হাজার বর্ষা রাত

কাঁকন একটা কফি শপে কাজ করে আমেরিকার স্যানহোসে শহরে। খুব সকালে কাজে আসতে হয় রোজ ওকে। নিত্যকার রুটিন। হেমন্তের সকালগুলো একটু একটু শীতের আমেজমাখা। অন্ধকারে উষ্ম বিছানা ছেড়ে কাজে আসতে ওর খুব কষ্ট হয় ইদানীং। কিন্তু আজকে বাসস্ট্যান্ডের পথে হাঁটতে হাঁটতে টের পেল মাথার ওপর ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। ছোটবেলা থেকেই ভীষণ আনন্দ আর মুগ্ধতা নিয়ে আসে বৃষ্টি ওর মনে; যেন কোনো ভালোবাসার স্পর্শ ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। নাচতে জানলে বৃষ্টির ছন্দের সঙ্গে নাচত ও। বাসে কাজে আসতে ৪০ মিনিট সময় লাগে। এর মাঝে জানালার কাচে বৃষ্টির নাচ, ভোরের লালচে আলো আর রংধনুর সাত রং দেখে কখন সময়টা চলে গেল আজ, কাঁকন জানে না। বাসস্টপে নেমে ইচ্ছা করে জ্যাকেটের হুডি তুলে দিল না ও। ভিজল আর ঠান্ডা বাতাসের মুগ্ধতা নিয়ে কফি শপে ঢুকল।

দোকানে ঢুকে নিত্যকার মতো কফি মেশিন পরিষ্কার করে কাজ শুরু করেছে, এমন সময় শুনল, ওদের কফি শপে নাকি আজ একজন সেলিব্রিটি আসবেন। কফি খাবেন আর অটোগ্রাফ দেবেন নিজের লেখা বইতে। তার মানে অন্যান্য দিনের চেয়েও কাজের চাপ অনেক বেশি হবে। বৃষ্টিবিলাসের চিন্তা বাদ দিয়ে ঝটপট কাজ গোছানো শুরু করল ওরা। কফি শপের মালিক বইপোকা। শহরের ব্যস্ততম জায়গায় এ শপে পাঠক-লেখকদের ভিড় লেগেই থাকে। শপে একটা শেলফভর্তি বই থাকে। অনেকেই পাতা উল্টায় কফি খেতে খেতে।

বেলা ১১টার দিকে রেইনকোট পরা একজন কাস্টমার এলেন। গ্র্যান্ড হট ক্যারামেল লটে চাইলেন। তারপর বসলেন কোনার দিকে একটা টেবিলে। কাঁকন কফি বানিয়ে তাঁর টেবিলে নামিয়ে রাখতে রাখতে আগন্তুকের দিকে তাকাল। আরে উনি তো ওর দেশি একজন সেলিব্রিটি, ওনার বৃষ্টি নিয়ে লেখা গানগুলো কত হাজারবার শুনেছে ও। বলল, আপনি আনন্দমুখর একটা গান লিখবেন বৃষ্টিকে নিয়ে। যাতে মন খুব ভালো হয়ে যায়, শুনেই যেন মনে হয় একটা মেয়ে মনের আনন্দে বৃষ্টিতে নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। উনি হেসে বললেন, এই মেয়ে, আমাকে গান লেখার ফরমাশ করছ তুমি? তুমি জানো আমি কে? কাঁকন বলল, স্যানহোসে শহরে বাংলায় কথা বলছেন, আপনি জানেন আমি কে? আমি তো বাংলাদেশের এক মেয়ে। ভক্তদের অনুরোধ থাকবে না? বলে চলে আসবে, এমন সময় উনি বললেন, তোমার শহরটা ঘুরে দেখিয়ো, কেমন? দেখি আনন্দময় বৃষ্টির কিছু ছন্দ তোমার হাতে তুলে দিতে পারি কি না।

একটু পর ওনার প্রকাশক এলেন বই হাতে আর এরপর প্রায় সারা দিন ভক্তরা ভিড় জমিয়ে রাখল ওনার আশপাশে। প্রচণ্ড ব্যস্ত একটা দিন গড়িয়ে কখন সন্ধ্যা হয়ে গেল কাঁকন জানে না। সবকিছু গুছিয়ে দোকান বন্ধ করে বাসস্টপে চলে এল ও। প্রায় ১৫ মিনিট পর বাস এল। বাসে বসে চোখটা একটু বন্ধ হয়ে আসতেই মনে হলো সকালের সেই সেলিব্রিটি আগন্তুক এসে বসেছেন পাশে। বললেন ঘুমাচ্ছ, ঘুমাও, সরি। কাঁকন বলল, না, আনন্দিত বৃষ্টির সুর তো আমি বাসে বসেই শুনি। আজকে না হয় সুরের স্রষ্টার কথা শুনব। কথা বলতে বলতে যে যার গন্তব্যে পৌঁছে গেল। ঠিক হলো পরদিন কাজে ছুটি নিয়ে সেলিব্রিটিকে কাঁকন সেভেনটিন মাইলস রোডে বেড়াতে নিয়ে যাবে।

পরদিন হোটেল থেকে তুলে নিল কাঁকন সেলিব্রিটিকে। সেভেনটিন মাইলস একটা সমুদ্র আর পাহাড়ের মাঝের রাস্তা, পাহাড়ের মাথায় সারি সারি বাড়ি। আঁকাবাঁকা অনেকটা পথ পাড়ি দিয়ে বাড়িগুলোয় যেতে হয়। বহুদিন ওদিকে তাকিয়ে থেকে কাঁকনের মনে হয়েছে, ওর স্বপ্নে দেখা রাজপুত্র এ বুঝি ঘোড়ায় চড়ে এসে দাঁড়াবে। ছোট্টবেলার স্বপ্ন সত্যি হয়ে ধরা দেবে। রাস্তায় নামতেই নামল ঝুম বৃষ্টি। সমুদ্রের ঢেউগুলো উত্তাল, হাতের কাছে কালো মেঘ, উনি গাড়ির কাচ নামিয়ে হাত দিয়ে মেঘ ছুঁয়ে চলেছেন। কাঁকন বলল, কাচ তুলে দিন না গাড়ির। ঠান্ডা লেগে যাবে তো। উনি বললেন, আনন্দটুকু আগে গায়ে মাখি তারপর গান।

এমন সময় কে যেন মনে হলো অনেক দূর থেকে কাঁকনকে ডেকে তুলছে। কাঁকন ঘুম থেকে জেগে উঠল। দীর্ঘদিন একই গন্তব্যে নামে দেখে বাসের চালক আজকে ওকে ডেকে তুলছেন। বুঝেছেন ক্লান্ত কাঁকন ঘুমিয়ে গেছে। পাশে তাকিয়ে কাঁকন দেখল ওর পাশে আসলে কেউ বসে নেই। পুরোটাই একটা স্বপ্ন ছিল। বাসায় হেঁটে আসার পথটুকু গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে লেখকের সুরে কাঁকন গাইল, ‘মেঘের ডানায় পাঠিয়ে দিলাম আমি হাজার বর্ষা রাত’।