‘ফুড কনফারেন্স’, আবুল মনসুর আহমেদ ও তৎকালীন বঙ্গসমাজ

এ বইয়ে গল্প আছে সর্বমোট নয়টি—‘ফুড কনফারেন্স’, ‘সায়েন্টিফিক বিযিনেস’, ‘এ আই সি সি’, ‘লঙ্গরখানা’, ‘রিলিফ ওয়ার্ক, ‘গ্রো মোর ফুড’, ‘মিছিল’, ‘জমিদারি উচ্ছেদ’ এবং ‘জনসেবা ইউনিভার্সিটি। প্রতিটি গল্পই সুখপাঠ্য। আবুল মনসুর আহমদের নিজস্ব ভাষাগুণে সাধারণ গল্পও হয়ে ওঠে অনন্য।

এ গল্পগুলো তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ। শব্দচয়ন ও বাক্য গঠন প্রতিটি বিষয়েই লেখকের ভাষা বিষয়ে গভীরতা উপলব্ধি করা যায়। এতে যেমন একাধারে আছে আবহমান গ্রামবাংলার শব্দভান্ডার, পাশাপাশি আছে হিন্দি, উর্দু ও ইংরেজির উপযুক্ত ব্যবহার। আর এ ভিনদেশি শব্দগুচ্ছ ব্যবহার মোটেও দৃষ্টিকটু নয়, বরং উপভোগ্য। এবার গল্পের বিষয়বস্তুর দিকে নজর দেওয়া যাক।

গল্পের বিষয়বস্তু যা–ই হোক না কেন, এ গল্পগুলোর প্লট আমাদের চিরচেনা। গল্পের প্রতিটি চরিত্র জীবন্ত। আমরা নিত্যই এদের আমাদের আশপাশে দেখি। তাদের দ্বারা প্রতারিত হই। আবুল মনসুর আহমদের বিশেষত্ব হচ্ছে, তিনি তাঁর মর্মবেদনাকে নাকি কান্নার মাধ্যমে উপস্থাপন না করে হাস্যরসের মাধ্যমে উপস্থাপন করেছেন। যার ফলে গল্পগুলো পড়তে গিয়ে পাঠকের মনে এক অদ্ভুত পরিস্থিতি তৈরি হয়।

তিনি একদিকে যেমন গল্পের মানুষের ভোগান্তিতে আহা–উহু করে ওঠেন, অন্যদিকে আবার হেসে ওঠেন ব্যঙ্গবিদ্রূপের কারণে। আর এ গল্পগুলোর প্রায় সব কটিই লেখা হয়েছে সমাজে ভোগান্তি সৃষ্টিকারী মুষ্টিমেয় মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে। যার ফলে তাদের মনস্তাত্ত্বিক দিকগুলো বিস্তারিতভাবে উঠে এসেছে।

‘ফুড কনফারেন্স’ গল্পের শুরুটা এমন, ‘দেশে হাহাকার পড়েছে; কারণ নাকি খোরাকির অভাব। সে হাহাকার অবশ্য ভদ্রলোকেরা শুনতে পাননি। ভাগ্যিস অভুক্ত হতভাগ্যদের গলায় চিৎকার করে কাঁদবার শক্তি নেই।’ মাত্র দুটো লাইনে কী চমৎকারভাবে সমাজের বৈপরীত্য ফুটে উঠেছে! এরপর আরও বিস্তারিতভাবে তৎকালীন বঙ্গসমাজের চিত্র ফুটে উঠেছে।

এরপর ভদ্রলোকদের ব্যঙ্গ করে লিখেছেন, ‘কিন্তু অভুক্ত কংকালসার আধ-ল্যাংটা হাজার হাজার নর-নারী প্রাসাদশোভিত রাজধানীর রাস্তাঘাটে কাটার করছে। তাতে রাস্তার সৌন্দর্য নষ্ট হচ্ছে। এসব রাস্তায় আগে-আগে গাউন শাড়ী পড়া পরীর ভিড় হতো। আর আজ কিনা সেখানে অসুন্দর অসভ্য কুৎসিত অর্ধোলংগ স্ত্রীলোকেরা ভিড় করছে! কি অন্যায়!’

এরপর যখন ফুড কনফারেন্সের সভা বসল, তখনকার বর্ণনা দিতে লেখক লিখেছেন, ‘সভাপতি হলেন শেরে-বাংলা। শেরে-বাংলার উভয় পাশ ঘেঁষে মঞ্চের উপর বসলেন সিংগিয়ে বাংলা, মহিষে-বাংলা, গরুয়ে বাংলা, টাট্টুয়ে-বাংলা, গাধায়ে বাংলা, খচ্চরে-বাংলা, কুত্তায়ে-বাংলা, পাঠায়েবাংলা, বিল্লিয়ে বাংলা, বাজিয়ে বাংলা, শিয়ালে বাংলা, খাটাসে বাংলা, বান্দরে বাংলা এবং আরও অনেক নেতা।

এছাড়া ইন্দুরে বাংলা, চুঁহায়ে বাংলা, ফড়িং-এ বাংলা, পোকায়ে-বাংলা, মাকড়ে বাংলা এবং চিউটিয়ে বাংলারাও বাদ যাননি। তারাও মঞ্চের দু’পাশে ও সামনে চেয়ার পেতে সভা উজালা করে বসেছেন। হাতীয়ে-বাংলা অতিরিক্ত মাত্রায় কলার রস খেয়ে বিভোর হয়ে পড়েছিলেন। তাই স্বয়ং আসতে না পেরে বাণী পাঠিয়েছেন।’ এ বিবরণ পড়ে যে বিষয় আমার মাথায় এসেছে, সেটা হলো মানুষের সংকট নিরসনের জন্য সব জন্তুজানোয়ার একত্র হয়েছে।

কোনো মানুষ সেখানে স্থান পায়নি। আসলেই আবহমানকাল ধরে বঙ্গদেশের মানুষের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ যাঁরা করে গেছেন, তাঁদের মধ্যে কখনোই মনুষ্যত্ব ছিল না। এ গল্পের শেষে লেখক সেটা আরও পরিষ্কার করে উচ্চারণ করেছেন—জানোয়ারে বাংলা জিন্দাবাদ, মানুষে বাংলা মুর্দাবাদ।

পরের গল্প ‘সায়েন্টিফিক বিযিনেস’ আসলে বঙ্গসমাজের ব্যবসায়ী হয়ে ওঠার গল্প এবং সেই ব্যবসার ধরন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা। সেটা অবশ্যই লেখকের নিজের ভাষায়। সেই ব্যবসার ধরন সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে লেখক লিখেছেন, ‘শুধু “ব্যবসার জন্য ব্যবসা” করাকে এরা আত্মার অধঃপতন মনেকরে। এরা “ধর্মের জন্য ব্যবসা”, “সেবার জন্য ব্যবসা”, “দেশপ্রেমের জন্য ব্যবসা”, “কৃষ্টি সভ্যতা ও মানবতার জন্য ব্যবসা” করে ব্যবসার আধ্যাত্মিক রূপায়ণের পক্ষপাতী।’ এরপর যখন ‘নিখিল বঙ্গ বণিক-সংঘ’ গঠিত হলো, তার পরের অবস্থার বর্ণনা দিয়েছেন, ‘কেরানির জাট বাঙালি রাতারাতি ব্যবসায়ীর যাতে পরিণত হল।

অফিস-আদালত, স্কুলে-কলেজে, মন্দিরে-মসজিদে, মাঠে-দরগায়, হাসপাতালে-এতিমখানায়, বাড়িতে-বাজারে, হাটে-মাঠে, রাস্তায়-ঘাটে, ঘরে-বাইরে ব্যবসার বিপুল বন্যা প্রবাহিত হল। বিনা-লাভে কেউ কোন কাজ করে না। ...গতিক ক্রমে এমন দাঁড়াল যে, অগ্রিম গহনা-শাড়ির ওয়াদা না করলে স্ত্রী স্বামীকে বিছানায় উঠতে দেয় না। লাটিম, ঘুড্ডি ও ট্রাইসাইকেলের প্রতিশ্রুতি না দিলে ছয় বছরের শিশু পর্যন্ত পড়াশোনা করতে চায় না।’ এটাকে লেখক বলেছেন, ‘বেড়াই ক্ষেতের ফসল খেয়ে ফেলল। ফলে দেশে দুর্ভিক্ষ হল!’

পরের গল্প ‘এ আই সি সি’ বঙ্গদেশের সংগঠনের গল্প। কত যে অদ্ভুত এবং অসম্ভব উপায়ে আমরা মানুষ ঠকাতে পারি, তার বিশদ বিবরণ আছে এ গল্পে। আর কারাই বা এ ধরনের সংগঠন করতে উৎসুক সে সম্বন্ধেও ধারণা দেওয়া হয়েছে গল্পের শুরুতেই, ‘শহীদ “সম্মানের সহিত” বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি ডিপ্লোমা লইয়া বাহির হইয়া আসিল বটে, কিন্তু চাকরি যোগাড় করিয়া উঠিতে পারিল না। কারণ অনেক চেষ্টা করিয়াও মন্ত্রীদের কারো সংগেই সে কোন আত্মীয়তা প্রমাণ করতে পারিল না।’ এরপর সে সংগঠন তৈরির দিকে মনোযোগ দিল।

কিন্তু বঙ্গসমাজে সব ধরনের সংগঠনের অস্তিত্ব আছে। এমনকি ‘ধোপা, নাপিত, ধাংগর, মেথর ও রাজমিস্ত্রি হইতে আরম্ভ করিয়া মাছ, গোশত, আলু, পটল, তামাক ও মুরগীর আণ্ডা ব্যবসায়ী পর্যন্ত সকলেরই সমিতি আছে।’ অবশেষে সে ‘অল-ইন্ডিয়া কন্ডোলেন্স কংগ্রেস’ সংক্ষেপে ‘এ আই সি সি’ স্থাপনের সিদ্ধান্ত নিলো এবং নিজেই সেই সংগঠনের আহবায়ক হয়ে গেল।

বঙ্গদেশে ঠিক এমনিভাবেই লতায়–পাতায় হাজারো সংগঠন দাঁড়িয়ে যায় এবং মজার ব্যাপার হচ্ছে সেগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে টিকেও থাকে। সেটার উল্লেখ আছে এ গল্পের শেষের দিকে, যেখানে বলা হয়েছে, ‘অল-ইন্ডিয়া কনডোলেন্স কংগ্রেসের চতুর্থ হীরক জুবিলী উৎসব।’

পরের গল্প ‘লঙ্গরখানা’ বঙ্গসমাজের আরও একটা চিরায়ত প্রতারণার গল্প। এ গল্পে অনেক উর্দু শব্দ ও বাক্য ব্যবহার করা হয়েছে। এ উর্দু শব্দগুলো যেন একেবারেই জীবন্ত হয়ে উঠেছে এই গল্পে। সেবার নাম করে নিজের মজুতদারি পণ্যের বিক্রয় এবং উল্টো টু পাইস মুনাফা অর্জনের বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন লেখক। এর সঙ্গে সমাজের কে কে জড়িত, তারও একটা ধারণা পাওয়া যায়। বিপুল ধুমধামের সঙ্গে লঙ্গরখানা উদ্বোধন করে পেছনের দরজা দিয়ে নিজের মজুতকৃত অতিরিক্ত পণ্য কালোবাজারে বিক্রি করা হয়।

আর যাদের জন্য লঙ্গরখানা, তাদের নামকা ওয়াস্তে খাওয়ানো হয়, কিন্তু সরকারের কাছে হিসাব দাখিল করা হয় বহু মানুষের। ফলে ‘লঙ্গরখানা সেবা-সমিতি রিলিফ কমিটি যত বাড়তে লাগল, অভিযুক্তের সংখ্যাও ততই বাড়তে লাগল। বিনামূল্যে যত বেশি খাদ্য বিতরণ হতে লাগল, শ্মশানে গোরস্তানে ভিড় তত বেশি হতে লাগল।’ আর এ ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িত উজির থেকে শুরু করে আইনসভার সদস্য সবাই। তাই শেষ পর্যন্ত আর এসব লঙ্গরখানা বন্ধ করা সম্ভব হয় না। শেষের লাইনটা চমৎকার—‘লঙ্গরখানা মুসাফিরখানা আখেরফানা।’

পরের গল্প ‘রিলিফ ওয়ার্ক।’ গল্পটা আমাদের উচ্চমাধ্যমিকের পাঠ্য ছিল, তাই আগেই পড়া ছিল। এ গল্প নদীবিধৌত বাংলাদেশের একেবারে প্রতিদিনকার গল্প। প্রায় প্রতিবছরই এ দেশে বন্যা হয় আর বন্যা হলেই রিলিফ ওয়ার্ক নিয়ে সবাই ব্যস্ত হয়ে যায়। লেখকের ভাষায়, ‘বন্যাপীড়িত দেশবাসীর দুঃখে দেশহিতৈষী পরহিত-ব্রতী নেতৃবৃন্দের হৃদয় হুঙ্কার ছাড়িয়া কাঁদিয়া উঠিয়াছে। কর্মীগণের চোখের দু’পাতা আর কিছুতেই একত্র হইতে চাহিতেছে না।

সংবাদপত্র-সম্পাদকের কলমের ডগা ফাটিয়া রক্ত বাহির হইতেছে।’ এরপর সংগ্রহকৃত রিলিফ ওয়ার্কের ভান্ডারের বেশির ভাগ অর্থই খরচ হয় এর কর্মী বাহিনীর পেছনে। বাকিটুকুর একটা বড় অংশ খরচ হয় সমাজের সচ্ছলদের তোষণ করতে। তারপরও যদি সামান্য কিছু বাকি থাকে, তার মধ্যে থেকে গরিবদের মধ্যে বিলিবণ্টন করা হয়। এই বিলিবণ্টনের নিয়মকানুন খুবই কড়া। সামান্য এদিক-সেদিক হলেই রিলিফ বন্ধ করে দেওয়া হয়। উপরন্তু, কেউ যদি ক্ষুধার জ্বালায় একটু–আধটু চুরি করে, তাহলে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে যেতে হয় জেলখানায়। এ যেন বঙ্গদেশের হাজার বছরের চরিত্র এবং বাস্তব চিত্র।

এর পরের গল্প ‘গ্রো মোর ফুড’। এটাও আরেক ব্যঙ্গ গল্প। খাদ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য বঙ্গসমাজের নেতাদের কর্মের ফিরিস্তি এ গল্প। মোটা বেতনে এমন সব কর্মী নিয়োগ করা হয়, যাদের এই বিষয়ে ন্যূনতম জ্ঞানবুদ্ধি নেই। তাদের নেতৃত্বে কাগজে পরিকল্পনা তৈরি হলো। চাষ করা হবে ইংরেজ-মার্কিনদের জন্য মদ, ভারতীয় ভদ্রলোকদের জন্য গাঁজা এবং ভারতীয় জনসাধারণের জন্য হাওয়া। শুনতে আজগুবি হলেও বঙ্গসমাজের পরিকল্পনাগুলো কিন্তু বরাবরই এর চেয়ে আরও বেশি আজগুবি।

পরের গল্প ‘মিছিল’। যুদ্ধ যে ব্যবসায়ী ও মজুতদারদের জন্য পোয়াবারো, সেটাই বলা হয়েছে। তাই যুদ্ধ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তারা মিছিল করছে—হায় জাপান, হায় জার্মান। এর পরের গল্প ‘জমিদারি উচ্ছেদ’। গ্রামের একজন মানুষের জমিদারি উচ্ছেদের কথা বলে ভোট নিয়ে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়ে নিজেই জমিদার বনে যাওয়ার গল্প।

এ বইয়ের শেষের গল্পটা দুর্দান্ত। গল্পের শিরোনাম ‘জনসেবা যুনিভার্সিটি’। গল্পটা যেন সমগ্র বইয়ের একটা উপসংহার। বঙ্গসমাজের বাটপারির ব্যাপারটাকে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়া হয়েছে। সেখানে আছে ইনফ্যান্ট ক্লাস, প্রাইমারি, সেকেন্ডারি, ইন্টারমিডিয়েট, বিএ, এমএ এবং ডক্টরেট। জনসেবার ক্লাসে যার ডিগ্রি যত বড়, তিনি যেন তত বড় প্রতারক। শুরুতেই সবাই নিজেকে জনসেবক হিসেবে জাহির করতে সেবার দায়িত্ব চান।

দায়িত্বের পর চান অধিকার। অধিকারের পর চান ক্ষমতা। ক্ষমতা পেয়ে গেলেই জনসেবার আসল রূপ একটু একটু করে দৃশ্যমান হতে থাকে। শুরুতেই তাঁরা হন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট। এরপর আরও সেবার কথা বলে হয়ে ওঠেন জিলাবোর্ডের চেয়ারম্যান, তারপর হয়ে ওঠেন আইনসভার সদস্য। এতেও যখন জনসেবা করে তৃপ্তি না পান, তখন হয়ে ওঠেন মন্ত্রী। এরপর মন্ত্রীর থেকে একসময় হয়ে ওঠেন খান বাহাদুর, স্যার এবং সবশেষে লাট সাহেব।

সারা দেশের চেহারা না বদলালেও যাঁরা জনসেবা করেন, তাঁদের চেহারা সময়ের সঙ্গে বদলে যায়। গল্পের চরিত্র ইয়াকুবের পরিবর্তনগুলো লেখক তুলে ধরেছেন এভাবে, ‘ইয়াকুব মিয়া মন্ত্রী হল। চেহারাও খুব খানিকটা বদলাল বটে, কিন্তু দেশেরও নয়, জনসাধারণেরও নয়—ইয়াকুবের নিজের। শেরওয়ানি-পাজামা ফেলে, দাড়িমোচ কেটে কোট-প্যান্টালুন পরে ইয়াকুব মিয়া ইয়াকুব সাহেব হল। মেস ছেড়ে সাহেবপাড়ায় বড় বাড়ি নিল। মোটর-চাপরাশি আরদালীতে সত্যই ইয়াকুবকে আর চিনার উপায় রইল না।’ এরপর মিয়া ইয়াকুব একসময় লাট সাহেব হয়ে হলেন লর্ড জ্যাকব। তারপর জনসেবা করলেন খুব, গ্রামে নিজের নামে একটা স্কুল, বাপের নাম একটা খয়রাতি দাওয়াখানা ও মায়ের নাম একটা জুনিয়র মাদ্রাসা স্থাপন করলেন।

জিলাবোর্ডের রাস্তা থেকে মোটরে নিজের বাড়ি যাওয়ার জন্য গাঁয়ের মধ্য দিয়ে একটা পাকা সড়ক করলেন। বাড়ির সামনের মসজিদ পাকা করলেন। তারপর একসময় হজ করে কাঁধে জায়নামাজ ও মুখে দাড়ি নিয়ে দেশে ফিরলেন। তিনি মারা গেলে তাঁর মর্মরমূর্তি স্থাপন করা হলো। এর পর থেকে ইয়াকুব সাহেবের আদর্শ জীবনী আজও এই দেশের সবার কাছে অনুপ্রেরণা।

সে জন্যই এই বঙ্গদেশে জনসেবকের এমন ভিড়। গল্পটা তখনকার দিনে যতটা বাস্তব ছিল, এখনকার দিনে তার চেয়ে বেশি প্রকট সত্য। আমার ধারণা, আজ থেকে হাজার বছর পরে বঙ্গদেশে যখন কেউ এই গল্পগুলো পড়বে, সেও দ্রুতই রিলেট করতে পারবে।

বইয়ের উদ্বোধনীতে আবুল কালাম শামসুদ্দীন লিখেছেন, ‘আবুল মনসুরের “আয়না”য় মুখ দেখে যারা খুশী হয়েছেন। ফুড কনফারেন্সও নিশ্চয় তাঁরা পেট ভরে খেয়ে প্রচুর আনন্দ পাবেন। “আয়না”য় প্রধানত বাংলার মুসলমানদের সামাজিক জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি দেখানো হয়েছিল। “ফুড কনফারেন্স” বাঙালি হিন্দু-মুসলমানের জাতীয় চরিত্রের বাস্তব দিক রূপায়িত করে তোলা হয়েছে। ব্যঙ্গ ও রঙ্গ, Satire ও wit, বাঙালি সাহিত্যে একেবারে নেই, এ কথা বলা চলে না। তবে এদিক দিয়ে সার্থক রচনা নিতান্তই পরিমিত। আমার মনে হয়, আবুল মনসুর আহমদ এই মুষ্টিমেয় সার্থক শিল্পীদের অন্যতম প্রধান।’

এ বই সম্বন্ধে প্রকাশক মেছবাউদ্দীন আহমদের কথা দিয়ে লেখাটা শেষ করতে চাই। তিনি লিখেছেন, ‘সাম্রাজ্যবাদী সামন্তবাদী শোষণের ফলে দুনিয়ার শস্যভান্ডার সুজলা-সুফলা বাংলা ১৩৫০ সালে পৃথিবীর ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা মর্মান্তিক লোক-ক্ষয়ী আকালের শিকার হইয়াছিল।

বাংলার দুইটি শ্রেষ্ঠ প্রতিভা এ হৃদয়বিদারক আকালের বাস্তব ছবি আঁকিয়েছিলেন: শিল্পী জয়নুল আবেদিন আঁকিয়েছিলেন ব্রাশ ও তুলিতে আর আবুল মনসুর আঁকিয়েছিলেন নকশার কলমে। তাঁর অমর সৃষ্টি ফুড কনফারেন্সই এক নকশা। বেদনার তীব্র কশাঘাত। এই কনফারেন্স পড়িয়াই বাংলা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী অন্নদাশংকর রায় লিখিয়াছিলেন: “আয়না” লিখিয়া আবুল মনসুর প্রাতঃস্মরণীয় হইয়াছিলেন আর “ফুড কনফারেন্স” লিখিয়া তিনি অমর হইলেন।’