নেদারল্যান্ডে ‘সোনার বাংলা’
বাঙালি ও বাংলাদেশি হিসেবে আমাদের কাছে বিজয় দিবস বা স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন বরাবরই আবেগ আর উচ্ছ্বাসে ভরপুর। আর এই উদ্যাপন যদি বিদেশের মাটিতে হয়, তাহলে তো আর কথাই নেই। স্মৃতিতে আজীবন রেখে দেওয়ার মতো এ রকম একটি সুযোগ আমি পেয়েছিলাম গত বছর ১৬ ডিসেম্বর উপলক্ষে। আমি নেদারল্যান্ডস সরকারের অরেঞ্জ নলেজ প্রোগ্রামের আওতায় বৃত্তি পেয়ে ডিজাস্টার রিস্ক ম্যানেজমেন্টে মাস্টার্স করার জন্য Van Hall Larenstein University of Applied Sciences-এ যাই। এমনিতেই সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে দেশে আমাকে এসব দিবসে আবশ্যিকভাবে থাকতে হতো। কিন্তু দেশের বাইরে পড়তে আসাতে তাতে কিছুটা ভাটা পড়ে। যখন ফেসবুকে সহকর্মীদের এসব দিবস উদ্যাপনের ছবি দেখতাম, স্বাভাবিকভাবেই ওই দূর পরবাসে নিজের মনের মধ্যে কেন জানি মোচড় দিয়ে উঠত।
যা–ই হোক, মনে মনে ভাবতাম যে ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসে এ রকম কোনো একটা দিবস উদ্যাপন করতে পারলে ভালো লাগত। কিন্তু সমস্যা হলো আমার ক্যাম্পাসে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা বলতে গেলে হাতে গোনা ১০ থেকে ১২ জন এবং তাঁদের সঙ্গে ভালো পরিচয়ও নেই। তবে আমার একই প্রোগ্রামে অধ্যয়নরত দুই বাংলাদেশি শিমুল ও দিলরুবার সঙ্গে আমার পরিকল্পনার কথা জানানোর সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা রাজি হয়ে গেলেন। তাঁদের বললাম যে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিন ক্যাম্পাসে অন্তত জাতীয় সংগীত গেয়ে হলেও উদ্যাপন করব। সেটা ক্লাসরুম কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্তৃপক্ষের রাখা আন্তর্জাতিক ফ্ল্যাগস্ট্যান্ডের সামনে হতে পারে, যেখানে বাংলাদেশের লাল–সবুজের একটা পতাকা পত পত করে সব সময় উড়ে। ১৬ ডিসেম্বরের ক্লাস শিডিউল চেক করে দেখলাম যে মোটামুটি সারা দিন ক্লাস আছে। তাহলে ক্লাসরুমে উদ্যাপন করতে পারলে সবচেয়ে ভালো হয়। এতে আমরা অন্তত ১৮ দেশের শিক্ষার্থীদের সামনে নিজের দেশকে উপস্থাপন করার একটা সুযোগ পাব।
উল্লেখ্য, এই স্কলারশিপের অধীন আমরা প্রায় ২৬টি দেশ থেকে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছি। তার মধ্যে ১৮ দেশের ছিল আমার প্রোগ্রামে। কিন্তু ক্লাস চলাকালে সময় ম্যানেজ করব কীভাবে? বিদেশি একটা দেশের জাতীয় সংগীত পরিবেশন করার অনুমতি আদৌ প্রফেসর দেবেন কি না, অথবা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীরা ভালোভাবে নেবেন কি না। নানা দোলাচলে ভাবতে ভাবতে ১৫ ডিসেম্বর প্রফেসর ক্যারেনকে আমাদের পরিকল্পনার কথা জানিয়ে একটা মেইল দিলাম।
আশ্চর্যজনকভাবে তিনি ফিরতি মেইলে সম্মতি জানালেন। মুহূর্তেই সব সংশয় কেটে গেল। নানা মত, পথ আর বৈচিত্র্যকে যে স্বাগত জানানোর মধ্যেই যে নেদারল্যান্ডের ভিত্তি, সেটা আরেকবার অনুভব করলাম। আমি শুধুই ভেবে যাচ্ছিলাম যে পরের দিন বরাদ্দ করা ১০ মিনিট সময়ে কী কী করা যায়, নিজের দেশকে সবার সামনে তুলে ধরা যায়।
১৬ ডিসেম্বর খুব সকালবেলা ঘুম ভাঙল উত্তেজনা নিয়ে। নাশতা সেরে দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া লাল–সবুজ পাঞ্জাবি গায়ে জড়িয়ে সাইকেল চেপে বের হলাম চকলেট আর কুকিজ কেনার জন্য। আমাদের তিনজনকে ক্লাসে একসঙ্গে ঢুকতে দেখে প্রফেসর ক্যারেন এসে হাসিমুখে স্বাগত জানালেন এবং বললেন আজ বাংলাদেশের বিজয় দিবস। সঙ্গে সঙ্গে পুরো ক্লাসরুম হাততালিতে মুখর হয়ে উঠল। প্রফেসর আমাকে কিছু বলার সুযোগ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি লুফে নিলাম। বললাম বাংলাদেশ পৃথিবীর একমাত্র দেশ, যারা প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়ে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমের বিনিময়ে পাকিস্তানিদের কাছ থেকে বিজয় অর্জন করেছিল। আমাদের আছে স্বাধীনতা ও বিজয় দিবস। এরপর ইউটিউব থেকে জাতীয় সংগীত চালু করে আমরা তিনজন যখন গাইতে শুরু করলাম, লক্ষ করলাম, বিদেশি শিক্ষার্থীরা নিজ থেকে দাঁড়িয়ে গেলেন। যদিও একটু সন্দিহান ছিলাম যে তাঁরা আসলে দাঁড়াবেন কি না। আমি খেয়াল করলাম, তাঁদের মধ্যে মধ্যে কেউ চোখ বন্ধ করে গভীর মনোযোগ দিয়ে সুরের মূর্ছনায় হারিয়ে যাচ্ছেন। আমার মনে হচ্ছিল জীবনের শ্রেষ্ঠ একটা মহাকাল পার করেছি। এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। মনে মনে বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ আর নেদারল্যান্ড সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানালাম যে এ রকম এত বড় প্ল্যাটফর্মে নিজের মাতৃভূমিকে উপস্থাপন করার সুযোগ প্রদান করার জন্য। এই অনুভূতি নিঃসন্দেহে স্বর্গীয়।
আমার স্পষ্ট মনে আছে, ওই দিন রাতে বিদেশি শিক্ষার্থীদের বেশ কয়েকজন আমার রুমে এসে আবার হাজির হয়েছিলেন বাংলাদেশ নিয়ে আরও বিস্তারিত জানতে। তাঁদের অন্যতম আগ্রহ ছিল, ভৌগলিকভাবে এত দূরে হওয়ার পরও বর্তমান বাংলাদেশ কীভাবে পাকিস্তানের অংশ ছিল। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভারতীয় হয়ে কীভাবে বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের রচিয়তা হলেন। তাঁদের এসব সংশয়ের উত্তর দিতে গিয়ে আমাকে ইতিহাস শুরু করতে হয়েছিল ১৯৪৭ সাল থেকে। যা–ই হোক, এটার মাধ্যমে আমি তাঁদের বড় দুটি সংশয়ের উত্তর দিতে পেরেছিলাম। এক, তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করতেন, বাংলাদেশ ভারতের পার্শ্ববর্তী একটা মুসলিম রাজ্য এবং পাকিস্তানকে মনে করতেন মানবতার ও মুসলিম বিশ্বের অগ্রদূত। আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে তাঁদের ভুল ভেঙে বুঝতে পেরেছিলেন যে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র, যারা জাতিতে বাঙালি। যাদের হাজার বছরের নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। আর পাকিস্তানের হাতে লেগে আছে ৩০ লাখ মানুষের রক্ত এবং প্রায় ১ লাখ সৈনিক নিয়ে বাঙালির হাতে পরাজয়ের ইতিহাস।
* লেখক: বিধান দত্ত, প্রভাষক (প্রাণিবিদ্যা), বান্দরবান সরকারি মহিলা কলেজ, বান্দরবান