নিশ্চিত হোক শিক্ষাগুরুর মর্যাদা, নয় কোনো লাঞ্ছনা বা জোরপূর্বক পদত্যাগ

শিক্ষকপ্রতীকী ছবি

আজ থেকে প্রায় ১৭ বছর আগের ঘটনা। তখন ক্লাস ফাইভে পড়ি। কবি কাজী কাদের নেওয়াজের লেখা একটি কবিতা সে সময় আমাদের পাঠ্যবইয়ে স্থান পেয়েছিল। কবিতার নাম ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা ‘। মুঘল সম্রাট আওরঙ্গজেবের জীবনের একটি ঘটনা নিয়ে এ কবিতাটি রচিত হয়েছে। মূলত এ কবিতাটি শিক্ষক-শিক্ষিকাদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়। আমাদের সমাজ বিনির্মাণে শিক্ষক ও শিক্ষিকাদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের অপর নাম ছিল আলমগীর। বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর ও শাহজাহানের পর তিনি ছিলেন ষষ্ঠ মুঘল সম্রাট। ১৬১৮ সাল থেকে শুরু করে মৃত্যুর আগপর্যন্ত প্রায় ৪৯ বছর তিনি মুঘল সাম্রাজ্যের শাসক হিসেবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। তাঁর শাসনামলে মুঘল সাম্রাজ্য সবচেয়ে বেশি বিস্তৃত হয়। দক্ষিণ ভারতের কিছু অংশ ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের সম্পূর্ণ অংশ তিনি শাসন করেছিলেন। মৌর্য সম্রাট অশোক ছাড়া ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে দ্বিতীয় কোনো শাসক খুঁজে পাওয়া যাবে না, যার সাম্রাজ্যের বিস্তৃতি সম্রাট আওরঙ্গজেবের মতো এতটা সুদীর্ঘ ছিল।

সম্রাট আওরঙ্গজেবের পুত্রকে দিল্লির এক মৌলবি পড়াতেন। তিনি সম্রাটের বাড়িতে এসে তাঁর পুত্রকে পাঠদান করতেন। একদিন সকালে সম্রাট দেখতে পান তাঁর পুত্র একটি পাত্র হাতে নিয়ে তাঁর শিক্ষকের পায়ে পানি ঢালছে।  আর শিক্ষক নিজের হাত দিয়ে নিজেরই পায়ের ধুলাবালি ধুয়েমুছে পরিষ্কার করছেন। শিক্ষকের পায়ে কেবল পানি ঢেলে সম্রাটের পুত্র তাঁর শিক্ষকের প্রতি কর্তব্য সম্পাদন করছে। দূর থেকে এ দৃশ্য দেখে সম্রাট ভীষণ মর্মাহত হলেন। তিনি তাই তাঁর ছেলের শিক্ষককে খাসকামরায় ডেকে পাঠালেন। শিক্ষক ভাবতে লাগলেন, হয়তো বা সম্রাটের ছেলেকে তাঁর পায়ে পানি ঢালতে বলার কারণে সম্রাট ভীষণ রাগান্বিত হয়েছেন। অত্যন্ত ভীত ও সন্ত্রস্ত অবস্থায় তিনি সম্রাটের সামনে উপস্থিত হলেন।

সম্রাট তাঁকে দেখে বললেন, ‘আমার পুত্রকে আপনি পড়াচ্ছেন ঠিকই কিন্তু আপনার কাছ থেকে কোনো প্রকার ভদ্রতা, শিষ্টাচার বা আদবকায়দা শিখতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না।’ শিক্ষক প্রথমে তাঁর কথার অর্থ বুঝতে পারলেন না। সম্রাট তাঁকে বললেন, ‘সকালে দেখলাম আমার পুত্র একটি পাত্র পায়ে নিয়ে আপনার পায়ে পানি ঢালছে। আর আপনি নিজ হাতে আপনার পায়ের ধুলা-ময়লা সাফ করছেন। এ ধরনের আচরণ নিছক বেয়াদবি আর গুরুজনের প্রতি অবহেলা ছাড়া আর কিছু নয়।’ তিনি শিক্ষককে প্রশ্ন করলেন, ‘আমার ছেলে কেন নিজ হাতে আপনার পা পরিষ্কার করে দিল না?’ সম্রাটের মতে, তাঁর পুত্র যদি শিক্ষকের পায়ে পানি ঢেলে দেওয়ার পাশাপাশি নিজের হাতে তাঁর পা পরিষ্কার করে দিতেন, তাহলে কেবল শিক্ষককে তার উপযুক্ত মর্যাদা প্রদান করা হতো। সম্রাটের কাছ থেকে শিক্ষক এ ধরনের কথা শুনে খুবই আনন্দিত হন। তিনি সম্রাটের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। কবি কাদের নেওয়াজ তাঁর কবিতায় সম্রাটের প্রতি শিক্ষকের কৃতজ্ঞতাকে প্রকাশ করেছেন ঠিক এভাবে—
‘আজ হতে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’

বর্তমানে আমাদের দেশে যেসব স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী রয়েছে, তারা ‘শিক্ষাগুরুর মর্যাদা’ কবিতাটি পড়েছে কি না, সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। কেননা আমাদের সময়ে যে পাঠ্যবই ছিল, সেটি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে একাধিকবার পরিবর্তন করা হয়েছে। তবে আমি মনে করি, বাংলাদেশ, ভারত বা পাকিস্তানের সমাজব্যবস্থায় শিক্ষকদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্যকে কী রকম হবে, সেটা বোঝার জন্য ব্যক্তিগত উদ্যোগে হলেও এ কবিতাটি সবার পড়া জরুরি। আমরা ছোটবেলা থেকে এ কথা শুনে বড় হয়েছি যে বাবা ও মায়ের পর শিক্ষক-শিক্ষিকাদের স্থান। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে যদি বলতে চাই, প্রত্যেক ধর্মে শিক্ষকদের বিশেষ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে।

দুর্ভাগ্যবশত আজকের বাংলাদেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আমরা যেভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শিক্ষার্থীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে হেনস্তা হতে দেখছি। একজন শিক্ষার্থী হিসেবে এ ধরনের ঘটনা আমার মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করে। আমি জেনারেশন জেডের একজন সদস্য এবং এ ধরনের ঘটনার জন্য আমি ভীষণ লজ্জিত ও অনুতপ্ত। এটা ঠিক যে সাম্প্রতিক সময়ে আমরা শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে নীতি-নৈতিকতার স্খলন দেখেছি। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সম্পর্কের মধ্যে বড় ধরনের ফাটল তৈরি হয়েছে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকে তাঁদের পেশার প্রতি সুবিচার করতে পারেননি। আমরা যখন স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থী ছিলাম, আমরাও বিভিন্ন সময়ে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের দ্বারা বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনার সম্মুখীন হয়েছি। ক্লাস টেনে পড়ার সময়ে আমাদের একজন শ্রেণিশিক্ষক ছিলেন। তিনি সব সময় নীতি-নৈতিকতার কথা বলতেন। কিন্তু যারা স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ত, তাদের তিনি যেভাবে মূল্যায়ন করতেন, আমরা যারা প্রাইভেট পড়তাম না, তাঁর কাছ থেকে অনেক সময় সে ধরনের মূল্যায়ন পাইনি। আমাদের স্কুলে এ ধরনের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকা ছিলেন, যাঁরা নীতি-নৈতিকতার দিক থেকে ছিলেন বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। অথচ আমরা কোনো দিন কোনো শিক্ষক বা শিক্ষিকাকে অসম্মান করিনি। এটা ঠিক যে তাঁদের অগোচরে তাঁদের নিয়ে আমরা সমালোচনা করেছি। তাঁদের ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ করেছি। স্কুল বা কলেজ লাইফে অনেক সময় আমরা শিক্ষক-শিক্ষিকার সামনে দিয়ে হাঁটার সাহস পাইনি। যেসব শিক্ষার্থী ক্লাসে দুষ্ট প্রকৃতির ছিল, তাদেরও আমি কখনো সামনাসামনি সেভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অসম্মান করতে দেখিনি। তারাও অনেক সময় শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শাসনের ভয়ে ভীত থাকত। আমাদের সময় শিক্ষক-শিক্ষিকারা অনেক সময় ক্লাসরুমে বেতের ব্যবহার করতেন। বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলোতে বেতের ব্যবহার করা হয় কি না, সেটা আমার জানা নেই। তবে ভারত ও পাকিস্তানের অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষিকারা বেতের ব্যবহার করেন। শিক্ষক নিয়োগে দুর্নীতি আমাদের দেশে সব সরকারের আমলে হয়েছে।

শিক্ষকতা
প্রতীকী ছবি

প্রায় পাঁচ বছর আমি স্লোভেনিয়াতে বাস করছি। স্লোভেনিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা থেকে ব্যাচেলর সম্পন্ন করছি ফিজিকস অ্যান্ড অ্যাস্ট্রোফিজিকসের ওপর। স্লোভেনিয়ার পাশাপাশি হাঙ্গেরি, তুরস্ক, পর্তুগাল ও যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে সাময়িক সময়ের জন্য আমার পড়াশোনার সুযোগ হয়েছে। আমি আমার অভিজ্ঞতা থেকে একটা কথা বলতে চাই। ভারতীয় উপমহাদেশের শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে মানবিকতা বোধ বলে একটা বিষয় আছে, যেটি ইউরোপের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক-শিক্ষিকার মধ্যে আমি খুঁজে পাই না। আমাদের দেশে অনেক সময় একজন শিক্ষার্থী কোনো বিষয়ে পাস নম্বর তুলতে না পারলে, শিক্ষক-শিক্ষিকারা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে ওই শিক্ষার্থীকে পাস করানোর চেষ্টা করেন। আমরা আমাদের বিভিন্ন ব্যক্তিগত সমস্যার কথা অবলীলায় আমাদের শিক্ষক বা শিক্ষিকাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পারি। তাঁরা আমাদেরকে বিভিন্নভাবে সহায়তার চেষ্টা করেন। ভারত ও পাকিস্তানের শিক্ষকদের মধ্যেও আমি এ ধরনের সহযোগিতামূলক মনোভাব লক্ষ করেছি। আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থা রক্ষণশীল, এ কারণে আমরা বিভিন্ন সময় আফসোস প্রকাশ করি। এরপরেও এ উপমহাদেশের সমাজব্যবস্থায় এখনো অনেক সুন্দর বিষয় আছে, যা পশ্চিমে অনুপস্থিত। স্লোভেনিয়া ও হাঙ্গেরি—এ দুই দেশে আমি আমার কিছু শিক্ষক-শিক্ষিকার থেকে এমন আচরণ পেয়েছি, যেটা অতীতে আমার কখনো কল্পনায় ছিল না। থার্ড ইয়ারে আমাদের ল্যাব ফাইভ নামক একটি মডিউল ছিল। এ মডিউলের এক্সামে আমি তিনবারের বেশি ফেল করেছি। আমার শিক্ষিকা একাধিকবার আমার ল্যাব রিপোর্ট রিজেক্ট করেছেন। একটানা চার ঘণ্টা ল্যাব রিপোর্ট ডিফেন্স করার পরেও আমাকে পরীক্ষায় তিনি ফেল করিয়েছেন।
অধ্যাপক জিওভান্নি ডি নিনো নামে আমাদের আরেক শিক্ষক রয়েছেন। তাঁর জন্ম ইতালিতে, যদিও তিনি ফ্রান্স থেকে পিএইচডি করেছেন। জিওভান্নি অত্যন্ত একরোখা ও উদ্ধতস্বভাবের মানুষ। সামান্য বিষয় নিয়ে তিনি শিক্ষার্থীদের অপমান করতে দ্বিধাবোধ করেন না। তাঁর মতের সঙ্গে মিল হয় না এমন বিষয় তিনি কখনো শুনতে পছন্দ করেন না। এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিকসকে তিনি সব সময় বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখান। তাঁর দৃষ্টিতে ফিজিকস মানে কেবল থিওরি। তিনি আমাদের অ্যানালাইটিক্যাল ম্যাকানিকস, কোয়ান্টাম মেকানিকস ও নন-লিনিয়ার অপটিকসের ক্লাস নেন। তাঁর পরীক্ষপদ্ধতি অন্যান্য শিক্ষকদের চেয়ে একেবারে ভিন্ন। তিনি মৌখিক পরীক্ষা নেন। পরীক্ষায় তিনি বিভিন্ন টপিক নিয়ে শিক্ষার্থীদের কাছে প্রশ্ন করেন এবং শিক্ষার্থীদেরকে ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে ওই টপিকের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন বিষয় তাঁর কাছে এক্সপ্লেইন করতে হয়। যদি কোনো শিক্ষার্থী তাঁর মনমতো এক্সপ্লেইন করতে না পারেন, তাঁকে তিনি তৎক্ষণাৎ ফেইল করিয়ে দেন। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যারা অন্যান্য মডিউলে পাস করেছেন, কিন্তু শুধু অধ্যাপক জিওভান্নির কোর্সে পাস মার্ক তুলতে না পারার কারণে তাঁদের গ্র্যাজুয়েশন শেষ হচ্ছে না। এ এক অধ্যাপকের কারণে আমাদের ইউনিভার্সিটির অনেক স্টুডেন্ট তিন বছরের ব্যাচেলর প্রোগ্রাম ছয় বছরে শেষ করতে পারেননি। গত বছর অ্যানালাইটিক্যাল মেকানিকস পরীক্ষায় জিওভান্নি আমার থেকে ডি’অ্যালামবার্ট প্রিন্সিপাল সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলাম। আমি ব্ল্যাকবোর্ডে লিখে তাঁকে  ডি’অ্যালামবার্টের প্রিন্সিপাল বুঝিয়ে দিয়েছি। এরপর আমাকে তিনি ডি’অ্যালামবার্টের প্রিন্সিপাল ব্যবহার করে লাগরাঞ্জের ইকুয়েশন প্রমাণ করতে বলেন।

আমি ব্ল্যাকবোর্ডে সে প্রমাণ দেখাই। প্রমাণের পাশাপাশি তিনি আমাকে সমগ্র ডেমনস্ট্রেশন ব্যাখ্যা করতে বলেন। আমি সাধ্য অনুযায়ী তাঁর কাছে পুরো ডেমনস্ট্রেশন ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করি। এরপর তিনি আমাকে হলোমনিক আর নন-হলোমনিক কন্সট্রেইন্ট সম্পর্কে প্রশ্ন করেন।  হলোমনিক আর নন-হলোমনিক কন্সট্রেইন্ট সম্পর্কে আমার যতটুকু জ্ঞান ছিল পুরোটা আমি তাঁর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করি। আমার উত্তর তাঁর মনঃপূত হয়নি। তাই আড়াই ঘণ্টা ওরাল এক্সাম দেওয়ার পরেও তিনি আমাকে ফেইল করান। একবার এক ছাত্রকে তিনি কোয়ান্টাম ম্যাকানিকস পরীক্ষায় সাত ঘণ্টা ওরাল এক্সামের পরেও ফেইল করিয়েছিলেন। ১৮০ ইসিটিএসের মধ্যে তিনি প্রায় ১৬১ ইসিটিএস সম্পন্ন করেছিলেন এবং প্রায় সব মডিউলে তার রেজাল্ট ছিল ভালো। কোয়ান্টাম মেকানিকসে পাস করার মধ্য দিয়ে শেষ নয়, ইসিটিএস শেষ করতে তার পাঁচ বছর লেগে যায়। আমি অনেক শিক্ষার্থীকে প্রফেসর জিওভান্নির রুমে কাঁদতে দেখেছি। তাদের অনেককে প্রফেসর জিওভান্নির কাছে অনুনয় করতে দেখেছি এ বলে, যাতে তিনি দয়ার বশবর্তী হয়ে তাদেরকে মিনিমাম মার্ক দিয়ে পাস করিয়ে দেন। কেননা এ এক শিক্ষকের কারণে তাঁদের গ্র্যাজুয়েশন সঠিক সময়ে শেষ হচ্ছিল না। আমার এক সময়কার ক্লাসমেট পিটার। পাঁচ বছর হয়ে গিয়েছে। শুধু প্রফেসর জিওভান্নির কোর্সে পাস না করার কারণে পিটার সেকেন্ড ইয়ার থেকে থার্ড ইয়ারে প্রমোশন পাচ্ছেন না। কিছু কিছু শিক্ষার্থীর প্রতি প্রফেসর জিওভান্নি অসম্ভব রকমের বায়াসড আচরণ করেন। আমার মাঝেমধ্যে মনে হয়, ইয়াজিদের সেনাপতি শিমারের অন্তরে ছিটাফোঁটা হলেও দয়ামায়া থাকতে পারে; কিন্তু প্রফেসর জিওভান্নির অন্তরে সেটিও নেই।  বিভিন্ন নেতিবাচক অভিজ্ঞতার পরেও আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো শিক্ষার্থীকে প্রফেসর জিওভান্নির বিরুদ্ধে কোনো ধরনের অভিযোগ করতে শুনিনি।

ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালামের একটি উক্তি স্মরণ করতে চাই। একটি জাতিকে ধ্বংস করতে কোনো ধরনের সামরিক অস্ত্র বা পারমাণবিক বোমার প্রয়োজন নেই। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বিপর্যয় একটি জাতিকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর অস্ত্র। আজকের শিশু আগামী দিন ইঞ্জিনিয়ার হবে, ডাক্তার হবে, আমলা হবে। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হাত দিয়ে ভবিষ্যতের নাগরিকেরা তৈরি হয়। শিক্ষা যদি জাতির মেরুদণ্ড হয়, শিক্ষক-শিক্ষিকারা জাতি গঠনের কারিগর। রাষ্ট্রের যিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন, তিনিও শিক্ষাজীবনে বিভিন্ন শিক্ষক-শিক্ষিকার সান্নিধ্যে হাতেখড়ি লাভ করেন। আধুনিক সিঙ্গাপুরের স্থপতি লি কুয়ান ইউ তাঁর দেশের অগ্রগতির জন্য কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। এগুলোর মধ্যে একটি পদক্ষেপ ছিল প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে সব স্তরে সবচেয়ে মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষক-শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া ও তাঁদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে সর্বোচ্চ বেতনকাঠামো নিশ্চিত করা। আজকের দিনে আমাদের দেশের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের অনেকে যেভাবে শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছিত হচ্ছেন, সেটা কোনোভাবে মেনে নেওয়ার মতো নয়। এক ভিডিওতে দেখলাম, মফস্‌সলের এক সেকেন্ডারি স্কুলের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা জোর করে প্রধান শিক্ষিকাকে হাত ধরে টেনে অসম্মানজনকভাবে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে অনেকে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ হিসেবে আখ্যা দিয়ে থাকেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা যেভাবে কলা অনুষদের ডিনকে অপমান করেছেন ও তাঁকে পদত্যাগে বাধ্য করেছেন, সেটা রীতিমতো হতাশাজনক। এখন কেউ যদি শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠে অধ্যয়ন করা এসব শিক্ষার্থীর শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, সেটি অমূলক কিছু হবে না। যেসব শিক্ষার্থী এভাবে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের লাঞ্ছিত করেছেন, তাঁরা আগামী দিন তাঁদের বাবা-মা ও পরিবার থেকে শুরু করে এ সমাজের গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়াবেন না তার নিশ্চয়তা কোথায়? আমাদের অভিভাবকদের উচিত আমাদেরকে এ বিষয়ে জোরালোভাবে শিক্ষা প্রদান করা।

শিক্ষক-শিক্ষিকাদের নিয়ে আমাদের বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ থাকতে পারে এবং এ বিষয়টি অস্বাভাবিক কিছু নয়। আমাদের সবর উচিত এসব অভিযোগের বিষয়ে প্রশাসনকে অবহিত করা। প্রশাসন তাঁদের বিরুদ্ধে তদন্ত চালাতে পারে এবং যদি উপযুক্ত প্রমাণের ভিত্তিতে তাঁরা দোষী সাব্যস্ত হন, তখন তাঁদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী প্রশাসন পদক্ষেপ নেবে। অভিযোগ প্রমাণের আগপর্যন্ত জোর করে কাউকে পদত্যাগ করানোর পক্ষপাতী আমি নই।

পাঁচ আগস্টের গণ–অভ্যুত্থান আমাদের নতুন এক বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে হাতছানি দিচ্ছে। সাধারণ মানুষের আশা, আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন সেদিন পরিপূর্ণভাবে বাস্তবায়িত হবে, যেদিন আমাদের দেশের শিক্ষাব্যবস্থার উন্নতি ঘটবে এবং দেশের সব মানুষ এক শিক্ষার ছায়াতলে আবদ্ধ হতে পারবে। একটি দেশ অবকাঠামোগত দিক থেকে যতই উন্নতি লাভ করুক না কেন, শিক্ষাক্ষেত্রে কাঙ্ক্ষিত প্রগতি না এলে এ উন্নয়নের সুফল ওই দেশের সাধারণ মানুষ সেভাবে ভোগ করতে পারে না। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের পাশ কাটিয়ে আমরা কখনো আলোকিত মানুষ গড়তে পারব না।

আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে আমাদের জীবনে শিক্ষক-শিক্ষিকাদের ভূমিকা কোনো অংশে পিতামাতার চেয়ে কম নয়। তাই তাঁদেরকে তাঁদের প্রাপ্য সম্মান নিশ্চিত করতে হবে। তাঁরা যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারেন, সে বিষয়ে আমাদেরকে সহায়ক শক্তির ভূমিকা পালন করতে হবে। যদি তাঁদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকে, সেটি নিষ্পত্তির জন্য আইন, আদালত ও প্রশাসন রয়েছে। নতুন বাংলাদেশে কোনো শিক্ষক-শিক্ষিকাকে যাতে লাঞ্ছনার শিকার হতে না হয় অথবা তাঁকে যাতে জোর করে পদত্যাগে বাধ্য না করা হয়, সে বিষয়ে আমাদের সবাইকে সচেষ্ট হওয়া একান্ত জরুরি।

*লেখক: রাকিব হাসান রাফি, শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।

দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]