ভিয়েতনামে আমার ঈদ
একেবারে হুট করেই সিদ্ধান্ত হলো এবার আমরা ভিয়েতনামে বাবার সঙ্গে ঈদ করব। মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর পদে ২০২১ সাল থেকে ভিয়েতনামে অবস্থান করছেন বাবা। আমার ১৪ বছরের জীবনে অসংখ্য ঈদ বাবাকে ছাড়াই উদ্যাপন করেছি। বাবা ছাড়া ঈদের সব মজাই যেন মাটি হয়ে যায়! আগে ঈদের সময় কাছে না পেলে বাবার ওপর খুব অভিমান হতো। ঈদের সময় বেশ কিছুদিন স্কুল ছুটি থাকে এবং বাবার সঙ্গে সময় কাটাতে পারি। এ সময় যদি বাবা না আসে তাহলে তো ঈদের সালামি, ঘোরাঘুরি, একই ড্রেস পরা (ম্যাচিং), ছবি তোলা সবকিছুর মধ্যেই ফাঁক থেকে যায়।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী গত ৪ এপ্রিল ইন্ডিগো এয়ারলাইনসে বিকেল পাঁচটার ফ্লাইটে আমরা কলকাতার উদ্দেশে রওনা হই। কলকাতায় আমাদের দুই ঘণ্টার লে-ওভার ছিল। আমরা সিকিউরিটি চেকিং শেষে লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করতে থাকি। আমাদের ফ্লাইট ছিল ২০.৩০ অর্থাৎ সাড়ে আটটায়। আম্মু এক বাঙালি আন্টির সঙ্গে গল্প জুড়ে দেন। তিনি আহসানউল্লাহ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। এক কনফারেন্সে ভিয়েতনাম যাচ্ছেন। আমরা ভেবেছিলাম ২০.৩০ মানে সাড়ে দশটা। হঠাৎ আম্মুর মোবাইলটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতে করতে টাইম ফরমেট ২৪ ঘণ্টায় করে দিয়ে দেখতে পেলাম, যে এখন ২০টা অর্থাৎ আটটা বাজে।
তখন আমরা বুঝতে পারি যে আমরা কী ভুল করেছিলাম! আমরা মনে করেছিলাম ২০.৩০ মানে সাড়ে দশটা। আমরা দৌড়াতে দৌড়াতে বোর্ডিং গেটের কাছে গিয়ে স্ক্রিনে দেখতে পেলাম আমাদের ফ্লাইট এক ঘণ্টা লেট। তা না হলে হয়তো আমাদের সেদিন যাওয়াই হতো না। বাবা আমাদের জন্য ভিয়েতনামের হো চি মিন বিমানবন্দরে অপেক্ষা করছিলেন। সেখান থেকে রাত তিনটার দিকে সোজা ভিনহোমস সেন্ট্রাল পার্কে ‘ল্যান্ডমার্ক প্লাস’ বিল্ডিংয়ের উনিশ তলায় বাবার বাসায় পৌঁছাই।
বাংলাদেশে যেদিন ঈদ পালন হয়, ভিয়েতনামেও সেদিন ঈদ পালিত হয়। ঈদের আগের রাতে বাবা আমাদের জানান, আমরা নামাজ পড়তে হো চি মিন সেন্ট্রাল মসজিদে যাব। জামাত শুরু হবে সকাল আটটায়। আমরা সকালে ফজরের নামাজ পড়ে আর ঘুমালাম না। আম্মু সেমাই ও অন্যান্য রান্না শুরু করে দিলেন। আমরা গোসল করে সবাই একই রকম জামা পরে মসজিদের উদ্দেশে রওনা হলাম। বাসা থেকে মসজিদ গাড়িতে ২০ মিনিটের পথ।
ঈদে বাংলাদেশের সর্বত্র যেমন উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করে, সেখানে তেমনটি নয়। স্কুল-কলেজ-অফিস সবই খোলা। আমরা যে মসজিদটিতে নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম, সেটিও বেশ পুরোনো। কিছু রঙিন কাগজ দিয়ে সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে মসজিদটি। ভারত, পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মুসলিমরা ওই মসজিদে ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছিলেন, তবে বাংলাদেশিদের সংখ্যাই ছিল সবচেয়ে বেশি। মসজিদে মেয়েদের জন্য আলাদা নামাজের স্থান রয়েছে। সেখানে জীবনে প্রথমবারের মতো ঈদের নামাজ পড়ি।
আমার ছোট বোন ও মা–ও নামাজ পড়েন। ঈদের দিন সেখানে অনেক মেয়েরা নামাজ পড়তে যান। ছোট বোন ও আমি সঙ্গে করে চকলেট নিয়ে গিয়েছিলাম। নামাজের পর মসজিদে আসা ছোট ছেলে-মেয়েদের মাঝে চকলেট বিতরণ করি। বাবা ও মা সবার সঙ্গে কোলাকুলি ও শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। আধা ঘণ্টার মধ্যেই পুরো মসজিদস্থল ফাঁকা হয়ে যায়। চলে আসার আগে আমরা বাংলাদেশিরা একসঙ্গে বাংলাদেশের পতাকা ধরে ছবি তুলি।
ভিয়েতনামে ঈদ বলতে শুধু এটুকুই। একসঙ্গে নামাজ পড়েই সবাই যে যাঁর মতো অফিস, আদালত, স্কুল, কলেজসহ কাজে ফিরে যান। ঈদকে ঘিরে বাংলাদেশে যেমন সব ধর্মের মানুষের মধ্যে একটি উৎসব উৎসব ভাব বিরাজ করে, সেটি সেখানে নেই। মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় অনুষ্ঠান যেন শুধু নামাজের মধ্যেই সীমাবদ্ধ।
পরে বাবার কাছে জেনেছি, হো চি মিন শহরে ৪-৫ টি মসজিদ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে পুরোনো মসজিদটিই হলো হো চি মিন সেন্ট্রাল মসজিদ, যেটাতে আমরা ঈদের নামাজ পড়তে গিয়েছিলাম। ১৯৩০ সালে ভারতীয় মুসলিমরা সেটি নির্মাণ করেছিলেন।
আমি বাংলাদেশের কোনো মসজিদে কখনো নামাজ পড়তে যাইনি। কখনো ঈদের নামাজও পড়া হয়নি। তাই এ অভিজ্ঞতা আমার জন্য ভিন্ন ছিল। জীবনে প্রথমবারের মতো ঈদের নামাজ পড়ে নিজের মধ্যে অন্য রকম অনুভূতি কাজ করছিল।
ঈদের নামাজ পড়ে আমরা ভিয়েতনামে বসবাসরত বাবার এক বন্ধুর বাসায় বেড়াতে যাই। সেখানে দুপুরে খেয়ে বেরিয়ে পড়ি প্রায় ৩৫০ কিলোমিটার দূরত্বের পাহাড়ি শহর দালাতের উদ্দেশে।
লেখক: রিসানা জাইয়ান জারা, অষ্টম শ্রেণি, হলি ক্রস বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, ঢাকা
দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল অ্যাড্রেস: [email protected]