মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি ‘গণহত্যা’র স্বীকৃতিতে প্রস্তাব উঠল মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদে

১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর গণহত্যা
ছবি: সংগৃহীত

১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে চালানো গণহত্যাকে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবিতে একটি প্রস্তাব আনা হয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে (হাউস অব রিপ্রেজেন্টিভস)। দেশটির দুই আইনপ্রণেতা এ প্রস্তাব আনেন। এ প্রস্তাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানানো হয়েছে।

আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচারের ক্ষেত্রে এতকাল উপেক্ষিতই ছিল একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বরতা। আজও তাই ৩০ লাখেরও বেশি হত্যা ও নৃশংস নির্যাতনের জন্য বিন্দুমাত্র দুঃখ প্রকাশ করেনি পাকিস্তান। বাঙালি জাতিকে শেষ করে দিতে চেয়ে রাজাকার ও আলবদরদের সঙ্গে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাসদস্যরা যে অত্যাচার চালিয়েছিল, সেই ঘটনার মতো নৃশংস ও অমানবিক বর্বরতার উদাহরণ মানব সভ্যতার ইতিহাসে বিরল।

পাকিস্তানের পক্ষে ছিল দেশীয় রাজাকার, আলবদর। আর বিশ্বে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র। আজ সেই যুক্তরাষ্ট্রের আইন সভায় প্রস্তাবের বিষয় হয়ে উঠেছে, ‘১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যার স্বীকৃতি’। ১৫ অক্টোবর কংগ্রেসম্যান রো খান্না এবং কংগ্রেসম্যান স্টিভ চ্যাবট এ প্রস্তাব পেশ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষে মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি গণহত্যাকে স্বীকৃতির প্রস্তাবকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ। তবে এখানেই থামলে চলবে না, গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে আমাদের কূটনৈতিক চালিয়ে যেতে হবে।

১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাদেশের মাটিতে যে নৃশংসতা ‘গণহত্যা, মানবতাবিরোধী ও যুদ্ধাপরাধ’ চালিয়েছে তার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দিতে হবে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে এমনই আহ্বান জানিয়ে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে। একই সঙ্গে দাবি উঠেছে, ’৭১ যেসব অপরাধী এখনো বেঁচে আছে তাদের শনাক্ত করে বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শাস্তি দিতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টে বিস্তারিত আলোচনা হয় অপারেশন সার্চলাইটের নামে পাকিস্তানি বর্বরতার। নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয় একাত্তরের গণহত্যার বিবরণ।

১৯৯৩ সালে সাবেক যুগোস্লাভিয়ায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হলেও একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বরতার কিন্তু আজও ন্যায়বিচার হয়নি। দুই মার্কিন আইনপ্রণেতা কংগ্রেসম্যান চ্যাবট এবং খান্না মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক জাতিগত বাঙালি ও হিন্দুদের বিরুদ্ধে সংঘটিত নৃশংসতাকে গণহত্যা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান জানানোয় নতুন করে আশার আলো দেখা যাচ্ছে।
প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পাকিস্তানকে গণহত্যায় জড়িত থাকার জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।

মুক্তিযুদ্ধের ৫০ বছর পার হয়ে গেলেও আজও বহু ঘাতকের বিচার হয়নি। লাখো মা-বোনের ইজ্জত লুণ্ঠিত হলেও গণহত্যার স্বীকৃতিটুকুও পায়নি শহীদদের পরিবার। মুখে বন্ধুত্বের কথা বললেও সেদিনের অপরাধের জন্য পাকিস্তান আজও নিজেদের ভুলটুকুও স্বীকার করেনি। এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের পার্লামেন্টে গণহত্যার স্বীকৃতি চেয়ে প্রস্তাব পেশ অবশ্যই বাংলাদেশের জন্য বড় কূটনৈতিক সাফল্য। কিন্তু পাকিস্তানি বর্বরতার আন্তর্জাতিক স্তরে বিচারের জন্য এ তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে।

১৯৭১ সালে ইয়াহিয়াকে নিয়ে অাঁকা শিল্পী কামরুল হাস​ানের পোস্টার

ওহিওর রিপাবলিকান দলের সদস্য স্টিভ চ্যাবট সামাজিক গণমাধ্যমে টুইট করেছেন, ‘১৯৭১ সালের বাংলাদেশে চালানো গণহত্যার ঘটনা ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। আমার ওহিও অঙ্গরাজ্যর সহকর্মীর সহযোগিতায় বাঙালি ও হিন্দুদের ওপর চালানো নৃশংসতা বিশেষ করে যার কিছু কিছু ক্ষেত্রে গণহত্যার ঘটনা ঘটেছে, তাকে স্বীকৃতি দেওয়ার আইনি প্রক্রিয়া শুরু করেছি।’ আর ডেমোক্র্যাট দলের কালিফোর্নিয়ার প্রতিনিধি রো খান্না টুইটে লিখেন, ‘১৯৭১ সালে বাঙালি গণহত্যার স্মরণে প্রথম প্রস্তাব তোলেন স্টিভ চ্যাবট। এ প্রস্তাবে আমাদের সময়ের সবচেয়ে বিস্মৃত গণহত্যার শিকার লাখও জাতিগত বাঙালি হত্যা হয়েছেন কিংবা বাস্তুচ্যুত হয়েছিলেন।’ তিনি আরও লিখেন, এখন যেটি বাংলাদেশ এর আগে ছিল পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৭১ সালে সেখানে গণহত্যা সংগঠিত হয়। লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারান।

বাংলাদেশ সরকার ২০১৭ সালের মার্চ মাসে ১৯৭১ সালের ঘটনাকে গণহত্যা হিসাবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি প্রদানের উদ্যোগ নেয়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের নিরন্তর প্রচেষ্টা এবং বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান মর্যাদা একটি ঐতিহাসিক ভুল সংশোধন এবং ১৯৭১ সালে সংঘটিত গণহত্যা ও ধর্ষণের অধ্যয়নের প্রচারে নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এখনই আত্মতৃপ্তির সুযোগ নেই। পাকিস্তানকে গণহত্যার জন্য আন্তর্জাতিক স্তরে অপরাধী প্রমাণ না করা পর্যন্ত সোচ্চার থাকতে হবে।

আরও পড়ুন

মনে রাখতে হবে, একাত্তরের ২৫ মার্চ এক রাতেই প্রাণ হারিয়েছিলেন ৫০ হাজার নিরীহ মানুষ। মাত্র ৯ মাসে পাকিস্তানি সেনারা হত্যা করে ৩০ লাখ বাঙালি। সংখ্যার হিসাবে হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী ৫ বছরে ৬০ লাখ ইহুদি খুন করলেও পাকিস্তান এক বছরেরও অনেক কম সময়ে ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে। তাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে গণহত্যার স্বীকৃতি আদায় বাংলাদেশের দায়িত্ব ও কর্তব্যও।

প্রিয়জিৎ দেবসরকার, লেখক ও গবেষক, লন্ডন