চিরঞ্জীব সালমান শাহ

সালমান শাহ
ছবি: সংগৃহীত

সালমান শাহ! নামটার মধ্যেই পরিচয় নিহিত। তাঁকে আর আলাদাভাবে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। আমরা যারা গত শতকের প্রজন্ম, তাদের কাছে তিনি ছিলেন স্টাইল আইকন। তাঁর মতো করে পোশাক পরা, কথা বলা, মনের মানুষকে নিজের মনের কথা বলা—এমন আরও কত রকমের নেশা ছিল আমাদের। আমরা তখন সবে প্রাথমিকের ধাপ পেরিয়ে মাধ্যমিকে ভর্তি হয়েছি, তখন পর্যন্ত ভারতের হিন্দি বা বাংলা সিনেমার নায়কেরাই আমাদের স্বপ্নের নায়ক ছিলেন। এরপর ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশে হাজির হয়েছিলেন সালমান শাহ।

কেয়ামতের পর যেমন সৃষ্টিকর্তা আবার সবকিছু নতুন করে সৃষ্টি করবেন, লিখবেন নতুন এক ইতিহাস, সালমান শাহও যেন লিখলেন বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের নতুন ইতিহাস।

আমরা তখন অষ্টম শ্রেণিতে পড়ি; কুষ্টিয়ার বাণী সিনেমায় এসেছিল সেই ছবি। যে মানুষ একবার সেই ছবি দেখেছেন, তিনি বারবার সেটি দেখেছেন এবং নিজেদের মধ্যে আলাপ করেন, কে কতবার দেখেছেন। আমার যত দূর মনে পড়ে, এই একটা সিনেমা চলেছিল প্রায় দেড় মাসব্যাপী।

আমাদের ছোটদের হলে যাওয়ার কোনো উপায় ছিল না। তাই আমরা বড়দের গল্প শুনতাম আর মনে মনে সেই নায়কের ছবি আঁকতাম। এর কিছুদিনের মধ্যেই বের হয়ে গেল সালমান শাহের বিভিন্ন ধরনের ভিউকার্ড। সেই ভিউকার্ড দেখে আমরা তাঁকে চিনেছিলাম। সেই নায়কের সবকিছুই কেন জানি আমাদের কাছে একেবারে আনকোরা মনে হতো।

সালমান শাহকে এরপর দেখেছিলাম ভিসিআরের পর্দায়। তখন বুঝেছিলাম, সারা দেশের মানুষ কেন তাঁর অভিনয়ে মজেছে। সালমানের সবকিছুই ছিল অনন্য। ভিসিআরের পর্দায় দেখে দেখে তখন সব ছেলেই নিজেকে কমবেশি সালমানে রূপান্তর করতে উঠেপড়ে লেগেছিল। আমার মনে আছে, তখন রাস্তাঘাটে প্রায়ই তাঁর মতো করে কপালে রুমাল বাঁধা যুবক বা কিশোরের দেখা মিলত। অনেকেই তাঁর মতো করে মাথায় হ্যাট বা চোখে সানগ্লাস পরত।

আমার মনে আছে, আমাদের এক সহপাঠিনীকে আমাদের স্কুলেরই এক বড় ভাই সালমানের মতো করে প্রেম নিবেদন করেছিলেন। এমনকি সালমানের কোনো একটা ছবির মতো করে তিনি বুকের বাঁ পাশে খোদাই করে আমাদের সেই সহপাঠিনীর নামও লিখেছিলেন। আমি একবার তাঁর বুকের ওপর সেই নাম দেখেছিলাম। সেখানে ঘা হয়ে গিয়েছিল।

সালমান শাহ
সংগৃহীত

তখন রাস্তাঘাটে কিশোর-যুবকনির্বিশেষে সবাই সালমান শাহের সিনেমার গানের কলি গাইতেন। অনেক প্রেয়সীর চাহিদা ছিল তাঁর প্রেমিক পুরুষটি হোক সালমানের মতো স্টাইলিশ। প্রেমিকেরা তাঁদের প্রেমিকাদের সালমানের ভিউকার্ড উপহার দিতেন। সে এক উন্মাদনার সময়।

পুরো বাংলাদেশ যেন মজেছিল সালমানের জাদুতে। তাঁর প্রতিটি সিনেমা যেন ছিল একেকটা জোয়ারের মতো। সেই জোয়ারে ভেসে যেত পুরো বাংলাদেশের জনতা। সারা রাত জেগে ভিসিআরে তাঁর সিনেমা দেখা আমাদের যেন নেশা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তাঁর সিনেমা চলাকালে ঘরের মধ্যে পিনপতন নীরবতা বিরাজ করত। সবাই যেন নিশ্বাস নিতেও ভুলে যেত।

সালমান শাহ নামের সূর্যের উদয় হয়েছিল সেই ১৯৯৩ সালে। আর এখন ২০২৩ সাল। এর মধ্যে গড়িয়ে গেছে ৩০টি বছর। কিন্তু সালমানের আবেদন যেন একটুও কমেনি; বরং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বেড়েছে। এখনো অনলাইন ও অফলাইনে সালমানকে নিয়েই সবচেয়ে বেশি মাতামাতি করে বাংলাদেশের সব বয়সের মানুষ। এখনকার তরুণ প্রজন্ম যারা সালমানের সিনেমা সরাসরি দেখেনি, তারাও ফেসবুক ও ইউটিউবের কল্যাণে দেখে সালমান শাহের সিনেমা আর চমৎকৃত হয়। এখনো ইউটিউবে তাঁর প্রায় সব সিনেমায় প্রচারের তালিকার শীর্ষে আছে। সালমান শাহের স্টাইল এখনো ফিরে ফিরে আসে আমাদের চলচ্চিত্রে, আমাদের জীবনে।

প্রবাসের এই যান্ত্রিক জীবনেও আমরা দুদণ্ড শান্তির আসায় কানে হেডফোন লাগিয়ে শুনি সালমান শাহের সিনেমার সব কালজয়ী গান। আমাদের পরিবারে এখনো সপ্তাহান্তের প্রায় প্রতিটি সকাল শুরু হয় তাঁর সিনেমার গান বাজিয়ে। এখনো ‘সত্যের মৃত্যু নেই’ ছবির ‘চিঠি এল জেলখানাতে অনেক দিনের পর’ যখন বাজে, নিজের অজান্তেই চোখ দুটো ঝাপসা হয়ে আসে।

আর মনের পর্দায় ভেসে ওঠে তাঁর সেই মুখ। এখনো যখন বেজে ওঠে তাঁর ‘স্বপ্নের ঠিকানা’ সিনেমার ‘এই দিন সেই দিন কোনো দিন’ গানটা, তখন আবার মনটা খুশিতে ভরে ওঠে। এ এক অদ্ভুত অনুভূতি। একজন নায়কের অভিনয় মানুষকে ঠিক কতটা মন্ত্রমুগ্ধ করতে পারে, এগুলো তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

এখনো যখন বেজে চলে সালমান শাহের ‘বিক্ষোভ’ সিনেমার ‘বিদ্যালয় মোদের বিদ্যালয়, এখানে সভ্যতারই ফুল ফোটানো হয়’, তখন নিজের অজান্তেই হাতের আঙুলগুলো মুষ্টিবদ্ধ হয়ে আসে। আবার যখন বেজে ওঠে ‘আশা ভালোবাসা’ সিনেমার ‘অবহেলা যতই করো, যতই রাখো দূরে, কণ্ঠ আমার গেয়ে যাবে নিজের আপন সুরে’, তখন অভিনেতা গোলাম মোস্তফার মতো আমাদেরও মুখটা হাঁ হয়ে আসে। আমাদের ঠোঁট কেঁপে ওঠে।

আবার যখন ‘এই ঘর এই সংসার’ সিনেমার ‘আমাদের ছোট নদী চলে বাঁকে বাঁকে’ বেজে ওঠে, তখন যেন আমরা আমাদের শৈশবকে ফিরে ফিরে পাই। ‘অন্তরে অন্তরে’ সিনেমার ‘ভালোবাসিয়া গেলাম ফাঁসিয়া’ বেজে উঠলে আমরা আবার নিজের অজান্তেই যেন হেসে উঠি।

‘সুজন সখী’ সিনেমায় যখন সালমান শাহ গেয়ে উঠছেন, ‘সব সখীরে পার করিতে নেব আনা আনা, তোমার বেলা নেব সখী তোমার কানের সোনা’, তখন যেন নিজের অজান্তেই আমরাও সখীদের আবিষ্কার করি মনের কল্পনার ঘাটে। ‘প্রিয়জন’ সিনেমায় আবার যখন তিনি গাইছেন ‘এ জীবনে যারে চেয়েছি, আজ আমি তারে পেয়েছি’, তখন যেন আমরা আমাদের বাস্তব জীবনের চাওয়া-পাওয়ার মানুষটার কথা মনে করি।

‘তোমাকে চাই’ সিনেমায় সালমান শাহ যখন গাইছেন ‘তোমাকেই চাই শুধু তোমাকেই চাই, এ জীবনে আর কিছু পাই বা না পাই’, তখন মনে হয়, প্রিয়জনকে পেলেই জীবনটা একটা অর্থ খুঁজে পেত। আবার একই সিনেমায় যখন গাইছেন ‘বাজারে যাচাই করে দেখিনি তো দাম’, তখন মনে হয় আসলেই প্রেম অমূল্য।

‘আশা ভালোবাসা’ সিনেমায় যখন গাইছেন ‘প্রেম প্রীতি আর ভালোবাসা, ছোট ছোট কিছু ভীরু আশা’, আহা এ যেন আমাদেরই মনের কথা। তিনি আবার ‘স্বপ্নের ঠিকানা’তে নীল সাগর পার হয়ে প্রিয় মানুষের কাছে আসার কথাও বলছেন। ‘অন্ধ শত্রু’ সিনেমায় আবার বলছেন, ‘তুমি আমার এমনই একজন, যারে এক জনমে ভালোবেসে ভরবে না

এ মন’; আসলেই তো প্রিয় মানুষকে ভালোবাসার জন্য একটা জন্ম অনেক ছোট সময়। আবার যখন ‘মায়ের অধিকার’ সিনেমায় হুমায়ুন ফরীদির সঙ্গে গাইছেন ‘পিঁপড়ায় খাবে বড়লোকের ধন’, তখন যেন আমরা ধনীদের জন্য একধরনের অনুকম্পা অনুভব করি। আমি এখানে সালমান শাহের অভিনীত সিনেমার গানগুলোকে তাঁর গাওয়া বলে উল্লেখ করেছি, কারণ আমার মনে হয়েছে, তিনি ঠোঁট মিলিয়েছিলেন বলেই হয়তোবা গানগুলো অমরত্ব পেয়েছে।

সালমান শাহ তাঁর প্রথম চলচ্চিত্র ‘কেয়ামত থেকে কেয়ামত’-এর প্রথম গানে গিটার হাতে গেয়েছিলেন, ‘বাবা বলে ছেলে নাম করবে।’ আসলেই তিনি বাংলা চলচ্চিত্রে নাম করলেন। এমনই নাম করলেন যে সেটা যুগ যুগ ধরে তাঁকে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মনের মণিকোঠায় জায়গা করে দিল।

তিনি যেন ছিলেন বাংলা চলচ্চিত্রের ধূমকেতু। ধূমকেতু যেমন হঠাৎ আকাশে উদিত হয়, তিনিও তেমনি উদিত হয়েছিলেন। আবার ধূমকেতু দেখে আমাদের ঘোর না কাটতেই তিনি যেন বিদায় নিয়েছিলেন। এখনো তাই আমরা তাঁর ‘তোমাকে চাই’ চলচ্চিত্রের সুরে গেয়ে উঠি ‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।’