠি সময়মতো পৌঁছে না।

তবু একদিন পৌঁছালে তার ওজন থাকে। চিঠির ওজন…

অনুভবের ওজন…

*লেখক: হিমু আকরাম, নাট্যপরিচালক, যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]