বিয়ের পাত্রী-২য় পর্ব
পরদিন সকালে খালা-বোন-ভাবি মিলে আমাকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তাদের ভাব দেখে মনে হচ্ছে তারা বিয়ের কনে সাজাচ্ছে। আমাকে ড্রেসিংটেবিলের সামনে বসিয়ে, আমার চুল ডান দিকে সিঁথি হবে না বাম দিকে সিঁথি হবে—এই নিয়ে খালা আর ভাবির মধ্যে একটা ছোট তর্ক হয়ে গেল। তর্কে কোনো সমাধান করতে না পেরে খালা এসে চিরুনি দিয়ে আমার মাথার এলোমেলো চুলগুলো আঁচড়িয়ে ডান দিকে সিঁথি করে দিলেন। খালার সিঁথি করা শেষ হতে না হতেই ভাবি চিরুনি দিয়ে চুলের সিঁথি বাম দিকে করে দিলেন। খেয়াল করলাম, খালা ভাবির দিকে রাগী চোখে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন। তারপর খালা আমার কাছে এসে আবার চুলগুলো বামে সিঁথি করে দিলেন। আমি হতবাক হয়ে তাদের কাণ্ডকারখানা দেখতে লাগলাম। খেয়াল করলাম, দুজনের কাণ্ড দেখে আমার বোন মুচকি মুচকি হাসছে। অবশেষে মাকে ডাকা হলো। মা সব শুনে আমার চুলগুলো হাত দিয়ে এলোমেলো করে দিলেন। তারপর কপালে একটা চুমু দিয়ে বললেন, আমার ছেলেকে এলোমেলো পাগলা পাগলা চুলেই বেশি স্মার্ট লাগে। তুই এভাবেই যা।
ড্রইংরুমে বাসার সবাই বসে আছেন। আমি সবাইকে সালাম দিয়ে দোয়া নিচ্ছি। এ সময় মামা এসে বললেন, রাজু আমি রেডি। চল আজ মামা-ভাগনে মিলে সব ফাটায়ে ফেলব।
বাবা অবাক হয়ে মামাকে বলল, তুমি কোথায় যাচ্ছ? আর কী ফাটায়ে ফেলবা?
—আমি রাজুর সঙ্গে যাচ্ছি। আর ফাটায়ে ফেলব মানে, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি এই মেয়ে যদি বিয়েতে রাজি না হয়, তাহলে মেয়েকে আজ উঠায় নিয়ে আসব। আমাকে তো চিনে না। আমার নাম...
—তোমার নাম আলু–পটল যাই হোক, তুমি রাজুর সঙ্গে যাচ্ছ না।
—দুলাভাই, আপনি সব সময় আমাকে অবমূল্যায়ন করে কথা বলেন। এটা কিন্তু ঠিক না।
—শোনো, অবটব তো পরের কথা, আমি তো তোমাকে মূল্যায়নই করি না। কারণ, গাধা নিয়ে চিন্তা করার সময় আমার নাই।
—আমি জানি, আপনি কেন আমাকে সহ্য করতে পারেন না। আসলে যুগে যুগে মেধাবী মানুষদের সবাই হিংসা করেছে। আপনিও তার থেকে ব্যতিক্রম নন।
—তুমি মেধাবী! শোনো তোমার মেধা তোমার কাছেই থাক। তুমি আমার ছেলের সঙ্গে যাবে না।
—দুলাভাই শোনেন, গতকালকের মিটিংয়ে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত হয়েছে যে আজ আমি রাজুর সঙ্গে যাব। আপনি এখন হঠাৎ করে আমাদের মিটিংয়ের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে বাধা দিতে পারেন না। এটা সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক। তাই এই বাধা আমি মানব না। আপনি বরং বাধা না দিয়ে আমাকে ভালো একটা পরামর্শ দিন।
—কী পরামর্শ?
—ভাবছি মেয়ে যদি বিয়েতে রাজি না হয়, তাহলে মেয়েকে ভয় দেখায়ে রাজি করাব। কিন্তু এরা এ যুগের পোলাপাইন, খালি হাতে ভয় পাবে বলে মনে হয় না। তাই ভাবছি সঙ্গে করে একটা অস্ত্র নিয়ে যাব। কিন্তু কি অস্ত্র নিব সেটা সিদ্ধান্ত নিতে পারছি না। বঁটি, ছুরি নাকি অন্য কিছু? আমার অবশ্য বঁটি পছন্দ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে বঁটি প্যান্টের ভেতর কোমরে লুকিয়ে নেওয়াটা রিস্ক। কারণ, এতে প্যান্টের ভিতর থাকা শরীরের বিভিন্ন মূল্যবান জিনিসপত্র কেটেটেটে রক্তারক্তি হবার সম্ভাবনা আছে। আবার প্যান্টের বাইরে কোমরে ঝুলিয়ে নেওয়াও যাবে না। কারণ, তাহলে পুলিশে সমস্যা করবে। তাই এখন বঁটিটা কীভাবে নেওয়া যায়, সেটা নিয়ে খুবই চিন্তার মধ্যে আছি। পারলে একটা পরামর্শ দিন।
পাত্রী ভুরু কুঁচকে মামাকে বলল, সমস্যা কি! আপনি এভাবে যাত্রার মতো কথা বলছেন কেন?
মামা একই সুরে টেনে টেনে বললেন, না না না, এটা কোনো সমস্যা না। এটা আমাদের পুরো পরিবারের কথা বলার স্টাইল।
এ সময় বাবা মাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি কি শিওর এ বলদ তোমার ভাই? আমি কিন্তু কনফিউজড। বিচারবুদ্ধির কথা না হয় বাদ দিলাম, সাধারণত ভাই-বোনের চেহারার একটা মিল থাকে। এর তো তাও নাই। দাঁড়াও, বিয়ের ঝামেলাটা শেষ হোক, আমি এর ডিএনএ টেস্ট করাব।
মা বাবার কথায় হাসি চেপে মামাকে বললেন, বঁটির চিন্তা বাদ দিয়ে যেখানে যাচ্ছিলি সেখানে যা। আর শোন, ওখানে গিয়ে পাগলামি করবি না। আর তুই কথা কম বলবি।
পাত্রীর সঙ্গে দেখা হবার নির্দিষ্ট সময় ছিল বেলা ১২টা ৩০। আমরা বারোটার মধ্যেই রেস্টুরেন্টে চলে এসেছি। পাত্রী এলো প্রায় তিন ঘণ্টা পর। যেহেতু পাত্রীর ছবি আমি আগেই দেখেছি, তাই চিনতে অসুবিধা হলো না। পাত্রী সঙ্গে করে তার এক বান্ধবীকে নিয়ে এসেছে। পাত্রীকে রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেখেই মামা উৎফুল্ল হয়ে বললেন, রাজু, মেয়ে তো দেখি পুরাই হট।
—মামা ছিঃ। এ মেয়ে আপনার ভাগনে বউ হতে যাচ্ছে। আর আপনি তার সম্পর্কে এসব বলছেন?
—আরে আমি আবার কি বললাম? মেয়ে সুন্দর, সেটাই তো বললাম।
—কিন্তু আপনার শব্দচয়ন নোংরা। সে আপনার ভাগনে বউ হবে। তাকে আপনি হট না বলে মমতাময়ী বা অন্যকিছু বলতে পারতেন।
—শোন, বারবার ভাগনে বউ ভাগনে বউ বলবি না। মেয়ে এখনো তোর বউ হয়নি। আর ভুলে যাস না আমি এখন সিঙ্গেল। আল্লাহ চাইলে মেয়ে তোর মামিও তো হতে পারে।
এই পাগলরে কিছু বলা আর না বলা একই কথা। তাই আর কিছু না বলে পাত্রী আমাদের টেবিলের সামনে আসার জন্য অপেক্ষা করতে লাগলাম। পাত্রী সামনে আসার পর পরিচয় পর্ব শেষে চেয়ারে বসতে বসতে বলল, সরি আসতে একটু দেরি হয়ে গেল।
পাত্রীর কথা শেষ হওয়ামাত্রই মামা যাত্রাপালার মতো টেনে টেনে সুর করে বলতে লাগলেন, না না না, তোমাকে সরি হতে হবে না। তুমি চাইলে আরও দেরি করে আসতে পারতে। আমাদের হাতে অফুরন্ত সময়। শোনো, আমরা দুজনেই হচ্ছি বেকার মানুষ। সারা দিন খাই আর ঘুমাই। রাজু তো বেলা বারোটায় ঘুম থেকে ওঠে। হা হা হা...
—বলেন কী? বারোটার সময় ঘুম থেকে উঠে!
—তা আর বলছি কি? তবে শোনো, আমি কিন্তু ওর মতো এতো বেলা করে ঘুম থেকে উঠি না। আমি এগারোটার দিকে ঘুম থেকে উঠে পড়ি। হা হা হা...
পাত্রী ভুরু কুঁচকে মামাকে বলল, সমস্যা কি! আপনি এভাবে যাত্রার মতো কথা বলছেন কেন?
মামা একই সুরে টেনে টেনে বললেন, না না না, এটা কোনো সমস্যা না। এটা আমাদের পুরো পরিবারের কথা বলার স্টাইল। রাজু এবং রাজুর বাবা-মা-বোন আমরা সবাই বাসায় এভাবেই কথা বলি।
—আপনি নিশ্চয় মজা করছেন, তাই না?
—না না না, আমি মজা করছি না। আমি কেন মজা করব? আমার মাথায় কি গন্ডগোল আছে?
আমি মনে মনে বললাম, এই জোকার আজ পাগলামি করতে করতে আমার বিয়ে এখানেই শেষ করে দেবে। আমি বিরক্তি গোপন করে মামার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললাম, প্লিজ মামা, আল্লাহর ওয়াস্তে আপনি আর উল্টাপাল্টা কথা বইলেন না। আপনার দুটো পায়ে ধরি।
মামা আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে বলল, না সমস্যা থাকবে কেন? তোমার যা ইচ্ছা তাই করবা। তুমি যদি মদ দিয়ে গোসলও কর, তাতেও আমাদের পরিবারের কোনো সমস্যা নাই।
মামা মাথা কাত করে আমার কথায় সম্মতি দিলেন। আমি এবার পাত্রীকে বললাম, রাস্তা-ঘাটের যে অবস্থা, তা আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?
—একটু সমস্যা তো হয়েছে। আসলে আমার বয়ফ্রেন্ড কীভাবে জানি খবর পেয়েছে, আজ আমি বিয়ের জন্য ছেলে দেখতে আসব। তাই সে বাসার সামনে দাঁড়িয়ে ছিল। যাতে আমি না আসতে পারি। সে আমাকে ফোন করে বলল, বিয়ের জন্য ছেলে দেখতে যেতে হলে তার লাশের ওপর দিয়ে যেতে হবে। ও ভেবেছিল এ ধরনের সিনেমার ডায়ালগ দিলে আমি আবেগে গলে যাব। কিন্তু ও তো আমাকে চেনে না। তাকে ফাঁকি দিয়ে আমি ঠিকই চলে এসেছি।
—বলেন কি! আপনার বয়ফ্রেন্ডও আছে?
—অবাক হলেন মনে হচ্ছে। কেন, বয়ফ্রেন্ড থাকা কি অন্যায়?
—না তা বলছি না। কিন্তু আপনি বয়ফ্রেন্ড থাকা অবস্থায় অন্য কাউকে বিয়ে করতে যাচ্ছেন কেন সেটাই ভাবছি।
-এটা কি বললেন! বয়ফ্রেন্ড থাকলে অন্য কাউকে বিয়ে করা যাবে না? আপনি তো মন-মানসিকতায় দেখছি সেকেলে।
পাত্রীর কথা শুনে মামা আমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বললেন, ওই ক্ষ্যাত, তোরে না বলছি তুই নিজ থেকে কোনো উত্তর দিবি না। কথা যা বলার আমি বলব। শুন অভিজ্ঞতার একটা মূল্য আছে। স্মার্ট হবার চেষ্টা কর।
এরপর মামা মেয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, এই যুগে দুচারটা বয়ফ্রেন্ড–গার্লফ্রেন্ড না থাকলে কী চলে? যুগের চাহিদাটা তো বুঝতে হবে, তাই না?
—ধন্যবাদ মামা। আপনি তো দেখি মন-মানসিকতায় অনেক আধুনিক।
এরপর পাত্রী আমার দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, আপনার কোনো গার্লফ্রেন্ড নেই?
আমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে মামা বললেন, আছে মানে! রানিং আছে তিনটা। এই তিনটার মধ্যে একজন আবার ওর দশ বছরের সিনিয়র। আর এক্স আছে সাতটা।
আমি হতবাক হয়ে মামার দিকে তাকিয়ে রইলাম। মনে মনে বললাম, জীবনে একটা প্রেম করতে পারলাম না, আর এই পাগলা আমারে এখন প্লেবয় বানিয়ে দিচ্ছে। দেখলাম আমার গার্লফ্রেন্ডদের কথা শুনে পাত্রী অবাক ও হতাশ হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললাম, এককাজ করি, আমরা বরং খাবারের অর্ডার দিই। খেতে খেতে না হয় কথা বলি?
আমি ওয়েটারকে ডাকলাম। ওয়েটার আসার পর আমরা খাবার অর্ডার দিলাম। ওয়েটার অর্ডার নিয়ে চলে যাওয়ার সময় পাত্রী ওয়েটারকে আবার ডেকে আনল। তারপর ওয়েটারকে নিচু স্বরে বলল, আপনাদের কাছে বিয়ার হবে?
—না, ম্যাম। আমরা অ্যালকোহল সেল করি না।
—ঠিক আছে সমস্যা নাই। আচ্ছা আপনাদের এই রেস্টুরেন্টে ধীমপান কর্নার আছে?
—না ম্যাডাম। আমরা ধূমপান ও অ্যালকোহলমুক্ত রেস্টুরেন্ট।
— ঠিক আছে আপনি খাবারগুলো নিয়ে আসেন।
ওয়েটার চলে যেতেই পাত্রী আমাকে বলল, আমি মাঝেমধ্যে একটু বিয়ার পান করি আর ধূমপান করি। এতে আপনার কোনো সমস্যা আছে?
মামা আমার উত্তরের অপেক্ষা না করে বলল, না সমস্যা থাকবে কেন? তোমার যা ইচ্ছা তাই করবা। তুমি যদি মদ দিয়ে গোসলও কর, তাতেও আমাদের পরিবারের কোনো সমস্যা নাই। শোনো, আমাদের বাসায় আমি আর আমার বোন মানে রাজুর মা ছাড়া বাকি সবাই বদ্ধ মাতাল। আমার দুলাভাই, মানে রাজুর বাবা তো মদ না খেলে ঘুমাতেই পারে না। জানো ওর বাবা-চাচা মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাসায় নাচানাচিও করে। সে এক ভয়ংকর দৃশ্য, তুমি না দেখলে বিশ্বাস করবে না। হা হা হা…
দেখলাম পাত্রীর চোখ বিস্ময়ে বড় হয়ে গেছে। পাত্রী ঢোক গিলে আমাকে দেখিয়ে মামাকে জিজ্ঞেস করল, উনিও কি মদ খায়?
—এটা কেমন কথা বললা? বংশের একটা ঐতিহ্য আছে না? বাবা-চাচা মদ খাইলে ছেলে বাদ যাবে কেন? তবে ওর একটা গুন আছে, ও মদ খেয়ে নাচানাচি করে না। ঝিম মাইরা বসে থাকে। আর একটু পর পর ঘর ভাসায়ে বমি করে। হা হা হা...
আমি মনে মনে এবার আমার চাচাকে গালাগালি করতে লাগলাম। কারণ, উনার জন্যই এই মাথামোটা বাচাল লোকটি আজ আমার সঙ্গে আসতে পেরেছে। কী অবলিলায় সব মিথ্যা কথা বলে যাচ্ছে। সে আর তার বোন ছাড়া আমার পুরো পরিবারকে সে মাতাল বানিয়ে ছেড়ে দিলো? মনে মনে বললাম, শালার মামা, তুই আজ বাসায় চল। তোর আজ খবর আছে। দেখি আমার বাপ চাচার হাত থেকে তোকে আজকে বাঁচায়? চলবে...
*লেখক: ইমদাদ বাবু, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। [email protected]