নিউইয়র্কের নিউ ইয়ার উদ্যাপন-২০২৫
একটি বছর শেষ হয়। নতুন আরেকটি বছর আসে। আর এ দুইয়ের মধ্যে খুব আকর্ষণীয়ভাবে থাকে ‘নিউ ইয়ার্স ইভ সেলিব্রেশন’। বলা হয়, নিউইয়র্কের টাইম স্কয়ারের নিউইয়ার্স বল ড্রপ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে আলোচিত এবং বিখ্যাত আয়োজন। যা হয়ে থাকে ৩১ ডিসেম্বর রাত ১১টা ৫৯ মিনিটে। কিন্তু এর সমারোহ চলতে থাকে ৩০ ডিসেম্বর থেকেই।
আমার প্রায় ২৪ বছরের আমেরিকায় থাকার পরও এবার এ সময়ে প্রথমবার নিউইয়র্কে আসা। আমেরিকার যেকোন শহরের মতো এখানেও হলিডে ভাইব শুরু হয় নভেম্বর থেকে। প্রথমে হ্যালোইন, থ্যাংকস গিভিং, তারপর ক্রিসমাস আর নিউ ইয়ার্স। বলাবাহুল্য নিউইয়র্কের ম্যানহাটানসহ সারা শহরের আয়োজন অন্য শহরের থেকে অনেক বেশি থাকে। আলো ঝলমল যেন এক ফ্যান্টাসি রূপকথার জগৎ। আমরা ছুটি কাটাতে এখানে আসি ক্রিসমাসের আগের দিন। এ শহরের শীত বেশি, গাড়ি বেশী। সঙ্গে নানান ভাষা, কালচারের নানান বর্ণের মানুষ। ট্রাফিক জ্যাম চরম। হর্ন, গাড়ির শব্দ শহরের নিচ দিয়ে চলা সাবওয়ের আওয়াজ আর ধোঁয়া কিন্তু তার মধ্যেও সবচেয়ে বেশি মনে হয়েছে সবার মধ্যে হলিডে স্পিরিট। বর্ণবাদ আছে কোনা চিপায়, সঙ্গে আছে সবার মধ্যে সহাবস্থানের মনোভাব। আমরা হোটেল নিলাম টাইম স্কয়ারেই। যার ভাড়া অন্য সময়ের চেয়ে ৫ থেকে ৬ গুণ বেশি। যেখান থেকে সরাসরি বল ড্রপ দেখতে পারার কথা। সেই আশাতেই বাড়তি টাকা গোনা।
কিন্তু না। এত সহজ না। ৩১ তারিখ সকাল থেকে চারদিকে ‘রোড ব্লক’। একধরনের ব্যরিকেড দেওয়া হচ্ছে। বেশির ভাগ রোডে গাড়ি চলাচল বন্ধ। সেভেনথ এভিনিউ অর্থাৎ টাইম স্কয়ারের মূল রোডটিতে মানুষ চলাচলও বন্ধ। যদি কেউ সেখানে কাজ করে। বাসা আছে অথবা হোটেল থাকছে, তাহলে উপযুক্ত প্রমাণপত্র দেখিয়ে ঢোকা যাবে। চারদিকে শত শত এনওয়াইপিডির (NYPD) পুলিশ অফিসার আর গাড়ি। দুপুরের দিকে ভয়ই লাগল। ভাবলাম, নিচে তো নামতেই পারব না। হোটেলের জানালা দিয়ে ছিটেফোঁটা যা দেখতে পারি, দেখব।
বুঝতে পারছিলাম, বিশাল এক আয়োজন হতে যাচ্ছে। সে আয়োজনটি শুরু হয়েছিল ১৯০৭ সালে। গত ১১৭ বছরে এবারের আয়োজটি ছিল ১১৫তম। কারণ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ১৯৪২ ও ১৯৪৩ সালে ২ বছর যুদ্ধকালীন ব্ল্যাকআউটের জন্য এটি হয় নাই।
বলা হয় চরম ঠান্ডা, স্নো, বৃষ্টি—যাই হোক না কেন। আনুমানিক ১০ লাখ মানুষ এখানে আসেন নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে। ওই দিন, ২ ঘণ্টা পরপর আমি হেটেল থেকে নিচে আসি আর দেখি কি হচ্ছে। পুরো রাস্তায় দিয়ে ব্লকের মতো করা হয়েছে। যেখানে হয়তো কয়েক হাজার মানুষ দাঁড়াতে পারবে। এরপর ক্রস স্ট্রিট খালি রেখে আবার খাঁচা (?)। একটি সময়ের পর থেকে খাঁচাতে মানুষ ভরা শুরু হলো। সিকিউরিটি চেকের পর। বড় কোনো ব্যাগ থাকতে পারবে না। কারও কারও আইডি চেক হচ্ছে। এরপর মানুষ ক্রমশ সামনের দিকে যেতে শুরু করে। স্টেজ তৈরি হয়েছে আগের দিন ৩০ তারিখ রাতেও আমরা অনুষ্ঠান দেখলাম, একদম সামনের সারি থেকে। শত শত ক্যামেরা। হঠাৎ করে আমেরিকার ন্যাশনাল টিভি চ্যানেল ‘সিভিএস’–এর সুন্দরী এক জার্নালিস্ট আমার অভিজ্ঞতা জানতে চাইল। কথাবার্তা চলল প্রায় ৫–৭ মিনিট। যা লাইভে দেখানো হয়েছে। দারুণ লাগলো ব্যপারটি। সব বিখ্যাত পারফর্মাররা অংশ নিবেন। স্টেজের কাছাকাছি যারা যেতে পেরেছে, তারা সকাল ৯টা থেকে লাইনে দাঁড়ানো। তারপরও নেই কোনো ক্লান্তি। আমি যখন নিচে আসি, কর্তব্যরত পুলিশদের সঙ্গে কথা বলি। বিশেষ করে একজন লেডি অফিসার জারা নামে। কি সুন্দর ব্যবহার সকাল পৌনে ৯টা থেকে দায়িত্ব পালন করছেন। চলবে রাত ২টা পর্যন্ত। ওই ১৪ ঘণ্টায় তাঁরা এক মূহুর্তের জন্য বসতে পারবেন না। তবুও কথা বলছেন হাসিমুখে। ততক্ষণে প্রচুর মানুষ চলে এসেছে, ফ্যামিলি বন্ধুরা। সবার সঙ্গে রেইনকোর্ট কারণ রাত ৯টা থেকে বৃষ্টি হওয়ার কথা। হলোও তা–ই। প্রায় দুই ঘণ্টা। তাতে অবশ্য অনুষ্ঠান এক মুহূর্তের জন্যও থামল না। আর কেউ জায়গা ছেড়েও গেল না।
এবারের হোস্ট ছিলো রায়ান সিক্রেস্ট, রিটা ওরা। অনুষ্ঠানে ছিল অ্যান্ডারসন কুপার, অ্যান্ডি সোহেল। অভিনেতা রালফ ফিয়েনস। পারফরমেন্স করেছে ক্যারি আন্ডারউড, মেগান মরোনি, কেডি জনসনসহ আরও অনেকে। তখন যাঁরা দেখতে এসেছিলেন, কথা হচ্ছিল অনেকের সঙ্গে। অন্য শহর থেকে যাঁরা এসেছে। সবাই মোটামুটি প্রথমবার আমাদের মতো। সবার কথা একবার হলেও অন্তত এই আসরে আসা উচিত।
অনেক বাঙালি, পাকিস্তানি, ইন্ডিয়ান মানুষকেও দেখলাম। বাংলাদেশি কয়েকজন মেয়ে দল বেঁধে এসেছে ওই দিনই তাঁরা পড়াশোনার জন্য নিউইয়র্ক এসেছে। তাঁরা এই সুযোগটি হাতছাড়া করতে চাননি।
প্রায় ১০ লাখ মানুষের অংশগ্রহণে ১১টা ৫৯ মিনিটে ‘কাউন্ট ডাউন’ শুরু হলো। আলোর বন্যা ও কনফেটির বৃষ্টিতে নতুন বছর শুরু হলো ‘বল ড্রপ’। অবাক হয়ে দেখলাম, কোনো হট্টোগোল নেই, দৌড়াদৌড়ি কিছু না। যে যার মতো আবার নির্দিষ্ট পথে যাওয়ার পথ ধরেছে। সবাই সবাইকে ‘উইশ’ করেছে। সবার আশা নতুন বছর সবার জীবনেই ভালো কিছু বয়ে আনবে। ২ বছর আগে এ সময়ে লাস ভেগাসে এ আয়োজনটি দেখেছিলাম। কিন্তু সেখানে পরিবেশটি একটুও ভালো লাগেনাই। ড্রাংক হয়ে এদিক–ওদিক মানুষ পড়ে আছে। কিন্তু টাইম স্কয়ারের আয়োজনটি অনেক পারিবারিক মনে হয়েছে। সুশৃঙ্খলে সবাই ছোট বাচ্চা, পরিবার দলেবলে এসেছে।
সবশেষে এসে মনে হয়েছে এ বিশাল আয়োজনটি একবার অন্তত দেখার জন্য একটু কষ্ট করাই যেতে পারে। সবাইকে নতুন বছরের শুভেচ্ছা। হ্যাপি নিউ ইয়ার ২০২৫।
*দূর পরবাস-এ গল্প, ভ্রমণকাহিনি, ভিডিও, ছবি, লেখা ও নানা আয়োজনের গল্প পাঠান [email protected]এ