আন্তালিয়া-আলানিয়া: রোদ, ইতিহাস আর হৃদয়ের সংলগ্ন এক ভ্রমণ
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
স্টকহোম আরলান্ডা এয়ারপোর্টে বসে আছি। আমাদের ফ্লাইট প্রায় এক ঘণ্টা দেরিতে ছাড়বে বলে ঘোষণা এসেছে। জানালার ওপারে নীল-ধূসর আকাশে কিছুটা অস্থিরতা, বিমানের ডানায় জ্বলজ্বল করে উঠছে সতর্ক আলো। অথচ আমার মন ইতিমধ্যে পৌঁছে গেছে সেই নীল উপকূলের শহরে—আন্তালিয়ায়।
ঠিক এই মুহূর্তে পৃথিবীর একদিকে যুদ্ধের আতঙ্ক, অন্যদিকে পর্যটনের প্রতিশ্রুতি। গত রাতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প হঠাৎ করে ইরানের তিনটি সন্দেহজনক রাসায়নিক ঘাঁটিতে আঘাত হেনেছেন। তার প্রতিক্রিয়ায় বিশ্বমিডিয়া উত্তাল, তেল ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত শঙ্কায় ইউরোপের মুদ্রাবাজারে নড়াচড়া দেখা দিয়েছে। এমনকি শান্তিপ্রিয় সুইডেনেও কিছু প্রতিক্রিয়া পড়তে শুরু করেছে—এয়ার ট্রাফিক আরও সতর্ক, নিরাপত্তা জোরদার।
তবে আমি যাচ্ছি একেবারে অন্য মেরুতে—ভূমধ্যসাগরের তীরঘেঁষা তুরস্কের এক শহরে, যার দুই প্রান্তে দুই বিপরীত বাস্তবতা: এক প্রান্তে ইসরায়েলের আগ্রাসন, আরেক প্রান্তে আন্তালিয়ার নীল সমুদ্র, পাথুরে উপকূল আর ইতিহাসের গর্ভে ডুবে থাকা গলিপথ। এমনই এক শহরে আমি পা রাখতে চলেছি, যেখানে রোদ আর রোমান সভ্যতা পাশাপাশি বসে থাকে।
আন্তালিয়া শুধু একটি শহর নয়—এটি একটি অনিবার্য মিলনস্থল: ইতিহাসের, প্রকৃতির আর কূটনৈতিক বাস্তবতার। যেখানে হাদ্রিয়ান গেটের নিচে দাঁড়িয়ে আপনি ভাবতে পারেন, সময় কেমন করে গত দুই হাজার বছর ধরে একটানা বয়ে চলেছে। যেখানে কালেয়িচির ঘরগুলোর জানালায় লটকে থাকা রঙিন ফুল আপনাকে মনে করিয়ে দেয়, মানুষ এখনো সৌন্দর্যের পেছনে ছোটে।
এবং হ্যাঁ, তুরস্ক এখন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মঞ্চে উচ্চকণ্ঠ। কূটনীতিক চাপ বাড়ছে, যার এক পাশে মানবতা, অন্য পাশে রাজনীতি। এই বাস্তবতায় দাঁড়িয়ে আন্তালিয়া হয়ে উঠছে না কেবলই ছুটির গন্তব্য, বরং এক প্রকার নীরব প্রতিবাদ, এক নিরাপদ আশ্রয়, যেখানে আপনি পালাতে পারেন রক্ত, বোমা আর হেডলাইন থেকে। আপনি যেতে পারেন সমুদ্রের ঢেউয়ের নিচে, যেখানে নেই টেলিপ্রম্পটার, নেই খবর, কেবলই আকাশ আর পানি।
তুরস্কে পৌঁছে আমি রওনা দেব ডুডেন ঝরনার পথে। সেই জলপ্রপাত, যার পানি নেমে যায় সোজা সাগরে—যেখানে প্রকৃতি যেন সভ্যতার চেয়ে পুরোনো। কিংবা আমি হয়তো হারিয়ে যাব আন্তালিয়ার কোনো ক্যাফেতে, ছোট্ট এক এস্তানবুলের মতো যেখানে তুর্কি কফির গন্ধে ওসমানীয় যুগের স্মৃতি জেগে ওঠে।
এ শহরটি শুধু ভ্রমণকারীদের জন্য নয়, তাদের জন্যও, যারা সত্যি সত্যিই কিছু অনুভব করতে চায়। যারা বুঝতে চায়, শান্তি মানে কেবল নীরবতা নয়—একটা উপলব্ধি, একটা অবস্থান।
তুরস্কের নীলাভ উপকূল ধরে যখন ছোট্ট উড়োজাহাজটা নেমে আসছিল, তখন দূর থেকে যে শহরটা মেরিনার মতো চকচক করছিল, সেটাই ছিল আন্তালিয়া। ভূমধ্যসাগরের কোলে অবস্থিত এ শহরটিকে আমি আগেও কয়েকবার দেখেছি, কিন্তু এই প্রথম লিখতে বসেছি। আজ এই মুহূর্তে, জুনের রোদমাখা দুপুরে, আমি সত্যিই এখানে—ইতিহাস, প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর আধুনিক বিলাসবহুলতার এক অনন্য মিলনস্থলে।
বিমানবন্দর থেকে বের হতেই যেন সমুদ্রের নোনাজল গায়ে এসে লাগল। পাইনগাছের সুবাস আর গরম বাতাসে এক অদ্ভুত মুক্তির গন্ধ। সোজা রওনা দিলাম কালেয়িচি—পুরোনো আন্তালিয়ার হৃদয়। পাথরের আঁকাবাঁকা রাস্তা, ওসমানী কালের বাড়ি আর প্রতিটি কর্নারে ছোট্ট ক্যাফে—সবকিছু যেন সময়ের মধ্যেই আটকে আছে। এখানেই আমি দেখলাম সেই প্রাচীন হাদ্রিয়ান গেট, যা দ্বিতীয় শতাব্দীতে রোমান সম্রাট হাদ্রিয়ানের স্মরণে নির্মিত। সেই মুহূর্তে আমার মনে হচ্ছিল আমি যেন কোনো সময়যানে চেপে ইতিহাসের ভেতরে ঢুকে পড়েছি।
পরদিন ভোরবেলা রওনা দিলাম ডুডেন ঝরনা দেখতে। শহরের একেবারে কাছে এমন অপূর্ব এক প্রাকৃতিক বিস্ময় যে লুকিয়ে থাকতে পারে, তা আমি ভাবতেই পারিনি। ঝরনার তীব্র শব্দ আর পানির ছিটেফোঁটা মুখে লাগতেই মনে হলো—প্রকৃতি যেন নিজেই শুভেচ্ছা জানাচ্ছে।
তবে আন্তালিয়ার সবচেয়ে মনছোঁয়া অংশটা ছিল এর মানুষ। স্থানীয় তুর্কি বৃদ্ধ যখন বললেন, ‘Sen kalbinde tadn ne varsa, burada yankı bulur’ (তোমার হৃদয়ে যা আছে, তা এখানে প্রতিধ্বনিত হয়), তখন আমি বুঝলাম—এই শহর কেবল একটি স্থান নয়, এটি একটি অনুভূতি। আন্তালিয়া শুধু চোখকে নয়, হৃদয়কেও জাগিয়ে তোলে।
সন্ধ্যায় হারবারে বসে মাছ ভাজা খেতে খেতে, দূরের আলো আর নৌকার প্রতিচ্ছবি দেখে মনে হচ্ছিল—আমি কোনো রূপকথার উপকূলে বসে আছি। অচেনা মানুষ, অচেনা ভাষা অথচ মনে হচ্ছিল এই শহরের সঙ্গে আমার বহু পুরোনো কোনো আত্মীয়তা আছে।
ভূমধ্যসাগরের ঠিক দক্ষিণে, তুরস্কের আনাতোলিয়ান উপকূলে ছড়িয়ে থাকা পাহাড়ের গায়ে যে শহরটি ঝুলে আছে—তার নাম আলানিয়া। পর্যটকেরা একে বলেন ‘সমুদ্র-রোদ আর প্রাচীন দুর্গের শহর’। কেউ কেউ বলেন, এ শহর জীবনের বাকি অংশ শুরু করার উপযুক্ত জায়গা। লাল পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা সেই ১৩ শতকের দুর্গ—Alanya Castle—উঁকি দেয় ইতিহাসের আড়াল থেকে আর নিচে ঝলমলিয়ে ওঠে ক্লিওপেট্রা বিচ—যেখানে শোনা যায়, প্রাচীন মিসরের রানি নিজ হাতে বালু ছড়িয়ে গিয়েছিলেন।
আর যখন সূর্য সাগরের পানিতে লালচে ছায়া ফেলছিল, আমি দাঁড়িয়ে ছিলাম ক্লিওপেট্রা বিচে। এমন শান্ত, স্বচ্ছ আর কোমল ঢেউ আগে কোথাও দেখিনি। লং চেয়ারয়ে হেলান দিয়ে, হাতে ঠান্ডা লেবু পানীয়, দূরে পাল তুলে ভেসে চলা নৌকা দেখে মনে হচ্ছিল—জীবন একটু থেমে থাকুক এখানে।
এই শহর ঠিক কতটা পর্যটনের আর কতটা প্রতীক্ষার, তা বলা মুশকিল। হয়তো যাঁরা এখানে আসেন, তাঁদের কারও অপেক্ষা ছিল নির্জনতা, কারও মুক্তির, আবার কারও নিজের কাছে ফিরে যাওয়ার।
ঘুমটা ঠিক কখন এসেছিল মনে নেই। হয়তো ভোররাতে, যখন বাইরে হালকা বৃষ্টির মতো শব্দ হচ্ছিল—হয়তো বাতাসে পামগাছের পাতা দুলছিল, কিংবা হয়তো আমার ক্লান্তি আর মানসিক অস্থিরতা পরস্পরকে নিঃশেষ করে একটা নিঃশব্দ চুক্তিতে পৌঁছেছিল।
তবে যখন ঘুম ভাঙে, তখন জানালার কাচে রোদ এসে ধাক্কা মারছে।
আলানিয়ার সকালের আলো এমন, যেন আপনি এক অন্য জগতের শরীরে ঢুকে পড়েছেন।
হোটেলের বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। নিচে সুইমিংপুলে কিছু মানুষ ঘোরাফেরা করছে। দূরে সমুদ্ররেখা—ধূসর নীলের পাশে বালুর সোনালি বিস্তার। এতটা শান্ত, এতটা সুনসান অথচ জীবন্ত এক দৃশ্য আগে দেখিনি।
সেই মুহূর্তে মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি একটা বিরতি পেয়েছি—সময়ের, ক্লান্তির, এবং সবুজাভ দুশ্চিন্তার।
আলানিয়া শুধুই একটা সমুদ্রতীরের শহর নয়, এটি অনেকখানি অপেক্ষা—যেমন একধরনের ছুটিরও প্রতীক্ষা, নিজের ভেতরে ফেরার প্রতীক্ষা। চারপাশের পাহাড়, দুর্গ, উপকূল আর সেই অতীত—সব মিলিয়ে যেন এক গূঢ় নীরবতা। আপনি যদি সেই নীরবতাকে জায়গা দেন, তাহলে সে কথা বলবে।
অনেক কিছু বলবে।
সকালের আলো একটু একটু করে জানালার পর্দা ঠেলে ভেতরে ঢুকছিল আর আমি উঠে দাঁড়িয়ে এলাম বারান্দায়। সাগর তখনো কিছুটা কুয়াশার মতো নীল, কিন্তু বাতাসে ছিল অদ্ভুত এক তাজা ঘ্রাণ—লবণ, বালু আর বেঁচে থাকার গন্ধ।
টার্কিশ ব্রেকফাস্টের জন্য নেমে এলাম হোটেলের ছাদের রেস্টুরেন্টে। হোটেলের খাবারঘরে গিয়ে দেখি অল ইনক্লুসিভ ব্রেকফাস্টের আয়োজন চলছে। একপাশে নানা ধরনের পনির, টমেটো-জলপাই-ডিমের মেলবন্ধন, অন্যদিকে মধু আর রুটি—তুরস্কের ক্ল্যাসিক সকালের অভ্যর্থনা। কফি হাতে নিয়ে বসে পড়লাম জানালার ধারে।
আর তখনই যেন বুঝতে পারলাম—এই শহর আমাকে তাড়াহুড়া করতে বলছে না।
এই শহর আমাকে থামতে বলছে।
শুধু দেখতে, শুনতে, শুষে নিতে বলছে।
কিন্তু সবচেয়ে বেশি ছিল যা, তা হলো ভূমধ্যসাগরের দৃশ্য। ঠিক সামনেই জলের গভীর নীল এক বিস্তার, আমি তাকিয়ে ছিলাম আর ভাবছিলাম—এমন শান্ত, এমন শুদ্ধ একটা সকাল আমি শেষ কবে পেয়েছিলাম?
খাওয়া শেষে আর দেরি করিনি, নামলাম সরাসরি সাগরে। প্রথম পা রাখতেই জলের শীতল স্পর্শে কেঁপে উঠেছিলাম, তারপর যখন পুরো শরীর ডুবে গেল সেই নীলের ভেতরে—মনে হলো আমি যেন হারিয়ে যাচ্ছি। মনে পড়ে গেল ছোটবেলার সেই সাঁতার, খেলার ছলে জলে ডুবে থাকা, নিঃশব্দে শুয়ে থাকা সেই ছায়াঘেরা পুকুরের জল।
এখানে, এই আলানিয়ায়, আমি যেন নিজের অতীতে ফিরে গেছি। বাস্তবতাকে যেন কিছুক্ষণের জন্য স্থগিত রাখা গেছে। কেউ কিছু চায় না, কেউ কিছু জিজ্ঞেস করে না—শুধু ঢেউ এসে বলে যায়: ‘এখানে তুমি ঠিক আছ।’
লোকাল লাঞ্চ আর দুপুরের অলসতা
সাগরের জলে কিছুটা সময় কাটিয়ে আমি দুপুরে বের হলাম স্থানীয় এক ছোট্ট রেস্টুরেন্টে—হোটেল থেকে সামান্য দূরে, যেখানে স্থানীয় লোকেরা খেতে আসে।
সেখানে পেলাম আলানিয়ার ঘরোয়া খাবার: গরম গরম ‘কেবাব’, ডালনার মতো ‘mam bayıld’, পাশে দই, সঙ্গে তাজা রুটি। পরিবেশন করছিল এক হাসিখুশি বৃদ্ধা, যার চুলে জড়ানো ছিল গোলাপি রুমাল, মুখে প্রশান্ত হাসি।
খাওয়া শেষে আমি হাঁটতে হাঁটতে আবার ফিরে এলাম হোটেলে, কিছুক্ষণ বিশ্রাম, তারপর আবার সেই চেনা পথ—সাগরের ধারে। দিন যেন এক নীরবচেতন পুনরাবৃত্তি, কিন্তু প্রতিবারই নতুন স্বাদের।
আলানিয়া রাসেল: পাহাড়চূড়ার পথে ইতিহাসের হাতছানি
ভূমধ্যসাগরের নীল জলরেখা যখন তুরস্কের দক্ষিণ উপকূলে এসে থামে, তখন সেখানে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে এক নিঃশব্দ পাহাড়। সেই পাহাড়ের গায়ে লাল পাথরের প্রাচীরঘেরা যে ক্যাসেলটি যুগ যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছে, সেটিই আলানিয়া ক্যাসেল (Alanya Kalesi)। আর এই দুর্গে পৌঁছানোর যে সরু, আঁকাবাঁকা, উঁচু-নিচু পথ—স্থানীয় লোকজন যার নাম রেখেছেন ‘রাসেল’—সেই পথ নিজেই যেন এক স্বতন্ত্র চরিত্র।
এই রাস্তা একদিকে যেমন নিয়ে যায় ইতিহাসের কাছে, অন্যদিকে প্রকৃতির সৌন্দর্যে এমনভাবে ভরপুর যে প্রতিটি মোড়ে দাঁড়িয়ে আপনি একটু থমকে যেতে বাধ্য হন। নিচে সাগরের টলমলে নীল জলরাশি, পাশে শতবর্ষ পুরোনো সাইপ্রাসগাছের সারি আর ওপরে গড়িয়ে যাওয়া প্রাচীন দেয়াল—সব মিলিয়ে পথটাকে মনে হয় এক চলন্ত কবিতা।
এই রাস্তার এক পাশে রয়েছে তুর্কি ঘরানার ছোট্ট ছোট্ট ক্যাফে ও হস্তশিল্প বিক্রেতাদের দোকান, যারা আপনাকে ডেকে নিয়ে যেতে চায় এক কাপ চায়ের ছায়ায়। অন্য পাশে রয়েছে সেই পুরনো পাথরের দেয়াল, যেখানে রোমান, বাইজেন্টাইন, সেলজুক, ও ওসমানীয় ইতিহাসের ছাপ একত্রে জেগে থাকে।
রাসেল ধরে যখন আপনি ধীরে ধীরে ওপরে উঠবেন, আপনি কেবলই উঠবেন না—আপনি পেছনে ফেলে যাবেন সময়। পেছনে পড়ে থাকবে নিচের শহরের কোলাহল, সমুদ্রের চঞ্চলতা আর ওপরে আপনাকে অভ্যর্থনা জানাবে আলানিয়া ক্যাসেল, যা ১৩ শতাব্দীতে সেলজুক সুলতান আলাউদ্দিন কায়কোবাদের আমলে নির্মিত হয়। পুরো দুর্গটি প্রায় ৬.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীর দিয়ে ঘেরা এবং ভিতরে রয়েছে ১৪০টিরও বেশি প্রাচীন টাওয়ার, হ্যামাম, মসজিদ ও জাদুঘর।
তবে এই পথের সবচেয়ে মুগ্ধকর বিষয় হলো, এটি কেবল গন্তব্যে যাওয়ার রাস্তা নয়—এটি নিজেই একটি গন্তব্য।
রাসেল হলো সেই স্থান, যেখানে আপনি হাঁটতে হাঁটতে হারিয়ে যেতে পারেন নিজের ভেতরের সত্তায়।
যেখানে প্রতিটি ধাপে আপনি অনুভব করতে পারেন কেমন ছিল সেই জীবন, যখন যুদ্ধ মানেই ছিল দুর্গ রক্ষা, শান্তি মানেই ছিল প্রাচীরের ভেতরের নির্ভরতা।
দুর্গচূড়া থেকে দিগন্তের পানে—
যখন আপনি ক্যাসেলের সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছান, তখন নিচের আলানিয়া শহরটিকে মনে হয় কোনো এক রূপকথার বইয়ের চিত্র। দূরের ক্লিওপেট্রা বিচের সোনালি রেখা, জাহাজে ভরা হারবার আর সবুজ পাহাড়ে বোনা ঘরগুলো—সব মিলিয়ে মনে হয় সময় এখানে থেমে আছে।
পর্যটকদের জন্য একটি পরামর্শ—
রাসেল ধরে ক্যাসেলে উঠতে চাইলে হেঁটে যাওয়া সবচেয়ে আনন্দদায়ক অভিজ্ঞতা—বিশেষ করে বিকেলের দিকে, সূর্য যখন অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতিতে থাকে। তবে চাইলে ছোট বাস বা ক্যাবেও যাওয়া যায়। কিন্তু সত্যিকারের ইতিহাস ও প্রকৃতির সংস্পর্শ পেতে হলে হেঁটেই অনুভব করুন এই পথ।
আন্তালিয়া-আলানিয়া কোনো একক অভিজ্ঞতার নাম নয়। এটি সূর্যের আলোয় ঝলমলে ইতিহাস, নীল জলরাশির দোল, লোকজ গল্পের শহর। এটি সেই শহর, যেখানে আপনি শুধু ভ্রমণ করেন না—আপনি নিজেকে খুঁজে পান, কখনো নিজের আয়নায়, কখনো প্রিয় মানুষের চোখে।
এই যাত্রায় আমার পাশে ছিল মারিয়া—আমার সহধর্মিণী, আমার সহচরী, যে কেবল সঙ্গী নয়, বরং প্রতিটি দৃশ্যের গভীরে যার হাসি, যার নীরবতা, যার অনুভব মিশে আছে। শহরের প্রতিটি অলিগলিতে, প্রতিটি রোদের টানে, প্রতিটি সমুদ্রের ঢেউয়ে তার উপস্থিতি যেন আমার অনুভূতির প্রতিধ্বনি হয়ে বাজে।
হয়তো আজ রাতে, হয়তো অনেক বছর পর, হয়তো কোনো দিনই না—তবু আমি জানি, একদিন আমার আর মারিয়ার পায়ের চিহ্ন পড়বে সেই নির্জন বাঁকে, যেখানে সমুদ্র নিঃশব্দে গল্প বলে, আর রোদ ঝরে পড়ে কোনো পুরোনো দেয়ালে। আমরা একসঙ্গে দাঁড়াব সেই মুহূর্তে, যেখানে শহর আর স্মৃতি এক হয়ে যায়, সময় থমকে থাকে আর জীবন তার প্রকৃত অর্থ খুঁজে পায়।
আন্তালিয়া-আলানিয়া, তুমি আর কেবল এক টুকরা শহর নও—তুমি আমাদের দু’জনার মধ্যে ভাগ করে নেওয়া এক নীরব অনুভূতি, এক রৌদ্রস্নাত স্মৃতি, এক মুহূর্ত যা চিরকাল বেঁচে থাকবে—ভাষার ঊর্ধ্বে, সময়ের সীমার বাইরে।
*লেখক: রহমান মৃধা, সুইডেন