ভাষা দিবস ও সরকারি কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহারে কোথায় আমরা
ভাষা প্রথম বচন শিক্ষাগুরু, অভিব্যক্তি প্রকাশের শক্তি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিচর্চার প্রাণভোমরা, আপসহীন মর্যাদার লড়াই চালানোর প্রাণশক্তি। ভাষা পৃথিবীর সর্বাধিক কথিত হোক অথবা না-ই হোক, কবির ভাষায় গর্ব করার হাতিয়ার। বাংলার মুখ, নাটোরের বনলতা সেন শোভা বর্ধন করে বাংলা সাহিত্যকে।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, সাহিত্যের সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ও তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ত্রয়ী কথাসাহিত্যিক বাংলা ভাষায় প্রকৃতিকে বাচনশক্তি, চরিত্রের অব্যক্ত বক্তব্য পেশ করেছেন বাংলা ভাষার প্রকাশগুণে। মধুসূদন দত্তের ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ বাংলা ভাষার মধুর ছন্দের বোধনে সৃষ্ট।
সত্যজিৎ রায়ের ‘অপুর সংসার’ বাংলা ভাষায় চলচ্চিত্রায়িত, দুনিয়া কাঁপানো খ্যাতির জন্য আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হন। মৃণাল সেনের ‘তাহাদের কথা’ জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র বাংলা ভাষায় পরিচালিত ও প্রযোজিত। ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’, তপন সিংহের ‘সাগিন মাহাতো’, বিমল কর—সবাই বাংলা সিনেমা তথা ভারতীয় সিনেমার পথিকৃৎ।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায় ও নিমাই ভট্টাচার্য বর্তমান যুগের বাঙালি ও বাংলা ভাষার দিকপাল কলমবাজ। বাংলা ভাষায় তাঁদের সাহিত্যচর্চা ভাষার সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করেছে। এ ছাড়া ওপার বাংলার বহু সাহিত্যিকের বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা এ ভাষাকে সম্মানিত করেছে।
বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন, পুলিশের গুলিতে জীবনদান বিশ্বের দ্বিতীয় কোথাও হয়েছে, এমন উদাহরণ বিরল। ভাষা নিয়ে আবেগঘন আন্দোলনের ঢেউ বাংলা ভাষার জন্য হতে পারে জ্বলন্ত প্রমাণ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন। সালাম, রফিক, জব্বারসহ বেশ কিছু আন্দোলনকারী পুলিশের গুলিতে শহীদ হন। ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ভাষার স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ১৯৯৯ সালে জাতিসংঘ ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক ভাষা দিবসের স্বীকৃতি দেয়।
বাংলা ভাষা সরকারি কাজে ব্যবহার দুর্লভ, ব্রাত্য ও স্বীকৃতিহীন হয়ে রয়েছে। সরকারি কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহার বা প্রচলন নেই বললে চলে। পশ্চিম বাংলায় কথ্য ভাষা হলেও অনীহা লক্ষ করা যায় সরকারি কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহারে। বিদেশি ভাষার সরকারি কাজে ব্যবহার প্রীতি ও স্তাবকতা থেকে বাংলা ভাষার প্রতি অনাদর।
শুধু তা-ই নয়, সরকারি নির্দেশ, আদেশ, চিঠি আদান-প্রদানে বাংলা ভাষার চেয়ে প্রাধান্য দেওয়া হয় ইংরেজিকেই। ইংরেজি ভাষার কৌলীন্য স্বীকার করে নিয়ে স্বাধীনতা-পরবর্তী আবহমান কাল ধরে বাংলা ভাষার ব্যবহারে অবহেলা চলে এসেছে, চলছে। বাংলা ভাষা সরকারি কাজে দুয়োরানির ভূমিকায় অবতীর্ণ। ইংরেজ শাসনের অবসান ঘটেছে আজ ৭০ বছর অতিক্রান্ত, তবু আমরা ‘ওগো বধূ সুন্দরীর’ গানের ভাষায় বলি ‘লেজটাকে ধরে আছি এখনো’।
আমরা ‘ভাষা দিবস’ উদ্যাপন করি, অথচ সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিয়ে আমরা উদাসীন। বাংলা ভাষার মহতব নিয়ে মধুসূদন দত্ত গর্ব প্রকাশ করেছিলেন ‘আ-মরি বাংলা ভাষা’ বলে। সরকারি কাজে বাংলা ভাষার ব্যবহারে আমরা হোঁচট খাই, মুখ ঘুরিয়ে থাকি। এ ভাষার ব্যবহার নিয়ে উদাসীনতার জেরে দূরত্ব বজায় রাখাই দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভাষা দিবস উদ্যাপনে আমরা পিছপা নই, ভাষার ব্যবহারে শুধু অনাদর, অনীহা প্রকাশ করি মাত্র, সচেতনতার অভাব কিঞ্চিৎ বেদনাদায়ক।
সরকারি কাজে বাংলা ভাষার প্রয়োগকে রাশভারী; মাধ্যম হিসেবে খটমট, শব্দবন্ধনীর ব্যবহার দুর্বোধ্য, অক্ষয় কুমার দত্তের ভাষায় বদখত। সরকারি কাজের ধারাবাহিকতায় নজরে পড়ে, ইংরেজি ভাষা ব্যবহারে সাবলীল ও আন্তরিকতা দেখা গেলেও বাংলা ভাষার ব্যবহারে অনীহামিশ্রিত জড়তা থেকেই যায়। এই ভাষা সরকারি ক্ষেত্রে কাজে লাগানোর মধ্যে তাচ্ছিল্য দেখা যায়। এমনকি এ ভাষাকে সরকারি কাজে একঘরে করে রাখার পরোক্ষ প্রবণতাও দেখা যায়।
‘গেঁয়ো যোগী ভিখ পায় না’—বাংলা ভাষাকে সরকারি ক্ষেত্রে প্রয়োগে সেই প্রবণতাই প্রকট হয়ে ওঠে। মোট ২১৫ লাখ বাংলাভাষী আছেন পৃথিবীতে। সরকারি ভাষা হিসেবে বাংলাদেশ ও ভারতে (পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরা) প্রচলিত। আভিজাত্যে বাংলার চেয়ে ইংরেজি অনেক এগিয়ে থাকলেও মনে রাখতে হবে, প্রথম ‘মা’ ডাক এ ভাষাতেই সূচনা ঘটে আমাদের মুখে।
এই ভাষায় চর্চা করেছেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, জগদীশচন্দ্র বসু, প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশ প্রমুখ। বাংলা ভাষার এমন মহিমায় ভীত হয়েছিলেন ইংরেজ শাসকেরা, তাই শরৎচন্দ্রের ‘পথের দাবী’ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন। বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অক্ষয় কুমার দত্ত, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ সাহিত্যিক এবং সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, জীবনানন্দ দাশ, মধুসূদন দত্ত প্রভৃতি কবি এই ভাষাতেই কবিতা রচনা করেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ ভাষাতেই বিশ্বকবি হয়েছেন। এই ভাষাতেই তিনি বিখ্যাত হয়েছেন সাহিত্যের সব ক্ষেত্রে। রাশিয়া থেকে ইতালি—সব দেশে তাঁর খ্যাতির শীর্ষে থেকে বিশ্ব পরিব্রাজক হয়েছিলেন। জগদীশচন্দ্র বসু এই ভাষার সন্তান হিসেবে রেডিও এবং গাছের প্রাণ আবিষ্কারের কৃতিত্ব অর্জন করেছিলেন। সত্যেন্দ্রনাথ বসু আইনস্টাইনের তত্ত্বের ব্যাখ্যা করেছিলেন এই ভাষার সন্তান হয়ে।
*লেখক: রথীন কুমার চন্দ, চন্দননগর, হুগলি, ভারত
**দূর পরবাসে লেখা, ভ্রমণ, গল্প পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]