সৌরজগতের সেলিব্রেটি গ্রহ
আজ লিখবো সৌরজগতের সেলিব্রেটি গ্রহ প্লুটো নিয়ে। কেন সেলিব্রেটি বলছি? আপনি সৌরজগতের অন্য কোনো গ্রহের নাম মনে রাখতে পারেন আর না পারেন, প্লুটোর নাম আপনার মনে থাকবেই। আর একমাত্র সেলিব্রেটিদের নামই মানুষ সব সময় মনে রাখতে পারে।
২. যদিও প্লুটো ক্যাসিক্যাল গ্রহ না—এটাকে বামন গ্রহ বলা হয়। সোজা বাংলায় যদি বলি, সৌরজগতের কোনো বস্তুকে ক্যাসিক্যাল গ্রহ হতে হলে ওই বস্তু যে কক্ষপথে সূর্যের চারদিকে ঘুরবে সেখানে ঐ গ্রহটি প্রধান বস্তু হিসাবে থাকবে এবং তার গ্রাভিটেশনার টান দিয়ে তার কক্ষপথও পরিষ্কার করে যাবে। প্লুটো সৌরজগতের যে জায়গায় আছে, তাকে কাইপার বেল্ট বলে, যা নেপচুন গ্রহের কক্ষপথের বাইরে অবস্থিত। আর তাই নেপচুন গ্রহের বাইরে কাইপার বেল্টে সৌরজগতের যত বস্তু আছে সেগুলোকে টান্স-নেপচুনিয়ান বা কাইপার বেল্ট অবজেক্ট বলে। এ কাইপার বেল্টে প্লুটোর মতো আরও অনেক বস্তু আছে এবং প্লুটো প্রধান বস্তু নয়। তাই এটি ক্যাসিক্যাল গ্রহ তালিকা থেকে বাদ পড়েছে ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিক জ্যোতির্বিদ ইউনিয়নের (আইএইউ) সম্মতিক্রমে। তবে, তার বাদ দেওয়ার পরেও প্লুটো গ্রহ-বিজ্ঞানীদের এবং মহাকাশ–প্রেমীদের জন্য একটি আকর্ষণময় এবং রহস্যময় বস্তু হয়ে আছে।
৩. ১৯৩০ সালে ক্লাইড টমবাহ প্লুটো আবিষ্কার করার পর থেকে মানুষের মধ্যে এটি সৌরজগতের নবম গ্রহ হিসেবে পরিচিত ছিল। সূর্য থেকে এর গড় দূরত্ব প্রায় ৬০০ কোটি কিলোমিটার। আর তাই সূর্যকে একবার প্রদক্ষিণ করতে এর সময় লাগে ২৪৮ বছর। তার মানে প্লুটো আবিষ্কারের পর থেকে এখনো এটি সূর্যকে একবার ও ঘুরে আসতে পারে নাই। তবে প্লুটো প্রতি ৬.৩৯ দিনে তার নিজ অক্ষে একবার ঘোরে। তার মানে প্লুটোতে পৃথিবীর ৬.৩৯ দিনে একদিন হয়। এর ব্যাস প্রায় ২৩৭৭ কিলোমিটার যা পৃথিবীর চাঁদের আকারের প্রায় এক-পঞ্চমাংশ। প্লুটোর পৃষ্ঠ নাইট্রোজেন, মিথেন এবং কার্বন মনোক্সাইড বরফের মিশ্রণে গঠিত। সঙ্গে কিছু পানির বরফও আছে, তবে বেশিরভাগই পৃষ্ঠের নিচে। সূর্য থেকে প্লুটোর এই বিশাল দূরত্বের অর্থ হল প্লুটো একটি খুব ঠান্ডা জায়গা। যেখানে গড় তাপমাত্রা-২২৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস (-৩৮০ ডিগ্রি ফারেনহাইট)।
৪. ২০১৫ সালে নাসার নিউ হরাইজন্স নভোযান দ্বারা তোলা প্লুটোর ছবি দেখে পুরা বিশ্বের চোখ চরকগাছ হয়ে গেছিল। বিশ্বাস না হলে এখানে দেওয়া ছবিটি দেখুন। কি নাই প্লুটোতে? পাহাড়পবর্ত, আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুত্পাত সবই আছে—খালি বরফের আর কি! প্লুটোর ছোট হলে কি হবে, এটির বায়ুমণ্ডলও রয়েছে, যা মূলত নাইট্রোজেন আর মিথেন গ্যাস দিয়ে গঠিত। এমনকি প্লুটো পৃষ্ঠের নিচে পানির এক বিশাল সমুদ্রও আছে বলে ধারণা করা হয়। আর এই জন্যই প্লুটোতে প্রাণের সম্ভাবনা থাকতে পারে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করেন।
৫. যদিও নিজেই ক্যাসিক্যাল গ্রহ না, তারপরও এটির পাঁচটি উপগ্রহ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় শ্যারন, আরও দুটো তুলনামূলক ছোট উপগ্রহ হলো নিক্স ও হাইড্রা! মজার ব্যাপার হচ্ছে শ্যারন প্লুটোর চেয়ে তুলনামুলকভাবে উপগ্রহ হিসাবে এত বড় যে আমাদের চাঁদ যেমন পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে, শ্যারন প্লুটোর চারদিকে এভাবে ঘোরে না। বরং প্লুটো আর শ্যারন দুটোই একটি বিন্দুর চারপাশে আবর্তিত হয়। আর তাই এটাকে প্লুটো-শ্যারন সিস্টেম বলে। আরও মজার ব্যাপার হচ্ছে আমাদের চাঁদ যেমন পৃথিবীর সাথে ‘টাইডাল্লি লকড’, ফলে আমরা আমাদের চাঁদকে শুধু একপাশ দেখি। প্লুটো আর শ্যারন দুটোই একটা আর একটার সাপেক্ষে ‘টাইডাল্লি লকড’, ফলে আপনি প্লুটো থেকে শ্যারনকে যেমন খালি একপাশ দেখবেন, শ্যারন থেকে প্লুটোকে দেখলেও একপাশ দেখবেন। শ্যারন নিজেই এতো আকর্ষণময় যে একে নিয়ে আলাদা করে পরে আর এক কিস্তিতে লিখব।
৬. আপনি যদি প্লুটো ছবিটি দেখেন, তাহলে ভালোবাসা চিহ্নের যে বাঁ অংশটি দেখবেন, তার নাম স্পুটনিক প্লানিসিয়া। আর পাশের দিকে দেখবেন মেরুন রঙের যে অংশটি দেখছেন তাকে বলা হয় কোথোলো ম্যাকুলা। স্পুটনিক প্লানিসিয়ার বাঁ দিকে কোথোলো ম্যাকুলার মধ্যে কিছু খালের মত লম্বা খাদ/পরিখা আছে। ধারণা করা হয় এ খাদের মধ্যে দিয়ে অগ্ন্যুত্পাত হয়েছে, যা প্লুটো পৃষ্ঠের নিচ থেকে জলীয় পানি আর অ্যামোনিয়া উপাদান নিয়ে এসেছে। মজার ব্যাপার হলো স্পুটনিক প্লানিসিয়ার ডান দিকে এমন লম্বা খাদ/পরিখা দেখা যায় না, যা জলীয় পানি আর অ্যামোনিয়া উপাদান নিয়ে আসে। কিন্তু সাম্প্রতিক কালে আমি এবং আমার কিছু কলিগ মিলে একটা গবেষণা করছি যেখানে আমার স্পুটনিক প্লানিসিয়ার ডান দিকে জলীয় পানি আর অ্যামোনিয়া উপাদান পেয়েছি। এই উপাধানগুলো কোনো খাদ/পরিখার মাধ্যমে আসে নি! বরং এই উপাদানগুলো ছোট্ট একটা আগ্নেয়গিরির ক্যালডেরার মাধ্যমে আসছে। আমাদের গবেষণাটি একটি জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটি ফলে প্লুটো নিয়ে আরও একটি অজানা ব্যাপার জানা গেছে।
৭. সবশেষে, প্লুটো এবং কাইপার বেল্টের বস্তুগুলোর অধ্যয়ন আমদেরকে সৌরজগতের প্রাথমিক ইতিহাস সম্পর্ককে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ধারণা প্রদান করবে। অনেক বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করেন যে কাইপার বেল্টে প্লুটো এবং অন্যান্য বস্তুগুলো হলো সৌরজগতের মূল কাঠামো তৈরির অবশিষ্টাংশ। ফলে এ বস্তুগুলো অধ্যয়ন করলে আমাদের সৌরজগত কীভাবে তৈরি হয়েছিল এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বিবর্তিত হয়েছিল, তা আরও ভালোভাবে বুঝতে সাহায্য করতে পারে।
*লেখক: আল ইমরান, পিএইচডি, নাসা জেট প্রপালশন ল্যাবরেটরি, যুক্তরাষ্ট্র