স্বাগত হে বাংলাদেশের নতুন সূর্য
ছাত্র আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকেই ইউটিউবে একাত্তরের গণ জাগরণের গানগুলো শুনছিলাম। কত সমৃদ্ধ আমাদের সংস্কৃতি। কত রকমের গানই না আমাদের আছে। লোকসংগীত, ক্ল্যাসিক, আধুনিক গান ছাড়াও কতভাবের গান যে আমাদের আছে। তার মধ্যে গণজাগরণের গানগুলো শুনলেই গায়ের লোম খাড়া হয়ে যায়। ইউটিউবের একটা চ্যানেলে মোট ৩৪টি গান আছে। সেগুলো শুনে মন না ভরাতে আলাদা আলাদাভাবে শিল্পীদের তালিকায় গিয়েও গানগুলো শুনলাম। আন্দোলনের একেবারে শুরুর দিকে আমার পরিচিত বন্ধুবান্ধব অনেকেই আন্দোলনের পরিণতি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করছিলেন। আমি তাদের বলেছিলাম, পৃথিবীতে এমন একটা ইতিহাস নেই, যেখানে ছাত্ররা ব্যর্থ হয়েছে। সেই ফরাসি বিপ্লব থেকে শুরু করে হালের আরব বসন্ত—সবখানেই ছাত্ররা সফল হয়েছিল। কিন্তু ওনারা ঠিক বিশ্বাস করতেন না।
অবশ্য শুরুর দিকে আন্দোলন নিয়ে সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশও ছিল। একটা দেশের সুগঠিত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে কথা বলতে এলেই সাহস লাগে। তখন বারবার মনে হচ্ছিল ‘তীরহারা এই ঢেউয়ের সাগর পাড়ি দিব রে, আমরা ক’জন নবীন মাঝি’ বা ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার হে! লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি নিশীথে, যাত্রীরা হুঁশিয়ার’ গানের কথা। এরপর এক সময় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে যখন শত শত ছাত্র প্রাণ হারাল এবং হাজারো ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হলো তখন আর আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না এই আন্দোলনের পরিণতি নিয়ে। কারণ তখন মাথায় বেজে চলছিল ‘এই শিকল পরা ছল, মোদের এই শিকল পরা ছল’ বা ‘জনতার সংগ্রাম চলবেই’ গানের কথা।
সেই হত্যাকাণ্ডে শিশু থেকে বৃদ্ধ কেউই রেহাই পেল না। তবে আবু সাঈদ আর মীর মুগ্ধর মারা যাওয়ার ঘটনাটা আলাদাভাবে সবাইকে নাড়া দিয়ে যায়। আবু সাঈদের কথা আগের লেখায় বলেছিলাম। মুগ্ধ তার নামের মতো আমাদের মুগ্ধ করে গেল। স্বপ্রণোদিত হয়ে মুগ্ধ এই আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। সে আন্দোলনকারীদের পানি আর বিস্কুট খাওয়াচ্ছিল। কাঁদানে গ্যাসের কারণে দুটো চোখ খুলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। একটা চোখ খুলছে আর অন্যটা বন্ধ রাখছে। তবুও চিৎকার করে যাচ্ছে পানি লাগবে পানি। এরপরই পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারায়। তার মুখের শেষ কথাগুলো যেন সব গানের আবেদনকে পেছনে ফেলে দিল। আমি নিশ্চিত একদিন এই কথাগুলো নিয়ে অনেক গান বাঁধা হবে। যত দিন বাংলাদেশ থাকবে তত দিন দেশের দেয়ালে দেয়ালে আঁকা মুগ্ধর গ্রাফিতি আমাদের ডেকে ডেকে বলে যাবে—ভাই, পানি লাগবে, পানি।
এ আন্দোলনে অনেক শিশু মারা যায়, যাদের কেউই এই আন্দোলনের অংশ ছিল না। ইউনিসেফের হিসাব অনুযায়ী ৩২ শিশু মারা গেছে। যারা বাসার ছাদে খেলতে গিয়ে, বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকেও গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। এরপর মানুষ যখন বুঝে গেল যে আর কেউই নিরাপদ নয়, তখন তারা শিশুদের নিয়ে রাস্তায় নেমে এল। ইন্টারনেটে অনেক ছবি ভেসে বেড়াচ্ছে, যেখানে মায়ের কোলের শিশু থেকে শুরু করে স্কুলপড়ুয়া সবাই আছে। শুধু একটা ছবি দিয়ে এই আন্দোলনের মাত্রা বোঝানো যাবে না। তবে একটা ছবি এই আন্দোলনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে আছে। একজন মায়ের কোলের শিশু পেছনের দিকে তাকিয়ে আছে। সেই দৃষ্টিতে এমন একটা কিছু আছে, যেটা সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
এই আন্দোলনে আমার এক নাতনিও যোগ দিয়েছিল। ও আমার ভাগনির দুই বছর বয়সের একমাত্র মেয়ে। ও হয়তোবা কিছু না বুঝেই ওর মায়ের সঙ্গে গিয়েছিল। ওর খালা যখন আমাকে ওর ছবিটা পাঠাল, তখন এত ভালো লাগছিল। এই স্মৃতি ওর সারা জীবনের সঞ্চয় হয়ে থাকবে। ও যখন বড় হবে, তখন ওর বন্ধুবান্ধবের কাছে এই সংগ্রামের গল্প করবে। আমার মনে আছে শাহবাগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলনের সময় আমি আমার তিন বছর বয়সী মেয়েকে নিয়ে গিয়েছিলাম। এরপর বেশ কিছুদিন আমি যখনই অফিস থেকে বাসায় ফিরতাম, তখনই আমরা বাপ-বেটি মিলে স্লোগান দিতাম, রাজাকারের বিচার চাই। আমার নাতনিও নিশ্চয়ই ওর বাবার সঙ্গে এমন স্লোগান দেয়, ব’তে বাংলাদেশ, দেশটা কারও বাপের না।
আবু সাঈদ, মুগ্ধরা তো আসলে শুধু নিজেদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন করেনি। তারা স্বপ্ন দেখেছিল একটা বৈষম্যহীন বাংলাদেশের। তারা স্বপ্ন দেখেছিল একটা সুজলা সুফলা বাংলাদেশের। যেখানে একটা শিশু জন্ম নিলে তাকে আর তার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কিত থাকতে হবে না। ঠিক যেমনটা স্বপ্ন দেখেছিলেন কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য। কাকতালীয় বিষয় হচ্ছে আবু সাঈদ এবং মুগ্ধ দুজনের বয়স ছিল পঁচিশের আশপাশে। আর সুকান্ত বেঁচেছিলেন মাত্র ২০ বছর। আবু সাঈদ এবং মুগ্ধর ত্যাগ দেখার পর থেকেই মাথায় ঘুরছে সুকান্তের ছাড়পত্র কবিতাটা -
‘যে শিশু ভূমিষ্ঠ হলো আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুম:
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চিৎকারে।
…………………………………
এসেছে নতুন শিশু, তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর ধ্বংসস্তূপ-পিঠে।
চলে যেতে হবে আমাদের।
চলে যাব- তবু আজ যতক্ষণ দেহে আছে প্রাণ
প্রাণপণে পৃথিবীর সরাব জঞ্জাল,
এ বিশ্বকে এ-শিশুর বাসযোগ্য ক’রে যাব আমি-
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।’
ছাত্ররা অনেকভাবেই নিজেদের উদ্বুদ্ধ রেখেছিল। তবে শহীদ মিনারে আগস্টের চার তারিখের জনসমাবেশে সমবেত কণ্ঠে যে গানটা গেয়েছিল, সেটা এখনো আমার কানে বাজে। বাংলাদেশ রাষ্ট্র তৈরি হওয়ার পর এত বিশাল সংখ্যক মানুষের সমাবেশ আমরা এ প্রথম প্রত্যক্ষ করলাম। যেদিকে দুচোখ যায় শুধু মানুষের মাথা আর মাথা। আমরা এখনো মনে মনে গেয়ে চলি - ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি, ও সে সকল দেশের রানি সে যে - আমার জন্মভূমি’। অবশেষে ‘এক সাগর রক্তের বিনিময়ে’ বাংলাদেশ যেন দ্বিতীয়বার স্বাধীন হলো আগস্টের ৫ তারিখে। বাংলাদেশে উদিত হলো এক নতুন সূর্য। আসুন, আমরা সবাই মিলে সেই সূর্যকে স্বাগত জানাই - পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল; জোয়ার এসেছে জন-সমুদ্রে, রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল। ‘আমাদের সব সময়ই সজাগ থাকতে হবে যেন এই সূর্য আর ডুবে না যায়’।
*দূর পরবাসে ছবি, লেখা ও ভিডিও পাঠাতে পারবেন দেশের পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]