কোরবানির ঈদের স্মৃতি
শৈশবে পবিত্র ঈদুল আজহাকে আমরা বকরির ঈদ বলেছি। এখন সবাই কোরবানির ঈদ বা ঈদুল আজহা বলে। বয়সের বিভিন্ন সময়ে ঈদের আনন্দ বিভিন্ন রকম হয়ে থাকে। ঈদুল আজহায় আব্বা গ্রামের বাড়ি গরু কোরবানি দিতেন। গ্রামের বাড়িতে কোরবানি দেওয়ার জন্য বড়দা গ্রামে চলে যেতেন। একই সঙ্গে জাকাতের জন্য শাড়ি-লুঙ্গি নিয়ে যেতেন। গ্রামে যাওয়া-আসাটা বড়দার বাড়তি আনন্দভ্রমণ ছিল বলে মনে হয়। কারণ, ঈদ শেষে বরাবরই বড়দা গ্রামের বাড়ি থেকে বেশ দেরি করে লঞ্চে চড়ে কোরবানির মাংস নিয়ে বাসায় ফিরতেন। তখন (১৯৬৪-৬৫ সাল) আমাদের গ্রামের বাড়ি যাওয়ার জন্য লঞ্চই ছিল একমাত্র বাহন। বড়দা মাংসের সঙ্গে বাড়ির ফল, পিঠাসহ অনেক কিছুই নিয়ে আসতেন। আব্বা আমাদের বাসায় খাসি কোরবানি দিতেন। আব্বা গরুর মাংস কখনোই খেতেন না। তিনি কেন খেতেন না, এ প্রশ্নের উত্তর জানার চেষ্টা করিনি। আব্বা বা মাকেও কখনো জিজ্ঞাসা করিনি। আমরা নারায়ণগঞ্জের খানপুরের বাসায় থাকার সময় আব্বা প্রতিবার খাসি কোরবানি দিয়েছেন। স্বাধীনতার পর আব্বা ব্যবসা বন্ধ করে অবসরে যাওয়ার পর থেকে গ্রামে কোরবানি দেওয়ার রীতি বন্ধ হয়ে যায়। খানপুর থেকে জামতলায় যাওয়ার পর থেকে আমাদের বাসায় গরু কোরবানি দেওয়া শুরু হয়। একই সঙ্গে একটি খাসিও থাকত কোরবানির জন্য। কাকাকে দেওয়ার জন্য ফতুল্লা হাট থেকে আব্বা একটি খাসি কিনলেন। কাকা মিশনপাড়ায় থাকতেন। খাসি কেনার পর আব্বা ও আমি মোটরবাইকে (ফিফটি সিসি হোন্ডা) বসেছি, এবার খাসিটি আমাদের দুজনের মাঝে বসিয়ে দেওয়া হলো। আব্বা আমাকে বললেন, ‘ঠাইসসা ধরিস কিন্তু।’
রোজার ঈদে নতুন জামা পেয়েছি। কোরবানির ঈদে নতুন জামা পাওয়ার রেওয়াজ ছিল না। এ জন্য মনটা বিষণ্নতায় ছেয়ে যেত। এখনকার মতো তখন তো আর শিশুদের মন বোঝার কেউ ছিল কি? ঈদের আগের রাতে মা সারা রাত জেগে রান্না করতেন। ঈদের নামাজে যাওয়ার আগেই খিচুড়ি, পোলাও, মুরগির কোরমা, দুধের সেমাই, ঘি দিয়ে রান্না করা নারকেলের সেমাই খেয়ে আমরা নামাজে গিয়েছি।
খানপুর হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আগে ওই স্থানে কুমুদিনীর তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের কোয়ার্টার ছিল। ফতুল্লা হাট থেকে কোরবানির খাসি কেনার পর বিকেলে খাসি নিয়ে খানপুর মাঠে হাঁটতে গেলে খাসিটি আমার হাত থেকে ছুটে কুমুদিনীর কোয়ার্টারে খাসির মালিকের বাসায় চলে যায়। খাসির মালিকের বাসা থেকে বড়দা সেটি উদ্ধার করেন। আমাদের হাজিগঞ্জ বাড়ি থেকে বড়দা সাইকেলে চড়ে খাসির জন্য কাঁঠালপাতা নিয়ে আসতেন। শৈশবে কোরবানির খাসিকে পাতা খাওয়ানো এক আনন্দপূর্ণ কাজ বলে মনে হতো। মধ্যরাতে ছাগলের অম্ল, মধুর উচ্চাঙ্গসংগীতের শব্দে অন্ধকার টুকরা টুকরা হয়ে ঘুমের রাজ্যে আছড়ে পড়ত। বেশ কিছুদিন বাসার পরিবেশ ছাগলের গন্ধে দাপাদাপি করে বেড়াত। আব্বা পানিতে ফিনাইল মিশিয়ে ছিটিয়ে দিতেন। বিকেল হলে অনেকেই কোরবানির গরু, ছাগল নিয়ে মাঠে আসত। খানপুর এলাকায় এক ভদ্রলোক সাতটি গরু কোরবানি দিতেন। গরুর গলায় ও শিংয়ে জরির মালা, পিঠে লাল কাপড়ে আবৃত হয়ে তাঁর সাতটি কোরবানির গরু মহল্লা প্রদক্ষিণ করত। শিশু, কিশোরদের অনেকেই গরুর পিছু পিছু হাঁটত সে সময়।
কোরবানির পর ছিল আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের বাসায় মাংস বিতরণের পালা। খাসি জবাইয়ের পর দেখেছি বড়দা ও মেজদা দুজনেই খাসি কেটে মাংস তৈরিতে পারঙ্গম। জবাইয়ের জন্য আব্বার একটি স্পেশাল ঢেউ তোলা অ্যান্টিক বড় ছুরি ছিল। ঈদের আগে বড়দা বালুর সাহায্যে ছুরিটি শাণ দিতেন। শাণ দেওয়ার জন্য একটি নির্ধারিত লম্বা কাঠের বড় টুকরা ছিল। কৈশোরে আমিও ছুরিটি ধার দিয়েছি। দা, বঁটি, ছুরি এসব কামারের দোকান থেকে পানি দিয়ে এনে বড়দা শাণ দিতেন। জবাইয়ের পর ছাগলের চার পায়ের ক্ষুরের একটু ওপরে বৃত্তাকারে কেটে নিতেন। চার পায়ে ঠোঁট স্পর্শ করে ফুঁ দিতেন। এরপর ছাগলের সম্পূর্ণ শরীর বেলুনের মতো ফুলে উঠত। ছাগলের পেছনের দুই পা বারান্দার চৌকাঠে ঝুলিয়ে নিজের সব শক্তি প্রয়োগ করে চামড়া শরীর থেকে টেনে নামাতেন। বড়দা হেক্সো ব্লেড কেটে ছুরি বানাতেন। ওই ছুরি ব্যবহার করতেন। শৈশবে বিস্মিত নয়নে দেখি কাজের ফাঁকে বড়দা মেজদার কাছ থেকে সিগারেট চেয়ে নিয়ে কাজের বিরতি নিতেন। পিঠাপিঠি দুই ভাইয়ের ধূমপানের বিষয়টি শিশু বয়সে তখন আমার নজরকাড়ে। বড়দা বড় টুকরা করে দিলে মেজদা মাংসের ছোট ছোট টুকরা বানাতেন। আজ বড়দা না–ফেরার দেশে। মেজদার বয়স ৮২ প্লাস।
ঈদের নামাজের পর লম্বা ছুরি হাতে ওস্তাদজি ছুটতেন গরু জবাইয়ের জন্য। শৈশবে বড়দের সঙ্গে আমরাও ছিলাম সেই দলে। দূর থেকে দেখেছি গরু কুপোকাত করা ও গরু জবাইয়ের দৃশ্য। জবাইয়ের মুহূর্তে সমস্বরে আল্লাহু আকবর ধ্বনিতে এলাকা মুখর হয়ে উঠত। ফিনকি দিয়ে ছুটে আসা কোরবানির রক্তে ওস্তাদজিসহ কাছের সবাই রঞ্জিত হতেন। প্রবল উদ্দীপনা নিয়ে দলটি আবার ছুটে চলত পরবর্তী সময় রঞ্জিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায়। আব্বার ছুরিটি বেশি ধারাল হওয়ার কারণে ওস্তাদজি আব্বার ছুরিটি পছন্দ করতেন। কৈশোরে সেই ছুরিটি হাতে নিয়ে আমি ওস্তাদজির পাশে থেকে গরু জবাইয়ে অংশ নিয়েছি।
শৈশবে খানপুর মসজিদেই আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে ঈদের নামাজ আদায় করেছি। কৈশোরে স্বাধীনতার পর থেকে আব্বাকে সঙ্গে নিয়ে রিকশায় চড়ে জামতলা ঈদগাহে গিয়েছি ঈদের নামাজের জন্য। ১৯৭৯ সালে জামতলায় আসার পর ঈদগাহ বাসার খুব কাছে থাকার কারণে হেঁটেই ঈদগাহে গিয়েছি। আজও ঈদের নামাজে গেলে মনে হয় আব্বা আমার সঙ্গেই আছেন। দেখি রাত জেগে রান্না করা আমার মায়ের নির্ঘুম মুখ। সময়ের পরিবর্তনে প্রবাসে এখন ঈদের নামাজে আমার সঙ্গে থাকে আমার ছেলে। প্রতি ঈদে নামাজ শেষ হলে পিতা–পুত্র সেলফি তুলি।
মেজদার বন্ধুর স্টুডিও থেকে মেজদা সব সময় বাসায় ক্যামেরা এনে আমাদের ছবি তুলতেন। কোরবানির ঈদে মেজদার তোলা আমাদের শৈশবের ছবি।
*দূর পরবাসে ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]