অগ্নিতে নগ্নিকা

২০০৮ সালে ইরাকে সংবাদ সম্মেলনে ইরাকি সাংবাদিক মুনতাদর আল জাইদি, জর্জ ডব্লিউ বুশের মুখে জুতা ছুড়ে মেরেছিলেনছবি : টুইটার

ঘটনা দুটো একই দিনে বা একই সময়ে ঘটেছিল। একটা বাগদাদে ঘটল। আরেকটা ঘটেছিল, যতদূর মনে পড়ে, ব্রাজিল বা কলম্বিয়ায়। ইরাকের শহর বাগদাদে সাংবাদিক মুন্তাজার আল জায়েদি ২০০৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর মহাশক্তিশালী দেশের মহাক্ষমতাধর রাষ্ট্রপতিকে পাদুকা ছুড়ে মারলেন। এতে সারা বিশ্ব হইহুল্লোড়, উল্লাস-আনন্দে বেহুঁশপ্রায়। ওই সময় বুশকে জুতা মারা বা বুশের জুতা খাওয়ার (কোনটা শুদ্ধ, পাঠকেরা নিজ মর্জিমাফিক ঠিক করে নেবেন) ঘটনায় মানুষ এমন বুঁদ হয়ে ছিল যে সে সময় অন্য কোনো ঘটনার দিকে ফিরে তাকানোর ইচ্ছা বা হুঁশ কারও ছিল না। কোথায় বুশ আর কোথাকার কোন এক অখ্যাত মডেল মেয়ের বিস্ফোরণে ছিটকে পড়ে অলৌকিকভাবে বেখবর হওয়া। কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা! রাজরাজড়ার সঙ্গে নলখাগড়ার তুলনা কি চলে? চলে না অবশ্যই।

তবে বিস্ফোরণের শিখায় ছিটকে ওঠা মেয়েটির শেষ সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন জায়েদিরই এক দেশি ভাই অ্যারেন নাজ্জার। মডেলে তাঁর আগ্রহ কখনোই ছিল না। তিনিও মুন্তাজারের মতো বুকে সাহস নিয়ে যুদ্ধের ভয়ংকর সব ছবি তুলেছেন। মানুষ যে কত জঘন্য হতে পারে, অ্যারেনের তোলা ছবি দেখে সেটা বোঝা যায়। আবু গারিব বন্দিশালায় কুকুর লেলিয়ে দিয়ে অসহায়, ভীত, সন্ত্রস্ত বন্দীদের প্রস্রাব করিয়ে পৈশাচিক হাসিতে ফেটে পড়া মানুষ নামের কলঙ্ক একদল জঘন্য জীবকে জীবনের মায়া তুচ্ছ করে ক্যামেরাবন্দী করেছেন অ্যারেন। যুদ্ধের ময়দান থেকে শক্তিধর দেশের পতাকায় মুড়ে ফেরত আসা অগুনতি কফিনের ছবি সাক্ষ্য দিচ্ছিল যে ক্ষমতাবান পক্ষেরও মৃত্যু আছে। পৃথিবীর কাছে সে খবর লুকিয়ে রাখার চেষ্টা ব্যর্থ করে দিয়েছিল অ্যারেনের তোলা ছবি। এমন এক সাহসী মানুষ কেন যে গুটিয়ে নিলেন নিজেকে! কেন তিনি মডেলের ছবি তোলায় নিবেদিত হলেন?

তিনি ছিলেন এমন এক মানুষ, যাঁর কাছে ‘আমি’ ও ‘আমার’ শব্দ দুটো গুরুত্ব পায়নি কখনো। তিনি ‘আমাদের’ ও ‘আমরা’ নিয়েই ভাবতে ভালোবাসতেন। সেই অ্যারেন একসময় দেখলেন যে তিনি বড় একা।

যখন হঠাৎ অসুস্থ হলো অ্যারেনের কন্যা। একাকী রুগ্ন সন্তানের বোঝা বইতে বইতে ক্লান্ত অ্যারেনের স্ত্রী চলে গেলেন সন্তানকে এক আত্মীয়ের কাছে রেখে। এ রকম পরিস্থিতি মানুষকে বাধ্য করে পৃথিবীকে ভুলে যেতে, নিজের জন্যই মনপ্রাণ ঢেলে দিতে। স্ত্রীকে দোষ দিতে পারছেন না অ্যারেন। যাঁর স্বামী অগুনতি দিন, সপ্তাহ, মাস ঘরে ফেরার সময় করে উঠতে পারেন না, তিনি কীভাবে একা একা রোগ, দুঃখ, অভাব–অনটনের সংসার পাড়ি দেবেন? অনেক কষ্ট সহ্য করার পর ধৈর্যের বাঁধ ভেঙে গিয়েছিল মেয়েটির। আর কষ্ট করতে তিনি হয়ে উঠেছিলেন অপারগ। এরপর অ্যারেন গুটিয়ে নিলেন নিজেকে। এত দিন সবার জন্য অনেক ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেছেন। আজ তাঁকে শুধুই আত্মচিন্তা করতে হচ্ছে। কী করে নিজের মেয়েকে বাঁচাবেন, চিকিৎসার টাকা কীভাবে জোগাড় হবে, এসব চিন্তায়ই পাগলপারা অবস্থা তাঁর।

কাজ তো অ্যারেন একটাই জানেন। সেটা হলো, ছবি তোলা। এই ছবি তুলেই টাকা রোজগারে নামলেন। যদিও ছবিগুলোয় আগের মতো আর অন্তরের দরদ মেশানো থাকে না। ছবিতে সত্য প্রকাশ ও জীবনের শৈল্পিক বিকাশ সন্ধানের ইচ্ছা বড় কষ্টে বাদ দিলেন তিনি। ছবির শিল্পমূল্য নয়, বাণিজ্যিক মূল্যের সুলুকসন্ধান হলো তাঁর আরাধ্য। গুণী ছবি তুলনেওয়ালার ছবি ভালো দামে বিকিকিনি শুরু হলো। অর্থসমাগম হলো প্রচুর। নিজের কন্যাকে বিখ্যাত মাউন্ট সিনাই হাসপাতালে ভর্তি করার পর ভাবলেন, কন্যার উন্নত চিকিৎসার টাকা জোগাতে তাঁর ভেতর বাস করা শিল্পী আত্মাহুতি দিল। এই হাসপাতালের নামই শুধু পর্বত সিনাই নয়, আসলেও এর অবস্থান এত উঁচুতে যে সাধারণ মানুষের পক্ষে এখানে পৌঁছানো পর্বতে আরোহণের সমান প্রায়। এ–ও একটা ব্যবসা। জগৎজুড়ে ব্যবসারই জয়জয়কার। যে যত ব্যবসাবুদ্ধির ধান্দা বের করতে পারবে, তার কপালেই জুটবে সব বাহ্বা। সে ব্যবসায় মানুষের অপকার হলেও কিছু যায়–আসে না, মুনাফা উঠলেই হলো।

টাকার চিন্তা মাথায় রেখেই মডেল মেয়ের ছবি তুলে বিক্রির পরিকল্পনা করেন অ্যারেন। তবে এতে যে কারও কোনো অপকার হবে না, তা তিনি জানতেন। সাধারণ মানুষের উপকারও যে হবে না, সে বিষয়েও অ্যারেন ছিলেন নিশ্চিত।

মেয়েটিকে তখনো মিডিয়ার আলোয় আনা হয়নি। ‘আসছে’, ‘আসছে’, ‘অত্যাশ্চর্য মেয়ে এক আসছে’ প্রচার চালিয়ে মেয়েটির এজেন্ট মিডিয়ার ময়দান গরম করে তুলল। ব্যবসায়ীরা হন্যে হয়ে পথ খুঁজছেন, কে আগে মেয়েটিকে বাজারে নামাবেন তাঁর পণ্য বিপণনের জন্য। ষড়যন্ত্র চলছে, কে মেয়েটিকে আগে দখলে নিতে পারবেন, কার পণ্যের জন্য মেয়েটি দাঁত কেলাবেন, উরু উন্মোচন করবেন, বিবসনা হবেন প্রায়। এজেন্টের কাছে দরখাস্ত জমা পড়ছে গাদা গাদা।

অ্যারেনও একটি আবেদনলিপি জমা দেন মডেল মেয়েটির ছবি তোলার ইচ্ছা ব্যক্ত করে। উদ্দেশ্য জানাতে দ্বিধা করেননি। অসুস্থ সন্তানের চিকিৎসার টাকা জোগাতে ছবিগুলো তিনি বিক্রি করবেন। বিনিময়ে মেয়েটির পছন্দমাফিক কিছু ছবি তুলে উপহার দেবেন তাঁকে। অ্যারেনের আবেদনও অর্থচিন্তা থেকেই উদ্ভূত। তবে তা একক ব্যক্তির অন্তহীন মুনাফার পিপাসায় নয়। এ অর্থ মানবিক প্রয়োজনে, মুনাফার প্রসারণে নয়।

মেয়েটির অলৌকিক সৌন্দর্য থেকে মনকাড়া শিল্প তৈরির বদলে তাঁকে বাজারের জন্য লাভজনক পণ্যে পরিণত করতে মরিয়া হয়ে ওঠে লোভী মানুষেরা। তাঁর অতুলনীয় রূপই তাঁর জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। অনেক মেয়েই কর্মে–কীর্তিতে নয়, শুধু দর্শনীয় হয়ে সবার মনোযোগের কেন্দ্রে থাকতে পারলেই নিজেকে ধন্য মনে করেন, তাঁদের জীবনের একমাত্র সাধনাও তা–ই। এই মেয়ে তা চাননি। ফলে যত ঝুট–ঝামেলা তাঁর কপালে লেখা। মেয়েটি বুদ্ধিমতী; সে জন্য তাঁকে ঘিরে অর্থকেন্দ্রিক অর্থহীন কর্মকাণ্ড দেখে ত্যক্ত–বিরক্ত। সবাই তাঁকে নানা মূল্যে কিনে নিয়ে বিজ্ঞাপনের মুখ করতে চান। সবার আবেদনের সারকথা একটাই—কী মূল্যে তিনি তাঁর সৌন্দর্য বেচবেন? অ্যারেনের আবেদন অন্য রকম। তাতে তিনি সাড়া দিলেন সাগ্রহ। কারণ, তিনি ভেবে দেখলেন যে এটি একটি ভালো ও মহৎ কাজ। তাঁর সুন্দর চেহারা এক অসুস্থ মানুষকে সুস্থ করার জন্য অর্থ জোগাড়ে সাহায্য করবে! এই প্রথম সুন্দর চেহারার অধিকারী হওয়ার জন্য স্রষ্টার কাছে তিনি কৃতজ্ঞ হলেন। যদিও বাণিজ্য, তবে তা মঙ্গলের জন্য। এখানে তিনি দাতা, বিক্রেতা নন।

পাহাড়ের উঁচুতে কনভেশন সেন্টারে নতুন মডেলের বোধন। কনভেশন সেন্টারের মনোরম জমকালো চত্বরের রংবেরঙের ছোট ছোট ছাতার নিচে পৃথিবীর নামীদামি মিডিয়া সাংবাদিক, ফটোসাংবাদিকেরা গিজ গিজ করছেন। সূর্য অস্তাচলের পথে প্রায়। সন্ধ্যা নামলে পাহাড়ি অঞ্চলে মনোহারী যে স্নিগ্ধতার আবেশ ছড়াবে, তখন অনুষ্ঠান শুরুর বাঁশি বাজবে। তখনই অপেক্ষারত আমন্ত্রিত লোকজন প্রাসাদপ্রতিম সেন্টারে প্রবেশ করবেন।

এরই মধ্যে সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে অ্যারেনকে দেখা গেল কনভেনশন সেন্টারের সদর দরজা দিয়ে বেরিয়ে আসতে। তাঁকে যাঁরা চেনেন, তাঁরা অবাক হয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। অ্যারেনের ছবি অসাধারণ, তাঁর শৈল্পিক পারঙ্গমতাকে তাঁরা ঈর্ষা যেমন করেন, তেমনি আবার অ্যারেনের বৈষয়িক বুদ্ধিহীনতাকে সমানভাবে অবজ্ঞাও করেন। নিজের দক্ষতাকে আবেগতাড়িত হয়ে শিল্প সৃষ্টিতে ব্যয় না করলে তাঁদেরই মতো নামজাদা সংস্থার হোমড়াচোমড়া একজন হয়ে তিনি এখানে আসতে পারতেন। যত দক্ষই হন না কেন, এ রকম উদাসীন এলোমেলো সাজসজ্জায় পরিচয়হীন একজনকে ওই রকম চোখঝলসানো অনুষ্ঠানে কার দায় পড়েছে যে ডাকবেন?

অ্যারেন সবার চোখের আড়ালে এসে রেলিংয়ে ঝুঁকে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ভাবছিলেন মেয়েটির কথা। প্রকৃতি ও স্রষ্টার নিজেদের সব মাধুরী ঢেলে সৃজিত শিল্প যেন একটি। তবে এ মাধুরী জীবন্ত, চলমান। মেয়েটিকে দেখলে মানুষের অন্তরের নান্দনিক সৌন্দর্য দর্শনের যে তৃষ্ণা, তা পূর্ণ হবে। স্রষ্টা যেন সব মহাদেশের মেয়েদের বৈশিষ্ট্য থেকে একটু একটু করে নিয়ে মেয়েটিকে গড়েছেন। আফ্রো মেয়ের ঋজুতা, এশিয়ান মেয়ের কোমলতা, ক্যারিবীয় মাদকতা, ঊষর মরুভূমির মেয়ের আগ্নেয় দীপ্তির সঙ্গে ইউরোপীয় বালিকার আত্মপ্রত্যয়ের মিশেল যেন তিনি।

অ্যারেনকে মেয়েটি জানালেন, ‘বোরকা আর বিকিনিওয়ালা দুই দলই আমাকে চাইছে!’

বিস্মিত অ্যারেন প্রশ্ন করলেন, কেন?

—ধরুন, আমি যদি বোরকা পরি, তবে বিকিনির বিজ্ঞাপনের মডেল কমে গেল একজন। আমি বিকিনি পরে হাজির হলে ক্রেতা অনেক টানবে, নয় কি? বিজ্ঞাপিত পণ্য সেরা পণ্য। আর সে পণ্যের মুখ যদি আমি হই, তবে তো কথাই নেই।

একটু দম নিয়ে আবার তিনি বললেন, ‘মানুষ বিজ্ঞাপনের বশ। অনবরত বলা হচ্ছে, যদি অমুক কোম্পানির জুতা না পরো, তমুক কোম্পানির গাড়ি না চড়ো, তো জীবনটাই বৃথা। এর ভেতর আমার মতো মডেলকে দিয়ে যদি এসব বলানো যায়, তখন তো নিজের পছন্দ আর রুচি ভুলে মানুষ বিজ্ঞাপনের আজ্ঞাবাহী দাস হয়ে যাবে।’

এর ভেতর মেয়েটি অ্যারেনের সোয়েটারটা একঝলক দেখে নিয়ে বললেন, ‘তোমার সোয়েটারটা সুন্দর তো! কোন ব্র্যান্ডের এটা?’

অ্যারেন বলেন, ‘আমার স্ত্রী বুনেছে আর আমি ব্র্যান্ডের নামের জন্য পাগল নই। একটা হলেই হলো।’

—মানে! তবে কি আপনি টমি হিল ফিগার ব্র্যান্ডের জামাও পরবেন? যাঁরা তাবৎ কালো মানুষকে অপমান করেছে এই কথা বলে যে তারা কালোদের জন্য পণ্য তৈরি করে না। কালো মানুষকে ক্রেতা ভাবতেও ওদের ঘেন্না করে! ওই দেখুন, তাদের দরখাস্ত আমি ছিঁড়ে ফেলে দিয়েছি।

অপূর্ব সুন্দর তর্জনী, তার চেয়ে মনোরম ভঙ্গিতে উত্থিত হয়ে কাগজ ফেলার ঝুড়ি দেখিয়ে দিল।

—আমি জানি এটা ভালো করেই। শুনে ভালো লাগছে যে আপনি ওদের পণ্যকে সমর্থন করছেন না। হাসি পায়, যখন দেখি কালো ও বাদামি চামড়ার লোকেরা ওই টমি হিল ফিগারের জামা পরে, ব্যাগ হাতে নিয়ে নিজেদের বিত্তের বিজ্ঞাপনে ব্যাকুল হন।

মেয়েটি তখন বিষাদ মাখা কণ্ঠে বললেন, তখন তাঁদের আত্মসমন্বয়হীনতা আর মূর্খতাও যে বিজ্ঞাপিত হয়, তা তাঁরা বোঝেন না।

ধীরে ধীরে এবার তিনি নিজের মনেই বললেন, ‘করপোরেট দানবদের পছন্দমতো না চললে ওরা আমাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে পারে, তা জানেন কি?’

মনে মনে অ্যারেন বলেছিলেন, বিশ্বায়নের যুগে মাল্টিন্যাশনাল করপোরেটকে রাগালে দেশের সরকারকে পর্যন্ত গদিছাড়া করে ক্ষান্ত হয় তারা আর আপনার মতো ক্ষমতাহীন একজন মডেলের কপালে কী ঘটবে কে জানে?

সূর্য যেই ডুবল, অ্যারেন রেলিংয়ের কাছ থেকে সরে এলেন। বাইরে কেউ আর নেই এ মুহূর্তে। তখনই প্রচণ্ড শব্দে চারপাশ কেঁপে উঠল। কনভেনশন সেন্টারের প্যাগোডার চূড়ার মতো ছাদ ফেটে আগুনের শিখা দাউ দাউ করে জ্বলে উঠল। সেই জ্বলন্ত শিখার শীর্ষে চড়ে এক নগ্নিকার দেহরেখা ছিটকে বেরিয়ে আকাশে যেন মিশে যেতে লাগল। কোনো ফ্যাশন ডিজাইনারের তৈরি পোশাক নয়, আগুনের শিখা পরম মমতায় তার সবটুকু লজ্জা ঢেকে রাখল। অ্যারেন কী ভেবে যেন এই ছবি আর তুললেন না।