সোশ্যাল পুলিশিং ও আমরা

সোশ্যাল পুলিশিং বলে একটা শব্দ আছে, যা পৃথিবীর অন্য দেশে ভিন্নভাবে ব্যবহৃত হলেও বাংলাদেশে ব্যবহারটা অন্য রকম। সমাজে ব্যক্তির হাঁড়ির খবর, নাড়ি-নক্ষত্র অবধি তাদের জানা। ব্যক্তির পোশাক-আশাক, সাজসজ্জা, চলন-বলন, আহার-বিহার অবধি নির্দ্বিধায় গড়িয়ে যায় নৈতিকতার দোহাই দিয়ে। তাঁর প্রতিবাদ-প্রতিকার তো দূরে থাক, উদ্দিষ্ট ব্যক্তি কিংবা জনগোষ্ঠীকে এই পুলিশিংয়ের চাপে চিড়েচ্যাপটা হয়ে যেতে হয় হরহামেশাই। মাথা নিচু করে ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে হয়।

প্রতিবছর রমজান শুরু হলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেববুকে অনেকের আচরণ দেখে বোঝাই মুশকিল যে আমি কোন দেশে আছি। ইফতারির ছবি, সাহরির ছবি দিয়ে রমজান মোবারক, সাহরি মোবারক বলে এমন জিকির তুলতে শুরু করেন, যাতে অন্যদের মনে হতে পারে, তাঁরা নিশ্চয়ই অপরাধ করছেন। এটাও পরোক্ষভাবে সোশ্যাল পুলিশিং। প্রশ্ন হচ্ছে, আপনার রোজা আপনি রাখুন, যত খুশি ইবাদত করুন, ফেসবুকে আপনার সেই ইবাদত বন্দেগির প্রচার করায় কি সওয়াব বেড়ে যাবে? যখন ফেসবুক ছিল না আমাদের জীবনে, তখন আপনারা আর সাহরি খাননি? ইফতার করেননি? নাকি সেসব আল্লাহর দরবারে কবুল হতো না?

এবার একটু প্রবাসী বাংলাদেশিদের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। কোরবানির ঈদ এল। আবারও আপনার মুখটা চুন চুন করে নিভৃতে থাকার পালা। আপনার কমিউনিটি আপনাকে আবার প্রশ্নবাণে ঘায়েল করতে উদ্যত, ‘এই ভাবি, আপনারা কোরবানি দিচ্ছেন না?’ আপনি আমতা আমতা করে কী বলবেন, সেই যুক্তি-বুদ্ধি আঁটছেন। ভাবি সগৌরব আপনাকে ভাষণ দিয়েই যাবেন, ‘শোনেন ভাবি, এই দ্যাশে থাইক্যা ছেলেমেয়ে তো ইসলামিক কালচার কিছুই শিখছে না, আমাদের কালচারও শিখছে না। তাই কোরবানি দিচ্ছি প্রতিবছর। না হলে জানবে কী করে?’ এই গল্পবাজ ভাবি জানেনই না, আদতে কোরবানির মাহাত্ম্য কী? কোন উদ্দেশ্যে কোরবানির বিধান নাজিল হয়েছিল।

আপনি মুদির বাজার করবেন, আপনার প্রতিবেশিনী বারবার হলফ করে আপনাকে বলবেন, ‘ভাবি, চায়নিজ স্টোরে যাবেন না, ওখানে হালাল মাংস পাওয়া যায় না। ছি! ছি! দেশ ছেড়েছি ছেলেমেয়ের ভবিষ্যতের কথা ভেবে। তাই বলে হালাল- হারাম মানব না?’ এরপর আপনি যখন কিছুই শোনেননি ভাব করে কাঁকড়া কিনতে যাবেন, তখন তো ছ্যা ছ্যা করে আপনার চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করবে, ‘ও তো হিন্দুরা খায়, ভাবি আপনিও!’ এভাবে সোশ্যাল পুলিশিংয়ের চাপে পড়ে আপনার জীবনের সুখ-শান্তি যারপরনাই হারাম হয়ে যাবে। তবু এসব আপনাকে সহ্য করে যেতেই হবে। কারণ, যুগে যুগে তারাই ইসলাম রক্ষার একমাত্র সোল এজেন্ট!

আপনারা শুনে আশ্চর্য হবেন না। এসব ব্যক্তির অনেককেই আমি জানি, যাঁরা ইহুদিদের দেশে এসে হারাম কামাই (তথ্য গোপন করে কিংবা ভুয়া তথ্য দিয়ে সরকারি সুবিধাদি গ্রহণ) করে হালাল মাংসের দোকানে লম্বা লাইনে দাঁড়ান। যাঁরা কালচারের নামে বাংলায় কথা বলাকে প্রেসটিজ কনসার্ন বলে ভাবেন, যাঁদের কালচারাল আইডেন্টিটিতে মদ্যপানকে জাতে ওঠার অনুষঙ্গ ভাবেন, মিথ্যে অজুহাতে সরকারি বাড়ি ভোগ করেন বছরের পর বছর, যাঁরা মেয়াদোত্তীর্ণ খাবারের প্যাকেটে নতুন তারিখের মোড়ক লাগান পরম যত্নে, যারা ট্যাক্স ফাঁকি দিতে বিবাহবিচ্ছেদের নাটকও করেন, যারা ডলার জমিয়ে দেশে গুলশান–উত্তরা-বারিধারায় ফ্ল্যাট কেনেন।

দেশেও রয়েছে এদের এক নম্বর খাঁটি ব্র্যান্ড! বিশ্বাস করুন, এরাই রমজানে বেগুনের কিলোগ্রাম ২০০ টাকা করে হালাল ব্যবসা করেন। এরাই সারা বছর খাদ্যে ফরমালিন মিশিয়ে মানুষের সেবা করেন। এরাই ঈদে ১০ লাখ টাকায় লেহেঙ্গা বিক্রি করেন। এরাই কোরবানির আগে নতুন ফ্রিজ কেনেন। এদের বাসায়ই গৃহপরিচারিকারা খুন্তির ছ্যাঁকা খায় কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়। এদের হাতেই বালিশের মূল্য সাত হাজার টাকা অবধি গড়ায়। এরাই জনগণ ও সরকারি সম্পদ লুটেপুটে খেয়ে নিজে সম্পদের পাহাড় গড়েন।

এরা আর কেউ নয়, আমারই স্বজাতি! বাংলাদেশের জ্ঞাতি! যারা ইসলাম রক্ষায় সদা জাগ্রত। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো, ইসলামের মূল বার্তা থেকে তাদের অবস্থান অনেক অনেক নটিক্যাল মাইল দূরে। তারা খেজুর খেয়ে ইফতার করাকে সওয়াব মনে করে, অথচ পরনিন্দা আর পরচর্চায় অতি উৎসাহ বোধ করে। যাদের আপনি প্রতিবেশীর কোনো বিপদে পাবেন না। দুঃস্থদের কল্যাণে বা সামাজিক কোনো কর্মকাণ্ডে পাবেন না। উত্তরাধিকারী কিংবা নিকট আত্মীয়ের হক বঞ্চিত হয় তাদের কাছে।

অতীব দুঃখের সঙ্গে এই দ্বিধাহীন সত্যকে উচ্চারণ করছি, ইসলামের মূল সুর থেকে ইসলামকে খুলে নিয়ে একটা কৃত্রিম খোলসের আবরণে পুরে ফেলেছেন যাঁরা, তাঁরাই প্রকৃত অর্থে ইসলামের শত্রু। আপনি যদি ধর্মের মূল বার্তা আমলে না নিতে পারেন, তাতে মানুষের যত না ক্ষতি হয়, তাঁর চেয়ে অধিক নিন্দনীয় হয়, সেই ধর্ম বৃহৎ সমাজের দৃষ্টিতে।

বর্তমান বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে ছয় কোটি লোক ফেসবুক ব্যবহার করে থাকেন। এই বিপুল জনগোষ্ঠীর হাতে এখন এই ফেসবুক শো অফের এক গুরুত্বপূর্ণ বাজার। এখানে অনেক কিছুই হচ্ছে। নানা কথা বলা হচ্ছে। একজনের এমন আহ্বান শুনিনি, ভাইয়েরা চলুন, রমজানে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি না করে সবাইকে সুন্দরভাবে রোজা পালনে সাহায্য করি। সবাই মিলে চলুন রুখে দাঁড়াই সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে। অনেকেই বলেননি, ঈদের কেনাকাটায় বাজেট কমিয়ে দুস্থদের কল্যাণে কিছু ব্যয় করি (অনেকেই অবশ্য বলেন এবং করেন, তবে সংখ্যায় কম)। একজনও বলেননি, খাদ্যে ফরমালিন বিষ না মিশিয়ে এই একটা মাস অন্তত মানুষের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে সৎ ব্যবসা করি। একজনও কেউ বলেননি, এই একটি মাস অন্তত আমরা ঘুষ ছাড়াই ফাইলগুলো টেবিল থেকে নড়িয়ে দিই। কেউ এ কথাও বলেননি যে আমার রোজগারের প্রদেয় সব ট্যাক্স এ বছর পরিশোধ করব।

সাড়ে ছয় কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর মধ্যে এত এত ধার্মিক রয়েছেন যাঁদের হাদিস, ওয়াজ নসিহতে অনেক মূল্যবান কথা থাকে। যেমন মহানবী (সা.) খেজুর দিয়ে ইফতার করতেন, আসুন আমরা সৌদির খেজুর দিয়ে ইফতার করি।

ধর্মবিশ্বাসের বলে মানুষ আত্মার সঙ্গে সরাসরি যোগসূত্র স্থাপন করতে পারে। এই যোগাযোগের ফলে ব্যক্তির সঙ্গে স্রষ্টার প্রেম হয়। সেই প্রেমে ভয়-ভীতি নয়, ভালোবাসাই স্থায়ী বন্ধনের একমাত্র পথ বলে প্রতীয়মান হয়। ফলে, ব্যক্তির অন্তকরণ শুদ্ধ হয়, কালিমামুক্ত হয়। প্রকৃত ধার্মিক ব্যক্তি সৎ স্বভাবী, কোমল ও সহজ মানুষ হয়ে ওঠেন। তাঁদের কাছে মানুষ ও প্রাণিজগতের সব প্রাণীই নিরাপদ। তাঁরা কখনো বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করেন না।

ধৈর্য ধারণকারীদের জন্য ইসলামে বিশেষ পুরস্কারের কথা বলা হয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি ধর্মের প্রতি কিংবা আল্লাহর প্রতি প্রেম অনুভব না করেন, তাঁকে কৌশলে ভয়-ভীতি দেখিয়ে কিংবা সোশ্যাল পুলিশিং করে ধর্মের পথে আনা আদৌ সম্ভব নয়। এ প্রেমকে অন্তরে জাগতে দিতে হবে। সে কারণে আমাদের ইসলাম রক্ষাকারী বন্ধুদের আরও বেশি মডেল হতে হবে।

অন্যভাবে বলা যায়, মৃত্যুর পর আমাদের প্রত্যেকেরই পাপ-পুণ্যের হিসাব হবে। আমরা যে যার হিসাব দিতে বাধ্য থাকব। কারও হিসাব কারও ঘাড়ে ( পরিবার ছাড়া) বর্তাবে না যেমন, তেমনি কারও শাস্তিও কেউ ভোগ করবে না। তাই আমাদের উচিত অন্যকে কোনো রকম বিরক্ত-বিব্রত না করে ইয়া নাফসি ইয়া নফসি করা।

প্রসঙ্গত বলে রাখি, ইসলাম কখনোই পরচর্চায় উৎসাহিত করে না। অন্যের অগোচরে তাঁর বিষয়ে সমালোচনাকে ইসলামে গিবত বলা হয়। কারও গিবত করা মৃত ভাইয়ের মাংস খাওয়ার নামান্তর। সুতরাং অন্যজনের ধর্মপালন, কিংবা ব্যক্তিগত জীবনাচরণ নিয়ে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ কোনো রকম খবরদারি ইসলাম সমর্থন করে না বলেই জানি।
আমাদের সমাজে বকধার্মিকের অভাব কোনোকালেই ছিল না। ফেসবুকের কল্যাণে এ উৎপাত বেড়েছে। সময় বদলেছে, সোশ্যাল পুলিশিংয়ে পালটা প্রশ্ন এলে জবাব নিয়ে আপনি তৈরি তো? যেমন ধরুন হালাল রুজি করে হালাল মাংস কেনেন তো?

কোরবানিতে ব্যয়িত অর্থ কোন পথে আসে? খাবারে ভেজাল না দিয়ে ব্যবসা করেন তো? আত্মীয়ের হক পালন করেন তো? অন্যের গিবত থেকে নিজেকে বিরত রাখেন তো? আগে নিজেকে প্রশ্ন করুন, আপনি কতটুকু ধারণ করেন ইসলামকে? তারপর নাহয় পাবলিককে সওয়াল–জবাব করাবেন!

পরিশেষে আবারও বলব, ধর্মের সৌন্দর্য সেখানেই, যা মানুষকে হেয়প্রতিপন্ন করে না বরং মানুষের মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করে। কবীর সুমনের সেই গানের মতো—‘আমি চাই ধর্ম বলতে মানুষ বুঝবে মানুষ শুধু’।

*সঙ্গীতা ইয়াসমিন, প্রবাসী লেখক, প্রাবন্ধিক ও কবি

**দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস [email protected]