ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের বিড়ম্বনা: পর্ব–২
প্রবাল যখন লেখা শুরু করে সে সময় আমার রাইটার্স ব্লক চলছে। শত চেষ্টা করেও এক লাইন লিখতে পারছিলাম না। লেখা বাদ দিয়ে পড়া শুরু করলাম। প্রায় সব পত্রিকার সব ধরনের গল্প, প্রবন্ধ পড়ি। বিশেষ করে নতুন লেখকদের লেখা খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ি। একদিন তরুণ এক লেখক–বন্ধু আমাকে ফোন করে বলল, কী ব্যাপার, অনেক দিন আপনার লেখা দেখি না?
বললাম, লেখা আপাতত বন্ধ। আসলে লিখতে পারছি না।
সে অবাক হয়ে বলল, বলেন কী! এমন কি হতে পারে?
আমি বললাম, হ্যাঁ, অবশ্যই হতে পারে। একে ইংরেজিতে বলে রাইটার্স ব্লক। তবে আমি যেহেতু তেমন লেখক নই, তাই আমার ক্ষেত্রে হয়েছে ব্রেন ব্লক।
সে বলল, এ আবার কী?
বললাম, আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে যে অল্প জ্ঞান সঞ্চয় হয়েছিল, তা শেষ হয়ে গেছে। তাই লেখা বের হচ্ছে না।
সে বলল, আসল ঘটনা কী?
বললাম, ‘ঘটনা সত্য, রিলিফ পাওয়ার যোগ্য।’
সে বলল, রিলিফ পাওয়ার যোগ্য মানে?
আমি হেসে বললাম, তাহলে আপনাকে একটি মজার ঘটনা বলি: বন্যার সময় অনুদানের জন্য সবাই গ্রামের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান বরাবর দরখাস্ত করত, যাতে ত্রাণ পেতে সুবিধা হয়। এত লোকজন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আর এত বেশি দরখাস্ত পড়েছে যে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেবের লিখতে লিখতে হাত ব্যথা হয়ে গেল। তিনি সংক্ষেপে একটি কথা লেখা শুরু করলেন, ‘ঘটনা সত্য, রিলিফ পাওয়ার যোগ্য।’ ত্রাণের দরখাস্তের সাথে একটি দরখাস্ত এল ছেলেকে এলাকার কলেজে ভর্তি করার জন্য। তিনি সেখানেও লিখে দিলেন, ‘ঘটনা সত্য, রিলিফ পাওয়ার যোগ্য।’
এভাবে কেটে গেল বেশ কয় মাস। তারপর আমার লেখার দ্বার খুলে গেল। এর মধ্যে একদিন সে বলল, ভাই, ভাবছি আর লেখা হবে না। লেখালেখি বন্ধ করে দেব।
বললাম, সে কী, আপনার লেখার ধার তো বাড়ছে, তাহলে বন্ধ করবেন কেন?
সে বিষণ্ন মুখে বলল, না ভাই, আমার লেখার ধার আর তেমন কী, আমার স্ত্রীর মুখের ধার অনেক বেশি। আমাকে বলে, ‘কী সব ছাইপাঁশ লেখো, দুই লাইনের বেশি পড়া যায় না। এসব বাজে কাজে সময় নষ্ট না করে সংসারের কাজে মন দাও।’
আমি বললাম, আপনি এক কাজ করেন, স্ত্রীকে নিয়ে একটি প্রেমের কবিতা লেখেন, দেখবেন সব ঠিক হয়ে গেছে।
সে বলল, তাই নাকি! আপনি নিশ্চিত?
বললাম, রবীন্দ্রনাথের ‘অধ্যাপক’ গল্প পড়েছেন?
সে বলল না।
আমি বললাম, তাহলে শোনেন, রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘অধ্যাপক’ গল্পে লিখেছেন, ‘রাজা শিবসিংহের মহীয়সী লছিমা দেবীকে কবি বিদ্যাপতি ভালোবাসিতেন এবং তাহাকে না দেখিলে তিনি কবিতা রচনা করিতে পারিতেন না।’ শুধু বিদ্যাপতিকে বলা কেন, এমন প্রচুর কবি, ঔপন্যাসিক আছেন, যাঁরা তাঁদের ভালোবাসার মানুষকে কেন্দ্র করে প্রচুর লেখেন, সুন্দর লেখেন। জীবনে ভালোবাসার মানুষ নেই, এমন খুব কম লেখকই আছেন। তাই আপনি হাল ছাড়বেন না, চালিয়ে যান।
সে বলল, ভাই, আপনি মাঝে মাঝে আবোলতাবোল বকেন। আমি লিখতেই পারি না, তার ওপর কবিতা লিখব! আর যদিও তাকে নিয়ে লিখি, সে বিশ্বাসই করবে না যে কবিতা তাকে নিয়ে লিখেছি। তখন আবার ঝামেলা হবে, বাদ দেন।
আমি হঠাৎ তাকে বললাম, আচ্ছা আপনি এত বিচলিত কেন? ঘন ঘন এদিক–ওদিক কী দেখছেন?
সে বলল, ভাই, আপনি কি আধ্যাত্মিক জগতের লোক? আপনি কীভাবে জানলেন আমি বিচলিত হয়ে এদিক–ওদিক দেখছি?
বললাম, না তেমন কিছু না, সবই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের ব্যাপার। আচ্ছা ভালো থাকবেন, পরে কথা হবে।
পরক্ষণেই সে আবার ফোন করে বলল, ভাই, আমি তো কিছুই লিখতে পারছি না, আপনি আমাকে কীভাবে দেখেন?
আমি বললাম, আরে! করেন কী! আস্তে! অত জোরে চুল টানবেন না।
সে প্রথমে অবাক ও পরে বিরক্ত হয়ে বলল, দূর মিয়া, আপনি খুব ঝামেলা করেন। বলেই ফোন রেখে দিল।
আমি বুঝতে পারছি তার কৌতূহলের বাঁধ ভেঙে যাচ্ছে। ওকে ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় থেকে বের করে না আনলে তার লেখা বন্ধ হয়ে যাবে।
এরপর অনেক দিন কথা বন্ধ। মনে হয় সে ঠিক করেছে আমাকে আর ফোন করবে না। আমি একদিন নিজেই ফোন করলাম। সে বলল, কেমন আছেন ভাই?
বললাম, আমি তো ভালোই ছিলাম; কিন্তু আপনারা কোনো ফোন না পেয়ে কিছুটা চিন্তাগ্রস্ত।
সে এবার হেসে বলল, যাক তাহলে আপনিও চিন্তিত হন?
বললাম, প্রাণিকুলে একমাত্র মানুষই তো সুদূরপ্রসারী চিন্তা করার ক্ষমতা রাখে।
সে বলল, মানুষ সুদূরপ্রসারী চিন্তা করতে পারে আর অন্যান্য প্রাণী কি অল্পবিস্তর চিন্তা করতে পারে?
আমি বললাম, ঠিক তাই। তা নির্ভর করে সেসব প্রাণীর মস্তিষ্কের ক্ষমতার ওপর। যেমন মানুষের পর সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ার একধরনের বানর, নাম ওরাং–উটান। তবে তার চিন্তা সীমিত। যেমন কোনো মানুষ পানিতে পড়ে গেলে তার জন্য সাহায্যের হাত বাড়াতে পারে, এটুকুই। এরপর হচ্ছে ডলফিন।
সে বলল, বাহ! এ তথ্য তো জানা ছিল না!
আমি বললাম, ওরাং-উটান নিয়ে লিখে ফেলুন একটি গল্প।
সে হেসে বলল, মানুষ নিয়েই লিখতে পারি না আবার বানর নিয়ে লিখব! এমনি কোনো লেখা আজকাল লিখতেই পারি না।
আমি বললাম, এটা হচ্ছে রাইটার্স ব্লক। ঠিক হয়ে যাবে।
সে বলল, কী যে বলেন না! আমি লেখক হলে তবেই না রাইটার্স ব্লক হবে। আমার হচ্ছে ওয়াইফস ব্লক, মানে স্ত্রীর বাধা।
আমি বললাম, উনি আবার কী সমস্যা করেন?
সে বলল, আর বলবেন না ভাই, যখনই লিখতে বসি বিরক্ত হয়ে বলে, ‘শেষ বয়সে এসে ওনার হুমায়ূন আহমেদ হওয়ার শখ হইছে, যত্ত সব আজাইরা কাজ।’ আচ্ছা বলেন ভাই, এসব কথা বললে কি আর লেখার মুড থাকে?
আমি বললাম, আপনি মনে হয় খুব ব্যস্ত থাকেন, ভাবিকে কোনো সময় দেন না।
কিছুক্ষণ নীরব থেকে বলল, তা ঠিক। তবে এই বয়সে কি আর সময় দেওয়ার দরকার হয়?
আমি বললাম, স্ত্রীকে সময় দেওয়ার কোনো বয়স লাগে না।
সে এবার বলল, আপনিও কি বাধাগ্রস্ত হন?
আমি বললাম, হই বৈকি।
সে বলল, তখন কী করেন?
তার কথা শুনে মাথায় দুষ্টুবুদ্ধি খেলে গেল। মনে হলো, আমি ফিরে গিয়েছি সেই দুরন্ত কৈশোরে। নানা রকম দুষ্টুবুদ্ধি দিয়ে বন্ধুদের নাজেহাল করতে খুব ভালোবাসতাম। আমার শৈশবের বন্ধু না হলেও বন্ধু তো। হোক না ফেবু বন্ধু। বললাম, ভাই আমিও প্রথম দিকে বাধা পেতাম। তার পর থেকে একটি বুদ্ধি বের করলাম। তা হচ্ছে, যখন আমার লেখার ইচ্ছা হতো তখন রান্নাঘরে ঢুকে কিছু একটা খাবার ও চা বানিয়ে রান্নাঘর অগোছালো করে আসতাম। আমার স্ত্রী আবার অগোছালো পছন্দ করে না, তাই সে রান্নাঘর পরিষ্কারের কাজে লেগে গেলে, আমি লিখতে বসতাম। প্রায় দুই ঘণ্টা সময় এভাবেই বের করতাম লেখার জন্য। আপনিও এমন একটি পদ্ধতি বের করতে পারেন। তবে এ পদ্ধতিতে যাওয়ার আগে আপনাকে একটা প্রশ্ন করি।
সে বলল, বলেন কী প্রশ্ন?
আপনি কি রান্নাঘরে আপনার স্ত্রীকে সাহায্য করেন?
সে বলল, না।
বললাম, তাহলে ভুলেও এই পদ্ধতিতে যাবে না, বিপদে পড়বেন।
সে আমার কথা পাত্তা না দিয়ে বলল, ভাই যা–ই বলেন না কেন, আপনার এই পদ্ধতি আমার খুব পছন্দ হয়েছে।
আমি বললাম, ভেবে দেখেন আরেকবার। আমার পদ্ধতিতে কিন্তু ঝুঁকি আছে। সাবধানে থাকবেন।
সে বলল, আজ কিন্তু আপনি আমি কী করছি সে বিষয়ে কিছু বললেন না।
আমি হেসে বললাম, আজ আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় কাজ করেনি। আমি প্রত্যুত্তরে একটি অট্টহাসি দিলাম।
আমি তাকে পরামর্শ দিয়ে মনে হয় ভুল করলাম। এমন নিরীহ লোককে এমন পরামর্শ দেওয়া ঠিক না। এ নিয়ে উত্তেজনায় আমার ঘুম হারাম হয়ে গেল। লেখা বন্ধ হয়ে গেল। টানটান উত্তেজনা আমাকে গ্রাস করে ফেলল। তার কোনো খবর নেই অনেক দিন। এমন ভাবতে ভাবতে একদিন তার ফোন কল এলো। আমি ঝাঁপিয়ে পড়ে মুঠোফোন হাতে নিলাম। আমার বিকাল নয়টা, আকাশের সূর্য পৃথিবীর বুকে উজ্জ্বল আলো ছড়াচ্ছে। তার মানে তার ওখানে এখন মধ্যরাত। আমি ভয়ে ভয়ে মুঠোফোন হাতে নিলাম। দুর্বল কণ্ঠে বললাম, হ্যালো!
ও পাশে ঠান্ডা কণ্ঠে ভেসে এল, ভাই কেমন আছেন?
আমি বললাম, আমার থাকার চেয়ে আপনার থাকাটা জরুরি। আপনি কেমন আছেন? সব ঠিক আছে তো?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল, আপনার পদ্ধতি কাজ হয়নি।
বললাম, কোন পদ্ধতি?
সে বলল, রান্নাঘর অগোছালো।
আমি বললাম, আরে ভাই আমি তো আপনাকে আগেই বলেছিলাম এ পদ্ধতি আপনার জন্য নয়, আপনি তো শুনলেন না। এবার বলেন কী সমস্যা?
চুপ করে রইল। আমি বললাম, শুধু মাথা নাড়লে হবে?
সে এবার বলল, আচ্ছা আপনার ষষ্ঠ ইন্দ্রীয়ের ব্যাপারটা আগে বলুন তো! আমি মাথা নাড়লাম, এটা তো অবশ্যই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় না।
আমি এবার হেসে বললাম, আমার এক বন্ধু আছে, যার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের সাথে আপনার অনেক মিল। আপনাকে আমার সব বলা অনুমানভিত্তিক। আমার মনে হলো, আমার বন্ধু যেভাবে আমার সাথে কথা বলে, হয়তো আপনিও তেমনই হবেন। তাই প্রথমবার অনুমানের ওপর ঢিল ছুড়লাম, কাকতালীয়ভাবে লেগে গেল। পরেরবার আবার একই অনুমান করে লেগে গেল। আসলে আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের পূর্বাভাসের কোনোই ক্ষমতা নেই। ব্যাপারটি আমার কাছেও পরিষ্কার না। মনে করতে পারেন আপনার সাথে একধরনের খেলা খেলেছি। কিন্তু এই খেলা যে বারবার কাকতালীয়ভাবে সত্যি হবে, তা ভাবিনি। তা ছাড়া আপনার সাথে যে কয়েকবার ভিডিও কলে কথা হয়েছে, তা থেকেও অনুমান করে বলেছি।
সে বলল, আর কয় দিন ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের খেলা চললে তো আমি আপনার মুরিদ হয়ে যেতাম!
আমি হেসে বললাম, এবার আপনার কথা বলেন।
সে বলল, ভাই, আমি রান্নাঘর অগোছালো করে সবে লিখতে বসেছি। আমার স্ত্রী রান্নাঘরের থালাবাসন আমার কাগজের ওপর রেখে বলল, ‘যাও, এগুলো ধুয়ে রান্নাঘর পরিষ্কার করে এসো। তা না হলে খবর আছে।’ সমাপ্ত
*লেখক: বায়াজিদ গালিব, ক্যালগেরি, কানাডা।