প্রবাসে ঈদ: ব্যস্ততার মধে৵ও আনন্দময় উদ্যাপন করতে করণীয়
‘দূর পরবাস’-এ জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]
আমরা রমজানের শেষের ঈদুল ফিতর উদ্যাপন করলাম। বিশ্বব্যাপী মুসলিম উম্মাহ ঈদুল ফিতর উদ্যাপন আনন্দ-উচ্ছ্বাসের সঙ্গে উদ্যাপন করে। তবে জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের জন্য এই উৎসবের দিনটি সব সময় অফিসিয়াল ছুটির দিন হিসেবে আসে না। ফলে কাজের ব্যস্ততার মধে৵ও ঈদের আনন্দ ধরে রাখা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। তবে কিছু সহজ পরিকল্পনা ও ব্যবস্থার মাধ্যমে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে প্রবাসে ঈদকে আরও আনন্দময় ও উপভোগ্য করে তুলতে আমরা কী কী করতে পারি তা স্বল্প পরিসরে জেনে নিই।
১. আগেভাগে পরিকল্পনা করুন
ঈদের দিন কাজ থাকলে আগেভাগেই কর্মস্থলে ছুটির অনুরোধ জানানো বা বিকল্প সময় বের করার চেষ্টা করা উচিত। যদি পুরো ছুটি নেওয়া সম্ভব না হয়, তবে অন্তত সকালটা ছুটি নিয়ে ঈদের নামাজ ও পারিবারিক সময় কাটানোর পরিকল্পনা করা যেতে পারে। জাপানিরা ঈদ সম্পর্কে খুব একটা অবগত নয়। তবে বুঝিয়ে বললে তাঁরা ধর্মীয় ব্যাপারে বেশ সহানুভূতিশীল। জাপানি ভাষায় ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করা একটু কষ্টসাধ্য। এ ক্ষেত্রে ভালো জাপানি ভাষা জানেন, এমন কারও সাহায্য নিতে পারেন। এতে করে আপনার ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান সম্পর্কে পজিটিভ ধারণা পাবে।
২. ঈদের নামাজের আয়োজন
প্রবাসে ঈদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হলো ঈদের নামাজ। স্থানীয় ইসলামিক সেন্টার বা মসজিদে ঈদের জামাতে অংশ নেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া উচিত। অনেক জায়গায় একাধিক জামাত হয়, তাই নিজের সময় অনুযায়ী সুবিধাজনক জামাত নির্বাচন করা যেতে পারে। জাপানের বিভিন্ন শহরে মসজিদকেন্দ্রিক মুসলিম কমিউনিটি রয়েছে। তাদের কাছ থেকে নামাজের সময়সূচি জেনে নিতে পারেন। তা ছাড়া সোশ্যাল মিডিয়ায় মুসলিম কমিউনিটির বিভিন্ন গ্রুপ রয়েছে। সেখান থেকেও নামাজের সময়সূচি জেনে নেওয়া যাবে।
৩. পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সংযোগ
প্রবাসে থাকলেও ঈদের দিনটিকে বিশেষভাবে উদ্যাপন করতে পরিবার ও বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটানো জরুরি। কাজের ফাঁকে হলেও ভিডিও কলের মাধ্যমে বাংলাদেশে থাকা প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা যায়। এতে ঈদের দেশীয় আমেজও উপলব্ধি করা যাবে। তা ছাড়া জাপানে বসবাসরত আপনার কাছের বাংলাদেশি প্রবাসী, অথবা অন্য দেশের মুসলিম প্রবাসীদের সঙ্গেও বিভিন্ন উদ্যোগ-আয়োজনের মাধ্যমেও ঈদের দিনটি আনন্দপূর্ণ করে তুলতে পারেন।
৪. ঈদের বিশেষ খাবার প্রস্তুত করুন
ঈদের অন্যতম আনন্দের দিক হলো সুস্বাদু খাবার। ব্যস্ততার কারণে পুরোপুরি আয়োজন করা সম্ভব না হলেও ঈদের সকালে বিশেষ খাবার যেমন সেমাই, পোলাও, বিরিয়ানি বা অন্য প্রিয় খাবার রান্নার চেষ্টা করা যেতে পারে। জাপানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সকাল ৭টা থেকে ৮টার মধ্যেই ঈদের জামাত শেষ হয়ে যায়। যাঁরা কর্মক্ষেত্র থেকে ছুটি নিতে পারেন না তাঁরা জামাত শেষ করেই কর্মক্ষেত্রের দিকে রওনা দেন। সে ক্ষেত্রে সকালে খাবার প্রস্তুত করার পরিবর্তে চাঁদরাতে খাবার প্রস্তুত করে রাখতে পারেন।
৫. সামাজিক আয়োজন ও মিলনমেলা
প্রবাসে ঈদের আনন্দ আরও বাড়িয়ে তুলতে বাংলাদেশি কমিউনিটির সঙ্গে একত্র হওয়া গুরুত্বপূর্ণ। স্থানীয় মুসলিম সংগঠনগুলো সাধারণত ঈদ উপলক্ষে মিলনমেলা বা বিশেষ আয়োজন করে, যেখানে অংশগ্রহণ করে উৎসবের আনন্দ ভাগাভাগি করা যায়। জাপানে অনেক কমিউনিটির নারীরা চাঁদরাতে ‘মেহেদি উৎসব’–এর আয়োজন করে থাকেন যা ঈদের আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দেয়।
৬. আত্মীয় ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগ করুন
প্রবাসে ঈদ উদ্যাপনে স্থানীয় মুসলিম ও অন্য বন্ধুদের সঙ্গে খুশির মুহূর্ত ভাগ করে নেওয়া ঈদের আনন্দ বহুগুণ বাড়িয়ে তুলতে পারে। প্রতিবেশী বা পরিচিতজনদের মধে৵ মিষ্টান্ন ও অন্যান্য খাবার বিতরণ করা যেতে পারে। কাছাকাছি বসবাসরত বন্ধুবান্ধবের বাসায় গিয়েও ঈদের কুশল বিনিময় করার প্রচলনও আছে। তবে সে ক্ষেত্রে যাওয়ার আগে ফোন করে জানিয়ে যাওয়া উত্তম।
৭. ঈদের পোশাক ও বিশেষ আয়োজন
ব্যস্ততার মধে৵ও ঈদের নতুন পোশাক পরিধান করা বা বিশেষ কিছু পরিধান করা ঈদের আবহ সৃষ্টি করতে সাহায্য করে। নিজের এবং পরিবারের জন্য নতুন পোশাক কেনা বা পরিচ্ছন্ন ও পরিপাটি পোশাক পরিধান করা উচিত। জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসী উদ্যোক্তাদের অনেক অনলাইন শপ আছে যেখান থেকে ছেলেদের পাঞ্জাবি-পাজামা এবং মেয়েদের শাড়ি-ব্লাউজ, থ্রি–পিসসহ বাচ্চাদের পোশাকও সহজেই কেনা যায়। বাংলাদেশের বাজারের তুলনায় দাম একটু বেশি হলেও যাচাই করে কিনতে পারলে, মানের দিক থেকেও ভালো কাপড় কিনতে পারবেন।
৮. দান-সদকা ও সহানুভূতি
ঈদ শুধু আনন্দের নয়, এটি দান ও সহানুভূতিরও সময়। প্রবাসে থাকলেও বিভিন্ন চ্যারিটি বা দাতব্য সংস্থার মাধ্যমে গরিব ও অসহায়দের সাহায্য করা যায়, যা ঈদের প্রকৃত আনন্দ ও আত্মতৃপ্তি এনে দেয়। জাপানে ব্যক্তি পর্যায়ে দান করা একটু কষ্টসাধ্য। সে ক্ষেত্রে জাপানে প্রতিষ্ঠিত মসজিদ বা মাদ্রাসায় আপনার সাধ্যমতো দান করতে পারেন। জাপানে মসজিদ পরিচালন ব্যয় অনেক বেশি। মসজিদের পরিচালন ব্যয় মিটানোর জন্য ঈদের জামাত শেষে প্রায় প্রত্যেক মসজিদেই দান সংগ্রহ করা হয়। জামাতশেষে মসজিদে দান করাটা হতে পারে উত্তম সিদ্ধান্ত।
৯. কর্মক্ষেত্রে ঈদের আবহ তৈরি করা
যেহেতু অনেকেরই ঈদের দিন অফিস বা কাজ থাকে, তাই কর্মক্ষেত্রে ঈদের আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য সহকর্মীদের সঙ্গে ঈদের গল্প ভাগ করা, মিষ্টি বা চকলেট বিতরণ করা যেতে পারে। এতে অন্য ধর্মের মানুষের কাছেও ঈদের সৌন্দর্য তুলে ধরা সম্ভব। জাপানিরা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের গল্প বেশ আগ্রহ ও ধৈর্য নিয়ে শোনে। তবে মনে রাখতে হবে, আপনি যে গল্প করবেন, জাপানি ভাষায় তার একটা রিহার্সেল করে নেবেন, যাতে আপনার গল্পের উপস্থাপনা সুন্দর হয়। ভাষার ভুল ব্যবহারের কারণে ভুল তথ্য যেন না যায়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
১০. ঈদ উদ্যাপনের জন্য বিকল্প দিন নির্ধারণ
যদি ঈদের দিন পুরোপুরি কাজের ব্যস্ততায় কেটে যায়, তাহলে কোনো কাছের বন্ধুবান্ধব বা পরিবারের সঙ্গে পরবর্তী ছুটির দিনে ঈদের বিশেষ আয়োজন করা যেতে পারে। এতে কাজের চাপে ঈদের আনন্দ ম্লান হয়ে যাবে না। জাপানে বসবাসরত বাংলাদেশি প্রবাসীরা তাদের নিজস্ব কমিউনিটিতে ঈদের পরবর্তী শনিবার বা রোববারের ছুটির দিনে সম্মিলিত ‘ঈদ পুনর্মিলনী’ আয়োজন করে থাকে।
প্রবাসে থাকলেও ঈদের আনন্দ কমে যায় না; বরং সঠিক পরিকল্পনা ও উদ্যোগের মাধ্যমে এ দিনটি আরও অর্থবহ করে তোলা সম্ভব। কাজের ব্যস্ততার মধে৵ও ঈদের দিনটিকে বিশেষভাবে উদ্যাপন করতে হলে প্রয়োজন আগেভাগে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতি, পারস্পরিক সংযোগ এবং আনন্দ ভাগাভাগির মনোভাব। জাপানে বসবাসরত নিজস্ব কমিউনিটির মধ্যে আন্তযোগাযোগ গড়ে তোলে নানান অনুষ্ঠান আয়োজনের মধ্য দিয়ে প্রবাসের জীবনেও ঈদের আনন্দ সম্পূর্ণভাবে উপভোগ করা সম্ভব হবে।
*লেখক: তৌফিক আহমেদ, কানাজাওয়া, জাপান।