মোহনীয় আঁধার কাটবে কবে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

জীবন সব সময় আলো আর অন্ধকারের খেলা। দিনের আলো আমাদের ভরিয়ে তোলে আশা, স্বপ্ন ও আনন্দে। কিন্তু রাতের অন্ধকার, হতাশা, একাকিত্ব—এই মোহনীয় অন্ধকার কখন কেটে যাবে? এটি শুধু রাতের অন্ধকার নয়; বরং জীবনের সেই মুহূর্ত, যেখানে মানুষ নিজের অস্তিত্বকে অচেনা মনে করে, মনে করে সে একা, হাল ছেড়ে দিয়েছে। এই অন্ধকার অনেক সময় মানুষের মনে এমন ছায়া ফেলে, যে তারা নিজেদের সুখ ও সাফল্যের সম্ভাবনাকেও খুঁজে পায় না।

প্যারিসের ব্যস্ত রাস্তায় প্রতিদিন হাজারো মানুষ ছুটছে। বাইরে আলো, ভিড়, ব্যস্ততা—সবকিছু থাকলেও অনেকের মন আজও অন্ধকারে ডুবে আছে। ফ্রান্সের সাম্প্রতিক জরিপ অনুযায়ী, শহরের প্রায় ৩৫% মানুষ নিয়মিত মানসিক চাপ বা হতাশায় ভুগছে। বিশেষ করে ২০ থেকে ৪০ বছরের মানুষেরা উদ্বিগ্ন। বিশ্বব্যাপী এই হার আরও উদ্বেগজনক, ইউরোপের মোট জনসংখ্যার প্রায় এক-চতুর্থাংশ মানুষ মানসিক চাপ বা একাকিত্বের শিকার।

মোহনীয় অন্ধকার কেবল ব্যক্তিগত নয় সমাজের নানা স্তরেও বিরাজ করছে। মানুষের মধ্যে সহমর্মিতা, বোঝাপড়া ও ধৈর্যের অভাব এই অন্ধকারকে আরও ঘন করছে। নগরায়ণ, প্রযুক্তির আধিপত্য, প্রতিযোগিতার চাপ—এসব মিলিয়ে আমরা এক অচেনা অন্ধকারে পড়েছি। যুবসমাজে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা ক্রমেই বাড়ছে। এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, ফরাসি যুবকদের প্রায় ৪২% প্রায়ই হতাশা বা মানসিক চাপ অনুভব করে, এবং তার মধ্যে ২০% মানুষ এমন একাকিত্বে ভুগছে, যা ঘন অন্ধকারের মতো তাদের জীবনকে জড়িয়ে রাখে।

তবে এ অন্ধকার কাটাতে ছোট্ট মানবিক উদ্যোগগুলোই আলো হয়ে ওঠে। প্যারিসের ছোট আশ্রয়কেন্দ্র, বৃদ্ধাশ্রম, শিশু বিকাশকেন্দ্র—এখানে প্রতিদিন মানুষ অন্যদের পাশে দাঁড়াচ্ছে, হাসি ফোটাচ্ছে, সহানুভূতি ছড়াচ্ছে। সমাজকর্মী এলিজাবেথ জানালেন, প্রতিটি শিশু বা বৃদ্ধার মুখে হাসি ফোটানো, তাদের পাশে থাকা এই ছোট্ট উদ্যোগই মানুষের জীবনকে আলোকিত করে। এমন ছোট্ট মুহূর্তের প্রভাব অনেক সময় দীর্ঘস্থায়ী হয়।

শিল্প, সাহিত্য, সংগীত—এসব মাধ্যমও মানুষের অন্ধকার কাটানোর শক্তিশালী হাতিয়ার। একটি কবিতা, একটি গল্প, একটি নাটক বা একটি গিটারনোট মানুষের মনকে আলোকিত করে। প্যারিসের লাতিন কোয়ার্টারে এক জাজ ক্লাবে সংগীতের এক ক্ষণিকের মেলডি মানুষকে তার অজানা অনুভূতির সঙ্গে যুক্ত করে। প্রকৃত অর্থে, আলো আসে হৃদয়ের সংবেদন থেকে, মানবিক সংযোগ থেকে, একে অপরের প্রতি সহানুভূতি থেকে।

মানুষের জীবনে এই আলো খুবই প্রয়োজন। ছোট্ট মানবিক উদ্যোগ, যেমন দুর্বলের পাশে দাঁড়ানো, অসহায়দের সাহায্য, এক আন্তরিক কথোপকথন—এগুলোই আমাদের মনকে শক্তি দেয়। প্রতিটি ভালো কাজ, প্রতিটি মানবিক সংযোগ, প্রতিটি সহমর্মিতার মুহূর্ত—এসব একত্রে সমাজকে আলোকিত করে।

আজকের যুবসমাজ এবং নতুন প্রজন্মের জন্য এই আলো আরও গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তির যুগে মানুষ সংযুক্ত হলেও মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন। সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতিটি স্ক্রিনে আমরা মানুষকে দেখতে পাই, কিন্তু মানুষের অনুভূতি, মানবিক সংযোগ, সহমর্মিতা এগুলো আমাদের চোখের সামনে নেই। এই বাস্তবিক অন্ধকারকে কাটাতে সমাজকে আরও সক্রিয় হতে হবে। প্রতিটি ছোট্ট উদ্যোগ বন্ধুত্বের একটি হাতছানি, সহকর্মীর পাশে থাকা, প্রতিবেশীর কষ্টে সাহায্য করা এগুলোই একদিন বড় আলোর সূচনা করবে।

শিশুদের হাসি, বন্ধুত্বের আড্ডা, পরিবারের স্নেহ—প্রতিটি মানবিক মুহূর্ত আমাদের জীবনে আলো নিয়ে আসে। ছোট ছোট আলো মিলিয়ে বড় আলো সৃষ্টি হয়। সমাজের ছোট্ট উদ্যোগগুলো একদিন পুরো সমাজকে আলোকিত করবে।

বিশেষ করে বর্তমান বিশ্বে প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে যেমন সহজ করেছে, তেমনি মানসিক চাপও বৃদ্ধি করেছে। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ফ্রান্সের মানুষদের ২৭% সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে মানসিক চাপ অনুভব করে। অপর দিকে প্রকৃত মানবিক সংযোগ চোখে চোখ রাখার যোগাযোগ, সরাসরি সংলাপ, সহানুভূতি এগুলো মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অপরিহার্য।

এখানে একটি বিশেষ উদাহরণ উল্লেখ করা যায়: প্যারিসের একটি শিশু বিকাশকেন্দ্রে প্রতিদিন ৫০-৬০ জন শিশু ও শিক্ষকের সঙ্গে খেলে, গল্প শোনে, আর একে অপরকে সহায়তা করে। এক শিশু জানাল, ‘আমি এখানে এসে একা অনুভব করি না। আমাদের গল্প, খেলা এবং হাসি আমাদের মনের অন্ধকার দূর করে। এই ছোট্ট জীবনের গল্পই দেখায়, মোহনীয় অন্ধকারকে আলো দিয়ে জয় করা সম্ভব।

আরও পড়ুন

মোহনীয় অন্ধকার কেটে যাবে তখনই, যখন আমরা নিজেই সেই আলো হব। প্রতিটি ছোট্ট উদ্যোগ, প্রতিটি সহানুভূতিশীল কাজ এবং প্রতিটি মানবিক সম্পর্ক—এগুলো একত্র হয়ে সমাজকে নতুন আলো দেয়। আমাদের চারপাশের অন্ধকার যত ঘন হোক না কেন, মানবিকতার আলো সব সময় জ্বলে থাকে। ছোট্ট উদ্যোগই একদিন বড় আলোর সূচনা।

আজ যদি আপনার চারপাশে অন্ধকার দেখা যায়, মনে রাখবেন, আপনার ছোট্ট ভালো কাজই আলোর শুরু। প্রতিটি হৃদয়ই আলো ছড়াতে পারে। মোহনীয় অন্ধকার কাটবে ঠিক তখনই, যখন আমরা নিজেই সেই আলো হয়ে উঠব।

‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]