জেমস জয়েসের ‘অ্যারাবি’: এক বিমূর্ত যাপনের উপাখ্যান

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

‘রাস্তা নির্জন। দুপাশে প্রেইরির সমভূমি, বরফে বরফে সাদা হয়ে আছে। বিশাল একটি বাটির মতো আকাশটা চারদিক ঢেকে রেখেছে। আকাশে নক্ষত্রের মেলা। কী অদ্ভুত তাদের আলো! নক্ষত্রের আলোয় কেমন অন্য রকম লাগে। বড় ইচ্ছা করে কারও কাছে যেতে।’ —তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়

ভাদ্র মাস প্রায় শেষের দিকে। অখণ্ড নীল আকাশ সমুদ্রের থেকে কিছুটা জীবন ধার নিয়েছে। বয়ঃসন্ধির প্রথম ভালো লাগা। ফুলেফেঁপে ওঠা মেঘের মতো মনেও অনেক ইচ্ছা, স্বপ্নের আখর। ‘গীতবিতান’–এর প্রেমপর্যায়ে কিংবা অঞ্জন-সুমনের প্রতি লাইনে খুঁজে পাওয়া তাকে।

দূরত্বকে বারবার মনে হয় বিমূর্ত, ছুঁতে চাওয়া যায় অথচ পাওয়া যায় না। এ ছায়া সব সময় ঘিরে রাখে ছেলেটিকে। আচ্ছা, এ দূরত্বও কি সত্যি? এ অবস্থায় নিদারুণ আগ্রহে অপেক্ষা শুরু হয় দুর্গাষ্টমীর। দুচোখ যেন শুধুই খুঁজছে শাড়ি পরিহিত সেই গড়ন। আজকের দিনটার উপলক্ষ সে। তারপর সেই বহু প্রতীক্ষিত ক্ষণ। মণ্ডপে তার আগমন। তবে সে একা নয়, তার জীবনগানের অর্ধেকাংশের অধিকারী তার পাশে। ব্যস, মুহূর্তে আবহাওয়া বদল। সঘন মেঘে ছেয়ে গেছে মন-সংসার। মন্ত্রের ইতিউতি কানেই ঢুকছে না আর। সে ভুলেই গেছে মায়ের পায়ে ফুল অর্পণ করে কী চাওয়ার ছিল তার। তার‌ই মধ্যে নেমে গেল আকাশভাঙা বৃষ্টি, শুরু হলো সন্ধিপূজা। ১০৮টি পদ্মের সঙ্গে ফুটে উঠছে জীবনের অর্থহীনতা। ১০৮টি প্রদীপকে ইন্ধন দিচ্ছে ধীরগতিতে ক্ষয় হতে থাকা দিকশূন্য মন। চলতে থাকা যজ্ঞের ধোঁয়ায় যেন বাক্যহারা হয়ে উঠছে জীবন। ঠিক এমন সময় যদি হঠাৎ ঘড়ির কাঁটা পাল্টে দিই? পৌঁছে যাই ১৯১৪ সালের সালের আয়ারল্যান্ডে, যদি বলি এক‌ই অনুভূতির শিকার সমবয়সী সেই ১৮ ছুঁই ছুঁই বিদেশি ছেলেটিও?

গল্পের শুরুতে চোখের সামনে প্রথমেই ভেসে ওঠে আয়ারল্যান্ডের এক নিঃস্তব্ধ মুখচোরা গলি, নাম নর্থ রিচমন্ড স্ট্রিট। কোলাহলের একমাত্র সূত্রপাত—যখন পাশের খ্রিষ্ট্রান স্কুলটি ছুটি হয়। গোটা গলি প্রায় গির্জার আকৃতির এবং সেই ধাঁচের মর্যাদা রেখেই গলির একদম শেষ প্রান্তে যে বাড়ি, তাতে ভাড়া নিয়ে এসেছিল এক তরুণ। মা–বাবা গত হওয়ায় সে কাকু-কাকিমার কাছেই থাকত। তবে এবার প্রশ্ন উঠতেই পারে, হঠাৎ আমাদের বহু চেনা এই পরিস্থিতির সঙ্গে এই বিদেশি ছেলের কী সম্বন্ধ? আসলে যতটুকু গল্পটা বলা হয়েছে, তত অবধি কোনো সম্বন্ধ না থাকলেও এবার হয়তো মিল পাওয়া যাবে।

১৯১৪ সালের আয়ারল্যান্ড, ব্রিটিশ শাসন ও যান্ত্রিকতার ধোঁয়াশায় গোটা দেশ। আকাশের রং দিন দিন প্রতিবাদের সুরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরিবর্তনশীল। আলো-আধাঁরির মাঝে কাটিয়ে দেওয়া বয়ঃসন্ধির সন্ধ্যাগুলো। তারপর একদিন আচমকাই ভালো লেগে যাওয়া। আশপাশের কত বাতাসই তো রোজ স্পর্শ করে যায়, অনুভূতিতে অধরা হয়েই থাকে তারা, দমকা হাওয়া হঠাৎ নাড়া দেয় অনুভূতির অতলে, বাধ্য করে একবার ফিরে তাকাতে আর সেই ফিরে দেখা থেকেই বারবার ফিরে যেতে চাওয়া। কোথাও ফিরতে পারার চেয়েও ফেরার চেষ্টাকে গন্তব্য করতে চাওয়ার আকুতি; আচ্ছা, ভালো লাগা থেকে যাওয়ার এগুলোই কি সূত্রপাত নয়?

“I may stop loving you, Sushila, but I will never stop loving the days I loved you you. ”- Ruskin Bond

ভাবানুবাদ: তোমার প্রতি আমার ভালোবাসা হয়তো একদিন ফুরিয়ে যাবে, সুশীলা, কিন্তু তোমাকে ভালোবেসে যাওয়ার দিনগুলোর প্রতি আমার ভালোবাসা কোনো দিন ফুরোবে না।

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

বড় হয়ে ওঠার সময় আমরা জীবনের এমন এক পর্যায় দিয়ে নিশ্চিতভাবে গিয়েছি, যেখানে আকুলভাবে কাউকে উৎসর্গ করেছি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ভালো লাগা তখনো সমর্পণের নয়, বন্ধুবৎসলতার মোড়কে মুড়িয়ে রেখেছে আমাদের দিন থেকে প্রতিদিন। বিদেশ হলেও তাই অনুভূতিটুকুর যাপনে সমান আর্তি। ১৮ ছুঁই ছুঁই এই যুবকেরও তাই এই নামহীন যুবতীর সঙ্গে অসীম আত্মীয়তা, পারস্পরিক না হলেও তার জীবনের অনেকটা আকর বোধ হয় এই মেয়ের কাছে।

‘রবীন্দ্রনাথেরও কাছে ভালোবাসা তিন শব্দের যোগে: তুমি আমি আর গান–তোমার আমার বিরহের অন্তরালে কেবলই তার সেতু বেঁধে যায় যে–গান, প্রেমের নয় শুধু, ভালোবাসার গান।’ —শঙ্খ ঘোষ, ‘এ আমির আবরণ’

তাই দিনের পর দিন দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি অবসরে খুঁজে পাওয়া যায় মেয়েটিকে। অবলীলায় ভেসে যাওয়া আবেগের জোয়ারে, অমোঘ প্রত্যাশায় কাটিয়ে ফেলা গোধূলি বিকেলগুলো। আচ্ছা, বয়ঃসন্ধির শিকার সেই বিদেশি ছেলেটি তো কখনো বোঝেনি শরীরের দাবি, তবে কী করে বুঝল যে শরীরের বাস্তব কুহককে ভেতরে রেখে প্রেমের সত্যকে মর্যাদা দিলে তবেই বোধ হয় পড়শীর সন্ধান পাওয়া যায়?

‘Love is not a feeling; it is an existential question. They say we as a people are doomed to be able to love, to be able to let our hearts be that Atlas holding up the celestial sphere, with no choice but to yield the burden. They say Atlas was cursed. ’

ভাবানুবাদ: ভালোবাসা শুধু এক হৃদয়াবেগ নয়; এটি একটি অস্তিত্ব–সম্বন্ধীয় জিজ্ঞাসা। ওরা বলে, আমরা ব্যক্তি হিসেবে ভালোবাসতে অপারগ, আমাদের হৃদয় সক্ষম হয়ে উঠেছে। মানচিত্রাবলি ধরে রেখেছে এই মহাকাশ, কোনো উৎকণ্ঠা নেই কিন্তু প্রস্ফুটিত বোঝা বয়ে চলেছে। ওরা বলে, মানচিত্রাবলি অভিশপ্ত।

অমোঘ প্রত্যাশায় তবু কাটিয়ে ফেলা বহুদিন, আর তারপর একদিন হঠাৎ করেই কাছে আসা। না চিনলেও সেই নামহীন যুবতী হঠাৎই দাদার বন্ধু সূত্রে যুবকটির সঙ্গে কথা বলা। তাকে জিজ্ঞেস করা সে ‘আরবির’ বিখ্যাত মেলায় যাবে কি না। যুবক সম্মতি জানালে নামহীন যুবতী জানায়, তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব হবে না, তার কনভেন্টে সেদিন এক অনুষ্ঠান। নিঃস্বার্থভাবে ভালোবাসা মেয়েটিকে অতঃপর তাকে কথা দিয়ে ফেলা‌ যে নিশ্চিতভাবে মেলা থেকে কিছু আনবে সে মেয়েটির জন্য। তাই নির্ধারিত দিনে বহু বাধা পেরিয়েও ক্ষুদ্র দুই আনার ভরসায় অপেক্ষার পারদ বুনতে বুনতে পৌঁছে যাওয়া স্বপ্নের সেই মেলায়। স্মৃতিসৌধ হিসেবে সারা জীবন যে স্মৃতিটুকু রাখতে চেয়েছিল নিজের কাছে, তা যেন নিষ্প্রয়োজনীয়তার ফলক হয়ে ধরা দিল চোখের সামনে। সেদিনের মেলাটা চোখের সামনে মেলে ধরেছিল জীবনের পরম সত্য।

“A phrase in connection first with she occurred

That love is just a four-letter word. ”- Joan Baez

ভাবানুবাদ: এক হয়ে ওঠা সহজাত যোগাযোগ তার প্রথম আগমনে; ভালোবাসা, একটি চার অক্ষরের শব্দ।

বিদগ্ধ মনে সেদিন যেন একটা অনুভূতিরই হাহাকার, কে থাকবে, কী থাকবে এ জীবনে? যে জীবন থেকে চার ভাগের এক ভাগ পূর্তির পথে। সেদিনের ওই জলস্রোতে ভেসে চলে গেছে যে কবিতারা, ওরই মধ্যে তো রয়ে গিয়েছে আমাদের এই অপরূপ কাছে আসা। ভোররাতে লুকিয়ে লুকিয়ে পাওয়ার ভঙ্গিতে না-পাওয়া, পরস্পরকে আবিষ্কার করা, কত কষ্টের মধ্যেই তো আমাদের গোটা আয়ুষ্কালের চুরি না-করতে-পারা একেকটা ভোর, রয়ে গেছে। রয়ে গেছে অবধারিত দূরে চলে যাওয়া। সবই তো রয়ে গেছে, ছোটবেলায় আমাদের না-হতে-পারা শিশুর মতো। জীবনের কিছু কিছু সম্পর্ক পরিচয় দ্বারা সীমায়িত হয়ে আছে। তবেই তো বুঝতে পারা যায়, দেখতে পাওয়া যায়, আমাদের দুই সীমান্তের মধ্যবর্তী জায়গাটা, যে নো–ম্যান্স–ল্যান্ডে দাঁড়ালে মনের কথা বলার অসিলায় কাঁটাতারের অস্তিত্ব বিলীন হয়।

“The chastest expression I have ever heard: In true love it's the soul which envelops the body. ”

-Friedrich Nietzsche, Beyond Good And Evil

ভাবানুবাদ: জীবনের সবচেয়ে প্রকাশঘন অভিব্যক্তি আমার কর্ণগোচর হয়েছে: খাঁটি ভালোবাসায় এই হলো সেই হৃদয়, যা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে তনু-মন-প্রাণ।

এভাবেই অনুভূতির যাপন প্রকাশ পেয়েছে বিদেশি সাহিত্যিক জেমস জয়েসের ছোটগল্প ‘অ্যারাবি’-তে। নিপুণ ছন্দের পটভূমিতে গড়া ছোটগল্প ‘অ্যারাবি’ আকুলভাবে প্রকাশ করে বয়ঃসন্ধির আকাঙ্ক্ষা ও মোহভঙ্গকে। জীবনসত্যের পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশদ বর্ণনা করতে করতে জয়েস সত্তাকে নিষ্প্রয়োজনীতার প্রয়োজনের মুখোমুখি দাঁড় করায়। যে আকাঙ্ক্ষারা স্থান পায় এক অমেয় অন্ধকারে, জয়েস বুঝিয়েছেন তারাই বুঝি জ্বেলেছে আলো প্রাণের স্পন্দনে।