সে যে রূপে অপরূপা কোন কবির কল্পনা

লেখক

কাজের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম ছাড়াও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো আমার প্রিয় একটা স্বভাব। সেটা কোনো মেলা হোক, গ্র্যাজুয়েশন পার্টি হোক বা হোক কোনো হাসপাতালের কক্ষ।

এ রকম একজনের সঙ্গে কথা হচ্ছিল সেদিন। সে একজন সেলফ মেড প্রতিষ্ঠিত মানুষ। জীবনের ছোটখাটো সমস্যা নিয়ে কথা বলছি। এমন সময় সে বলল, ‘আপু জান আমার বাবা এত প্রতিষ্ঠিত একজন মানুষ ছিলেন, আমরা দুই ভাই–বোন মন দিয়ে পড়াশোনা করি। সেটাই মনে হতো অনেক বেশি ফিরিয়ে দেওয়া প্রতিদান তাঁদের ভালোবাসার।’ জীবন সহজ–সুন্দর। প্রতি সামারে আমরা সিঙ্গাপুর বা ব‍্যাংকক যাই বা নিদেনপক্ষে সিলেট বা কক্সবাজারের রিসোর্টে তো যাই। সঙ্গের সহপাঠীরা পার্টি করে, সিগারেট খা‌য় বা ওয়াইনও। আমরা ভুলেও ওসব চিন্তা করিনি।

তারপর জীবনের মোড় ঘুরে গেল। একবার সিঙ্গাপুর ঘুরে এসে জিনিস গোছাচ্ছি, মা ছোটাছুটি করছেন কার জন‍্য কী এনেছেন, কাকে কী দেবেন সেসব নিয়ে। আমি এইচএসসির ছাত্রী। বাবা বললেন আমার বুকে তীব্র ব‍্যথা। তাঁকে লোকাল হাসপাতালে আমরা নিলাম, তারা বলল অন‍্য হাসপাতাল ট্রান্সফার কর, আমাদের এখানে হার্টে স্টেন্ট বসানোর ব‍্যবস্থা নেই।

আমি আর স্কুল পড়ুয়া ভাই বাবার অফিসের এক আঙ্কেলের সহায়তায় নিলাম তাঁকে স্পেশালাইজড হাসপাতালে। হার্টের এনজিওগ্রাম করার সময় বাবা চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। পায়ের তলার মাটি সরে গেল। মা বিছানায় পড়ে গেলেন। এক মাসের মধ‍্যেই অফিসের কোয়ার্টার ছেড়ে আমরা চলে গেলাম ছোট একটা বাসায়। আপু জান, ছোট্ট একটা আদুরে মেয়ে থেকে কয়েক দিনে হয়ে গেলাম একজন দায়িত্বশীল মেয়ে। নিজের আর ভাইয়ের খরচ টিউশনি করে জোগাড় করা শুরু করলাম। বাবার রেখে যাওয়া টাকা থেকে বাসা ভাড়া আর খাবার খরচ চলত। তারপর বুয়েটে পড়লাম। ভাই ডাক্তার হলো। স্কলারশিপ নিয়ে চলে এলাম আমেরিকা।

ও হ‍্যাঁ, এতদিনে মুনীর আমার সহপাঠী থেকে বাগদত্তা হয়েছে। মাস্টার্স করার জন‍্য আমেরিকা আসার আগেই আমাদের বিয়ে হয়েছিল। ওকে বিয়ের পর বুঝলাম, আমার আব্বুর জন‍্য কী পরিমাণ মায়া ছিল আমার মায়ের। কেন হাসিখুশি মা আর কোনোদিন স্বাভাবিক হননি আব্বু চলে যাওয়ার পর। ছোট ভাইটা মেডিকেলের শেষ বর্ষে পড়ে, এমন সময় চলে গেলাম আমরা আমেরিকায়। মুনীর এসে নিজেও মাস্টার্স প্রোগ্রামে ঢুকল আমার ফ্যাকালটিকে রিকোয়েস্ট করার পর। তার বদলে যাওয়াটা একটু একটু করে হচ্ছিল, তাই প্রথম দিকে বুঝিনি কিছু। মনে হতো সামান‍্য টাকায় চলতে হয়, সব কাজ নিজে করতে হয়, নতুন দেশ। এসবই আমার কল্পনা। সে আমাকে ভালোবাসে। লোভ‍্য পেটে এল। ভাবলাম মুনীর আমাকে একটু মন দিয়ে ভালোবাসবে। কিন্তু তার ব্যবহার খারাপ হতে থাকল। সভ‍্যর জন্মের সময়ও মুনীর ছিল না। তারপর একটা ব্লিজার্ডের দিনে সে চলে গেল। বলে গেল, মুন্নি তোমার চেয়ে অনেক যোগ‍্য একটা মেয়ে। আমি তাকে বিয়ে করব। আশা করব সভ‍্য বা তুমি আমাকে বিরক্ত করবে না। আপু জীবনে দ্বিতীয়বার পায়ের তলার মাটি সরে গেল। সামনে আমার কঠিন দিন, কিন্তু কি জান, দেশে মা আর ছোট ভাই আছে, আর আমার সভ‍্য আছে সঙ্গে। চোখ মুছে ফেললাম।

কী কষ্ট করে সভ‍্যকে নিয়ে পড়াশোনা চালিয়ে গেলাম, চাকরি পেলাম, গ্রিনকার্ড হলো, সে গল্প তোমাকে অন‍্য একদিন বলব।

চলে এলাম চাকরি নিয়ে তোমাদের শহরে। একদিন হাইকিং করছি। প্রায়ই দেখি, একটা ছেলে পাহাড়ের মাথায় আমার আগে আগে এসে বসে থাকে। বিরক্ত লাগে। একদিন এসে বাংলায় বলল, আপনার নামটা বলবেন? নাম বললাম। আমাকে হাইকিংয়ের পর একটা রেস্তোরাঁয় যেতে বলল, গেলাম। সহকর্মীরা একসঙ্গে যাই না? তার সঙ্গে গেলে কী হবে? যদিও পণ করেছিলাম কাউকে কোনোদিন আর ভালোবাসার জায়গায় বসাব না।

দুটা বছর গেল কথা বলে, হাইকিং করে, তাকে মনে হলো বিশ্বস্ত বন্ধু, আর সভ‍্যর সঙ্গে তার সখ‍্যও দারুণ।

তারপর একটা দুর্ঘটনায় পা ভাঙলাম। ঘাস মানে ওই ছেলে আরকি, এত যত্ন করল, আপু তাকে হাঁটু গেড়ে বসতে দেখে না করতে পারলাম না। সেই থেকে ঘাসের সঙ্গেই আছি মা–ছেলে। পৃথিবীতে ভালো মানুষ আছে আপু। আমি হাসলাম। বললাম না, ভালোবাসার এ কাব‍্য আমি রোজ দেখি।

তারপর বললাম দুর্ঘটনায় কেন হয়েছে তোমার? সে বলল, জান আজ দুই সপ্তাহ সভ‍্য আমার কাছে নেই। তার বাবার কাছে। আমেরিকার আইন অনুযায়ী সামারে বাচ্চাকে শেয়ার করতে হচ্ছে বাবার সঙ্গে। জন্মের ১২ বছর পর তার বাবা মামলা করে এটা আদায় করেছে। আমি এ কষ্ট মেনে নিতে পারছি না। আমার বাবাটা ওর বাবার রেকলেস জীবন দেখছে। ওই লোকের অসংখ্য বান্ধবীর সঙ্গে পরিচিত হচ্ছে, তারা নিজের স্বামী ফেলে মুনীরের সঙ্গে ঘুরছে, সভ‍্যকে বেবি সিট করছে। আপু আমি ছেলেকে ইসলাম ধর্মের সুন্দর জীবনব্যবস্থা অনুযায়ী বড় করতে চাইছি। আর মসজিদে লোক দেখানো নামাজ পড়ে বলে কেউ তাকে কিচ্ছু বলছে না। এই মেইল শোভেনিস্ট দুনিয়ায় আমি কি আমার বাচ্চাকে নিজের কাছে রেখে সুন্দরভাবে মানুষ করতে পারব না?

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

বললাম, বিশ্বাস রাখ আল্লাহর ওপর। তুমি আর সে তার ক্রিয়েশন। আল্লাহ তোমাদের প্রটেক্ট করবেন। ভয় পাওয়া উচিত মুনীরের মতো মানুষগুলোর। কারণ, শাস্তি এই দুনিয়াতেও কিছু হবে। কারও কবরের ওপর রাজপ্রাসাদ গড়ে অনন্তকাল কেউ থেকে যেতে পারে না। তুমি তো সবার জন‍্য একটা উদাহরণ। সবকিছুর পরও লড়াই করে কত সুন্দর একটা জীবন গড়েছ। এমন সময় পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ফুল হাতে ঘাস ঢুকল।