দেশে-বিদেশে আমার দেখা কোরবানি
*পৃথিবীজুড়ে ধর্ম ও ইতিহাস—
পৃথিবীজুড়ে যত মানুষ আছে, সবাই কোনো না কোনো ধর্মে বিশ্বাসী।
*কোরবানি এবং আত্মত্যাগ
ইব্রাহিম (আ.)-এর পর থেকে স্যাক্রিফাইস শব্দটি শুরু হয়। আমরা মুসলমানরা হজ ও কোরবানি পালন করে আসছি, কিন্তু প্রকৃত স্যাক্রিফাইস বা ত্যাগের অর্থ এখনো অনেকেই পুরোপুরি উপলব্ধি করতে পারিনি। স্যাক্রিফাইস মানে উৎসর্গ হলেও আমি ছাড় দেওয়া শব্দটি ব্যবহার করেছি আলোচনায় সুবিধার জন্য।
*কোরবানির অভিজ্ঞতা দেশে-বিদেশে
সৌদি আরব
মক্কা-মদিনার পবিত্র ভূমি সৌদি আরবে ঈদুল আজহা উদ্যাপন এককথায় অনন্য অভিজ্ঞতা। লাখো মুসল্লির উপস্থিতি এবং হজ পালন প্রধান আকর্ষণ। ফজরের নামাজের পর মিনা, মুজদালিফা ও আরাফাতের ময়দানে কোরবানি শুরু হয়। পরিবারের সঙ্গে একত্র হয়ে নামাজ আদায়, সুস্বাদু খাবারের আয়োজন এবং কোরবানির মাংস বিতরণ দিনটিকে বিশেষ করে তোলে।
*তুরস্ক
তুরস্কে কোরবানির পশু কেনার জন্য বড় বড় বাজারে মানুষের ভিড় লক্ষ করা যায়। পূর্ব তুরস্ক থেকে কোরবানির পশু আনা হয়। তুর্কি পরিবারগুলো নিজেদের ঘরে বা নির্দিষ্ট স্থানে কোরবানি করে। তুর্কি মিষ্টান্ন, বিশেষ করে বাকলাভা এবং ঈদের বিশেষ খাবার তৈরি করা হয়। শিশুদের মধ্যে উপহার বিতরণ এবং পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানোর প্রচলন রয়েছে।
*মিসর
মিসরে রাস্তায় রাস্তায় পশু কোরবানি করা হয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে নির্দিষ্ট কোরবানির স্থান নির্ধারণ করা হয়। ভোরে মসজিদে গিয়ে নামাজ আদায় করার পর কোরবানির কাজ শুরু হয়। জনপ্রিয় খাবার কুসারি, কাবাব ও ফালাফেল দিয়ে বিশেষ ভোজ আয়োজন করা হয়। সামাজিক সম্প্রদায়ের মধ্যে মাংস বিতরণ ও দান করার প্রচলন রয়েছে।
*ইন্দোনেশিয়া
ইন্দোনেশিয়ায় কোরবানি আমাদের দেশের মতোই উদ্যাপিত হয়। পরিবারের সঙ্গে একত্র হয়ে নামাজ আদায়, পশু কোরবানি ও মাংস বিতরণ করা হয়। গ্রামাঞ্চলে সময়টি খুবই প্রাণবন্ত থাকে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে কোরবানির পশু কেনা ও বিতরণের ব্যবস্থা থাকে। ঐতিহ্যবাহী খাবার সাতে (শশলিক) ও রেন্ডাং বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়।
*যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা
কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে ঈদুল আজহা উদ্যাপন ভিন্নধর্মী। মুসলিম কমিউনিটি মসজিদ বা ইসলামিক সেন্টারে একত্র হয় ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য। কোরবানি করার জন্য নির্দিষ্ট কোরবানির স্থানে যাওয়া হয়। কোরবানির মাংস সংরক্ষণ ও বিতরণের জন্য বিভিন্ন সংগঠন ও দাতব্য প্রতিষ্ঠান কাজ করে। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে বারবিকিউ পার্টির আয়োজন ও শিশুদের উপহার দেওয়া হয়।
*যুক্তরাজ্য
যুক্তরাজ্যে মুসলিম সম্প্রদায়ের ঐক্যবদ্ধ লক্ষণীয়। বিভিন্ন শহরের মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। কোরবানির পশু কেনা ও কোরবানি করার জন্য নির্দিষ্ট পশুর খামার ও কসাইখানা রয়েছে। কোরবানির মাংস দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়। পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে বিশেষ খাবারের আয়োজন করা হয়।
*ফ্রান্স
ফ্রান্সে মুসলিম সম্প্রদায় উদ্দীপনার সঙ্গে ঈদুল আজহা উদ্যাপন করে। প্যারিস, মার্সেই ও লিওসহ বড় বড় শহরে মসজিদে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। সরকার অনুমোদিত পশু জবাই কেন্দ্র রয়েছে। মুসলিম পরিবারগুলো কোরবানির মাংস নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় এবং দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করে।
*জার্মানি
জার্মানিতে মুসলিম কমিউনিটির সদস্যরা একত্র হয়। বার্লিন, ফ্রাঙ্কফুর্ট ও হামবুর্গসহ শহরের মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। কোরবানির পশু কেনার জন্য বিশেষ খামার ও হালাল মাংসের দোকান রয়েছে। মুসলিম পরিবারগুলো কোরবানির মাংস নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয় এবং কিছু অংশ দান করে।
*নেদারল্যান্ডস
নেদারল্যান্ডসে উৎসবমুখর পরিবেশে ঈদুল আজহা উদ্যাপন হয়। আমস্টারডাম, রটারডাম ও হেগের মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজের আয়োজন করা হয়। কোরবানির জন্য নির্দিষ্ট স্থান ও পশুর খামার রয়েছে। কোরবানির মাংস পরিবার ও দরিদ্রদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। ডাচ ও মুসলিম খাবারের সংমিশ্রণে বিশেষ ভোজের আয়োজন করা হয়।
*সুইডেন ও অন্যান্য নর্ডিক দেশগুলো
নর্ডিক দেশগুলোসহ সুইডেনে ঈদুল আজহা উদ্যাপন পারিবারিক ও সামাজিক মিলনের সুযোগ এনে দেয়। নর্ডিক দেশগুলোর বড় বড় শহরগুলোতে মসজিদ রয়েছে এবং সেখানে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। সুইডেনে স্টকহোম, গোথেনবার্গ ও মালমোর মসজিদগুলোতে ঈদের নামাজ আদায় করা হয়। কোরবানির পশু কেনা ও কোরবানি করার জন্য নির্দিষ্ট পশুর খামার রয়েছে। মুসলিম পরিবারগুলো কোরবানির মাংস নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়।
*ঈদুল আজহা কেবল এক দিনের জন্য নয়
ঈদুল আজহা বছরে একবার পালিত হলেও এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য ও শিক্ষা সারা বছর ধরে মুসলিমদের জীবনে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। ঈদুল আজহার মূল উদ্দেশ্য হলো—
১. আত্মত্যাগ ও সংযম: জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ত্যাগ ও সংযমের গুরুত্ব উপলব্ধি করা;
২. আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস ও আনুগত্য: আল্লাহর আদেশ এবং তাঁর প্রতি বিশ্বাসের নিদর্শন হিসেবে আত্মত্যাগ করা;
৩. সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধ: কোরবানির মাংস বিতরণের মাধ্যমে সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রতি সহানুভূতি ও দায়িত্ববোধ।
*বাংলাদেশে ঈদুল আজহা উদ্যাপন
বাংলাদেশে ঈদুল আজহা উদ্যাপনের সময় লাখ লাখ টাকা খরচ করে গরু, ছাগল, উট বা ভেড়া কিনে কোরবানি করা হয়। এ মহৎ উদ্দেশ্য পালন করা হলেও কোরবানির আসল উদ্দেশ্য যেন প্রতিফলিত হয়, সেদিকে লক্ষ রাখা জরুরি।
কিছু পর্যবেক্ষণ
১.
আত্মপ্রচারের পরিবর্তে প্রকৃত ত্যাগ: অনেক সময় দেখা যায় যে, কোরবানির পশু কেনার ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা ও প্রদর্শনীর প্রবণতা থাকে। বড় পশু কোরবানি করার মাধ্যমে সামাজিক মর্যাদা দেখানোর প্রবণতা কখনো কখনো প্রকৃত ত্যাগের মূল উদ্দেশ্যকে আড়াল করে দেয়। ইদুল আজহা কেবল প্রদর্শনের জন্য নয় বরং আন্তরিকভাবে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য হওয়া উচিত।
২.
দরিদ্র ও অসহায়দের প্রতি দায়িত্ববোধ: কোরবানির মাংস সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মধ্যে বিতরণ করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায়, মাংস বিতরণ সঠিকভাবে হয় না এবং তা শুধু আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। সমাজের সব স্তরের মানুষের মধ্যে ন্যায্যভাবে মাংস বিতরণ করা ঈদুল আজহার অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য।
৩. পরিবেশসচেতনতা ও পরিচ্ছন্নতা: কোরবানির সময় পরিচ্ছন্নতা রক্ষা করা এবং পরিবেশের ক্ষতি না করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। অনেক সময় দেখা যায়, কোরবানির পর রাস্তা ও আশপাশের পরিবেশ নোংরা হয়ে যায়। ইসলামের শিক্ষা হলো পরিচ্ছন্নতা এবং এটি কোরবানির সময়ও মেনে চলা উচিত।
বিশ্বের মুসলিম জনগোষ্ঠীর প্রশ্ন: ইউরোপে ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারি ছুটি নেই কেন?
ইউরোপের বেশির ভাগ দেশেই ঈদুল আজহা উপলক্ষে সরকারি ছুটি নেই। এর প্রধান কারণ হলো এই দেশগুলোর ধর্মনিরপেক্ষতা এবং সেখানে মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত কম হওয়া। ইউরোপের দেশগুলোতে সরকারি ছুটি সাধারণত খ্রিষ্টান ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা জাতীয় দিবসগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত হয়। মুসলিম জনসংখ্যার অনুপাত কম থাকায় এবং বিভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির মানুষের সহাবস্থান থাকায়, সরকার সাধারণত কোনো নির্দিষ্ট ধর্মীয় অনুষ্ঠানকে সরকারি ছুটি হিসেবে ঘোষণা করে না। তবে মুসলিম কমিউনিটির সদস্যরা ব্যক্তিগতভাবে এবং নিজেদের সম্প্রদায়ের মধ্যে এই দিনটি উদ্যাপন করে থাকেন।
উপসংহার
ঈদুল আজহা হলো আত্মত্যাগ, সংযম ও আল্লাহর প্রতি আনুগত্যের প্রতীক। বছরে একবার এ উৎসব পালিত হলেও এর মূল শিক্ষা সারা বছর আমাদের জীবনে প্রতিফলিত হওয়া উচিত। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কোরবানির সময় যে আড়ম্বর ও প্রতিযোগিতা দেখা যায়, তা থেকে বিরত থেকে কোরবানির আসল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন করা জরুরি। সমাজের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের প্রতি দায়িত্ববোধ এবং পরিবেশের প্রতি সচেতনতা রেখে ইদুল আজহা উদ্যাপন করা আমাদের সবার লক্ষ্য হওয়া উচিত।
*লেখক: রহমান মৃধা, সাবেক পরিচালক, ফাইজার, সুইডেন
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]