চিরকুট

ইমিরা তাকিয়ে আছে নামটার দিকে...
কতক্ষণ ধরে সে নিজেও জানে না, তবে অনেক অনেকক্ষণ।
এত বছর বাদে তাকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে অয়ন! প্রথমে চিনতে পারেনি সে, প্রোফাইলে ভালো নাম, চেহারাও বেশ বদলেছে, পরে মিউচুয়াল ফ্রেন্ড ঘেঁটে আরও কিছু ছবি দেখে নিশ্চিত হয়েছে সে।
কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছে না অ্যাড করবে কি না।
এতকাল পর অ্যাড করলেই কী, না করলেই কী...
তবুও কিছুদিন সময় নিল ইমিরা, অ্যাড করে আবার বিপদে পড়ে কি না। চিন্তার নদীতে তলিয়ে গেল সে...
সেই কবেকার কথা, দুজনেরই কারোরই তেমন দেখা হতো না, কথাও না, এইচএসসির সময় অঙ্ক ক্লাসে শুধু।
মাঝেমধ্যে চোখাচোখি, কিন্তু দুজনেই দুজনকে পছন্দ করত, তা ওই চোখের ভাষাতেই জানা হয়ে যেত বেশ।
মাঝে দু–এক দিন টিঅ্যান্ডটি ফোনে ফোন এসেছিল। দুই দিন কথা বলেছে। কথা তো নয়, ফোন কানে ধরে দাঁড়িয়ে থাকা, কিছু নিশ্বাসের শব্দ, হুঁ, হ্যাঁ ওই পর্যন্তই। ক্লাসে নাহিদার থেকে ইমিরার নম্বর নিয়েছিল অয়ন। ইমিরার মা কিছু একটা আঁচ করতে পেরে এমন বকা দিয়েছে, ফোন পর্যন্ত লক করে রেখেছিল, আর ফোন বাজলে তো ধরা একেবারেই বারণ। কথা বন্ধ, কয় দিন পরে একদিন নাহিদার হাতেই অয়ন একটা চিরকুট দিয়ে ছিল, এক লাইনের একটা চিরকুট। লেখা ছিল...
‘অপেক্ষা করছি, যেন প্রতিটা মুহূর্ত স্বপ্নময় হয় আমাদের।’

কী যে ছিল লাইনটার মধ্যে, ইমিরার জীবন ওলট-পালট হয়ে গেল। কিছুই ভালো লাগে না, সারাক্ষণ উদাস হয়ে থাকে, ক্লাসে গেলেও অস্বস্তি, অয়নের দিকে তাকাতেই পারে না। অয়নও কিছু বলে না, শুধুই তাকিয়ে থাকে।
এভাবেই দিন চলছিল। একদিন বাসায় ফিরে দেখে কীভাবে যেন তার মা চিরকুটটা পেয়ে গেছে। সে বাইরে গেলেই মা তার সব জিনিসপত্র ঘাঁটাঘাঁটি করে। হুমায়ুন আহমেদের একটা বইয়ের পৃষ্ঠার ভাঁজে রাখা ছিল চিরকুটটা, তার ওপর আরও অনেক বই রাখা ছিল।
মধ্যরাতে সবাই ঘুমিয়ে গেলে সে খুব সাবধানে বের করে চিরকুটটা দেখত, লেখাটার ওপর হাত বুলাত, গালে চেপে ধরে রাখত, কখনো খুব কান্না পেত, তখন চিরকুটটা সরিয়ে রেখে কাঁদত, যেন ভিজে না যায়। তারপর আবার সাবধানে রেখে দিত।
কিন্তু ওই চিরকুট জানাজানির পর বাসায় অবস্থা এমন হলো, তার পড়ালেখা বন্ধ, নজরদারি বাড়ল। বাড়ির সবাইকে বলে দিল, সবচেয়ে ভয়ংকর কাজ যেটা হলো, সেটা হলো ইমিরার মা তার বাবাকে বলে দিল। বলল, তোমার মেয়ে প্রেম করে বেড়াচ্ছে, আর পড়াশোনা করা লাগবে না, বিয়ে দিয়ে দাও, আপদ বিদায় হোক। নিজে মেয়ে হয়ে নিজের মেয়েকে আপদ বলতে একটুও বাধল না তার মায়ের, অথচ ইমিরা কোনো উত্তর পর্যন্ত দেয়নি চিরকুটের...শুধু রেখে দিয়েছিল।
অনেক কষ্ট করে এইচএসসি পরীক্ষাটা দিল ইমিরা, অনেক কথার দিব্যি দিয়ে, এরপর তার বিয়ে ঠিক হয়ে গেল, ছেলে ডাক্তার। বাসায় সবাই রাজি, এক মামা এসে বলে গেল, সুন্দরী মেয়ে ঘরে রাখা ঠিক নয়, যত তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেওয়া যায় ততই ভালো। ভালো পাত্র, তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দেন। বিয়ে হয়ে যায় ইমিরার, প্রথমটা ‘না’ করলেও ইমিরা বিয়ে করতে বাধ্য হয়। সারাক্ষণ ঘরবন্দী হয়ে থাকতে হতো, পড়াশোনা করতে দেবে না, তখন তার প্রায়ই মনে হতো আত্মহত্যা করবে, কিন্তু তা–ও পারল না।
একদিন বাসায় নাহিদা এল বেড়াতে, এসে আর একটা চিরকুট দিল, যাতে লেখা...
‘চলো পালিয়ে যাই আমরা’

নাহিদা পালানোর সময়ক্ষণ বলে গেল, বলল অয়নকে সে সব জানিয়ে রাখবে, সে যেন সময়মতো আসে। নাহিদা চলে গেল। কিন্তু ইমিরা পালতেও পারল না...
একটা সময় ইমিরার মনে হলো, এভাবে বাঁচার চেয়ে বিয়ে করা ভালো, এ বাড়ি থেকে তো মুক্তি মিলবে। বিয়ে হয়ে গেল। জামাইয়ের সঙ্গে লন্ডনে চলে গেল সে।
এরপর আর কোনো খোঁজ জানে না অয়নের, কোন মুখে বা খোঁজ রাখে, শুধু চিরকুট দুটো তার সঙ্গে আজীবন, অনেক মলিন হয়ে গেছে এখন, তবু অলস দুপুরে বের করে পড়তে ভালো লাগে। অনেক কান্না পায়, তবু...
ইমিরার স্বামী শাহেদ খুবই সন্দেহবাতিক লোক। বয়সে বেশ বড় হওয়ায় ইমিরার কোনো কথাই সে শোনে না। মার্শাল ল তার সংসারে। শাহেদ যা বলবে তা–ই, কোনো কথা বলা যাবে না, বললেই যন্ত্রণা বাড়ে। এমনকি পাশের বাসার লোককে নিয়েও সন্দেহ করে, বাজে কথা বলে, ইমিরার মাঝেমধ্যে অসহ্য লাগে। কিন্তু বাবার বাড়িতেও কিছু বলতে পারে না, কারণ বলে লাভ নেই, তার মাকে সে ভালোভাবে চেনে।
এর মাঝে কেটে গেছে প্রায় ১৮ বছর। লন্ডনে এসে অনেক কষ্ট করে আবার পড়াশোনা করেছে ইমিরা, শাহেদ রাজি ছিল না প্রথমে। অনেক ঝগড়াঝাঁটি করে সে রাজি করিয়েছে। এরপর পরপর দুটো বাচ্চা। বাচ্চা দুটো একটু বড় হওয়ার পরে ইমিরাও চাকরি করে এখন একটা লাইব্রেরিতে। কাজ না থাকলেও হাজারো বইয়ের মাঝে চুপচাপ গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে তার খুবই ভালো লাগে।
একদিন ইমিরার বড় ছেলে (বয়স ১৫) বলে বসল, ‘মাম, তুমি বাবার সঙ্গে থাকো কেন? এত যে যন্ত্রণা করে, সেপারেট হয়ে যাও না কেন?’
ইমিরা একটু চমকে গিয়ে বলল, ‘আমি তো তোমাদের দুই ভাইবোনের কথা ভেবে যাই না।’

আমাদের কথা! কেন মাম, তোমার জীবনটা একটা জীবন তো, আর আমাদের ও তো রোজ এত ঝগড়া দেখতে ভালো লাগে না, বাবা অসুস্থ।
ইমিরা উত্তর দেয় না, ভাবে আলাদা হয়ে কী করবে? সেই তো একাই, এখনো একা, তখনো একা। এভাবেই একা একা দিন কেটে গেল এক জীবনের, যদিও সমাজের কাছে তার পরিপূর্ণ ভরা সংসার।
আজ এত বছর পর অয়নের ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট, আচ্ছা অয়ন কি তার ফ্রেন্ড ছিল কখনো?
ইমিরার হঠাৎ নাহিদার কথা বলে পড়ল, সে ফোন করল, তিন থেকে চার বছর পরে, নাহিদা ঘুমাচ্ছিল। বাংলাদেশে সকালবেলা, ঘুমজড়ানো কণ্ঠে নাহিদা হ্যালো বলল, এরপর ইমিরার গলা শুনে চিৎকার করে উঠল, এত দিন পরে মনে পড়ছে আমাকে?
ইমিরা বলল, কেমন আছিস তুই?
এই তো নানান ঝামেলা আছে, আবার ভালো আছি, আলহামদুলিল্লাহ। তুই?
আমি যেমন থাকি সব সময়। আচ্ছা, তোর অয়নের কথা মনে আছে?
মনে থাকবে না কেন? কেন, কী হয়েছে?
ওর কোনো খবর জানিস?

শুনেছি বিয়ে করেছে অনেক দেরিতে, বউও নাকি বেশ দজ্জাল কিসিমের, বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে তেমন আর মেশে না। আগেও চুপচাপ ছিল, এখন আরও চুপচাপ হয়েছে। একটা বাচ্চা আছে মনে হয়। ফাহিম তো তা–ই বলেছিল। আমার সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ নেই। বছর দশেক আগে দেখা হয়েছিল একবার শাহবাগে। তোর কথা জিজ্ঞাসা করেছিল।
হঠাৎ অয়নের কথা জিজ্ঞাসা করছিস যে?
নাহ, এমনিতেই বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল ইমিরা
তোকে আমি সেই কবে থেকে চিনি। আমার কাছে লুকিয়ে লাভ কী? আমি তো জানি তুই অয়নকে মনের ভেতরে রেখে দিয়েছিস। শাহেদ ভাই কি এখনো জ্বালায়?
যার যেটা স্বভাব, সেটা কখনো যায়?
তুই ভালো থাকিস, সরি, তোর ঘুম ভাঙালাম সাতসকালে...
আজকে রাখি।
আচ্ছা কোনো ব্যাপার না, ফোন করিস যখন মন চায়...
আল্লাহ হাফেজ।
ইমিরা ভাবতে বসল...
পরদিন অয়নকে মেসেজ দিল মেসেঞ্জারে, কেমন আছ?
পাঁচ মিনিট পরে রিপ্লাই এল, যেমন রেখে গেছ।
ইমিরার চোখ জলে ভরে গেল, ভাগ্যিস কেউ দেখছে না...
জলভরা চোখেই লিখল...
কোথায় থাকো?
অয়ন লিখল, এই পৃথিবীতেই থাকি,
আমার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট এক্সেপ্ট করবে না?
তুমি তো আমার ফ্রেন্ড ছিলে না।

ওহ, হুম...তা–ও ঠিক
আচ্ছা একটা অনুরোধ করি? রাখবা?
বলো...
অনেক বছর তোমার গলা শুনি না, একবার মাত্র ফোন দিই?
হুম, দাও...
অয়ন ফোন দিল, ইমিরার হ্যালো বলতেও গলায় শব্দ জড়িয়ে যাচ্ছে, কোনোরকমে হ্যালো বলল
তোমার গলার স্বর তো আগের মতোই আছে...
ইমিরা হাসির চেষ্টা করে বলল, তোমারও,
আচ্ছা, আমাকে এত দিনেও মনে রেখেছ?
ভুলে যাওয়ার কোনো উপায় জানা নেই।
জানো, আমার কাছে তোমার দেওয়া চিরকুট দুটো এখনো আছে, কেমন পুরোনো হয় গেছে, তবু খুব যত্ন করে রেখেছি।
আমার কাছে তো তা–ও নেই, তুমি তো কখনোই কিছু দাওনি যে যত্ন করে রাখব!
কেন, কষ্ট দিয়েছি তো, যত্ন করেই তো বয়ে বেড়াচ্ছ।
আমাকে ক্ষমা করতে পেরেছ?
বেশ কিছুক্ষণ কোনো কথা নেই দুপাশেই,
হঠাৎ অয়ন বলল, আচ্ছা, একটা প্রশ্ন করি? অবশ্য উত্তর দেওয়া না–দেওয়া তোমার ইচ্ছা,
হুম্‌ বলো...
ওই দিন তোমার বেরিয়ে আসার কথা বাড়ি থেকে। হয়তো আমাকে তোমার যোগ্য মনে হয়নি, তাই আসোনি, ঠিক আছে। যোগ্য পাত্রের গলায় মালা দিয়েছ, সুখে আছ। তাহলে চিরকুট দুটো বয়ে বেড়াচ্ছ কেন এখনো?

ইমিরা চুপ থাকল কিছুক্ষণ, তারপর বলল...
ওই দিন আমার আর নাহিদার কথোপকথন আম্মু আড়ি পেতে শুনে ফেলেছিল। এরপর নাহিদা যাওয়ার পরে আমার ঘরে এসে দরজা লাগিয়ে দিয়ে বলেছিল, আমি যদি পালিয়ে যাই তোমার কাছে, তাহলে সে আত্মহত্যা করবে। আর ওই বাড়ির দরজা চিরদিনের জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। আমার তখন যে বয়স, আমি আর সাহস পাইনি। এখন বলো, এ কথার পরে পালিয়ে গিয়ে কি আমরা সুখে থাকতাম? আর আম্মু কিছু করে ফেললে তো আত্মীয়স্বজন সব আমাকেই দোষ দিত।
আবারও সুনসান দুপাশেই।
অয়ন বলল, এখন সুখে আছ?
তোমাকে কষ্ট দিয়েছি, কীভাবে সুখে থাকি?
এখন তোমার বাসায় তোমার অনেক জায়গা আছে?
নাহ, তা–ও নেই।
তুমি আমাকে একবার ফোন করে জানাতে পারতে?
কী হতো তাহলে?
সেটা আমি বুঝতাম, দরকার হলে আমার মা-বাবাকে পাঠাতাম, ওনারা তোমার মা–বাবার মতো নন।

তুমি আমার আম্মুকে এখনো বুঝতে পারোনি, থাক বাদ দাও। এখন এসব পুরোনো কথা তুলে কী হবে?
কিছু তো আর আগের মতো হবে না।
তাহলে এখন আসো আমার কাছে...
সেটাই–বা কীভাবে হয়?
কেন হবে না, আমাদের জীবন কোনো জীবন না?
শুধু তোমার মায়ের জীবনটাই সব?
তুমিই তো চিরকুটে লিখেছিলে,
‘অপেক্ষা করছি, যেন প্রতিটা মুহূর্ত স্বপ্নময় হয় আমাদের।’
তাই হয়তো আমরা একে অপরের স্বপ্নতেই রয়ে গেছি, স্বপ্নময় হয়ে।
আমি এখনো অপেক্ষা করছি...
ইমিরার ফুঁপিয়ে কান্না এল
অয়ন বলল, ‘চলো পালিয়ে যাই আমরা।’
ইমিরা কাঁদতে কাঁদতে ফোনের লাইন কেটে দিল।