আনন্দ তো আনন্দই

পাবনা ব্যাপ্টিস্ট চার্চে প্রাক্‌-বড়দিন উৎসব। পাবনা ব্যাপ্টিস্ট চার্চ, পাবনা, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ছবি: হাসান মাহমুদ

হোক না পূজা, বড়দিন, বিয়ে, রোজা বা ঈদের উৎসব; আনন্দ তো আনন্দই। মানুষের জীবনে উৎসব আসে আলো হয়ে। অন্ধকারের ভেতর একটি জানালায় যেমন একটি বাতি জ্বলে উঠলে পুরো ঘর আলোকিত হয়, তেমনি উৎসব মানুষের ভেতরের মানুষটিকে জাগিয়ে তোলে। ধর্ম ভিন্ন হতে পারে, আচার আলাদা হতে পারে; কিন্তু আনন্দের ভাষা একটাই। সেই ভাষা হৃদয়ের।

বড়দিন আসছে। খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের কাছে এটি শুধু একটি ক্যালেন্ডারের দিন নয়; এটি প্রেম, ক্ষমা, ত্যাগ এবং মানবতার পুনর্জন্মের বার্তা। যিশুর জন্মদিন স্মরণ করার মধ্য দিয়ে মানুষ মনে করিয়ে দেয় যে ভালোবাসা কখনো শক্তির প্রদর্শন নয়, ভালোবাসা নীরব, ধৈর্যশীল ও গভীর। বড়দিনের আলো তাই কেবল গির্জার ভেতর সীমাবদ্ধ থাকে না, তা ছড়িয়ে পড়ে মানুষের ঘরে, মানুষের চোখে, মানুষের আচরণে।

দূর পরবাসে জীবনের গল্প, নানা আয়োজনের খবর, ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠাতে পারবেন পাঠকেরা। ই-মেইল: [email protected]

এই উৎসব আমাদের শেখায়, ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়। পথ ভিন্ন হতে পারে; কিন্তু গন্তব্য মানবিকতা। কেউ প্রার্থনা করে গির্জায়, কেউ মসজিদে, কেউ মন্দিরে, কেউ আবার নীরবে নিজের অন্তরে। তবু প্রার্থনার মূলসুর একটাই—শান্তি, ন্যায় ও সহমর্মিতা। বড়দিন সেই সুরকে আরও স্পষ্ট করে তোলে।

যখন জানালার পাশে বাতি জ্বলে, যখন রঙিন আলো বারান্দা সাজায়, তখন সেই আলো শুধু খ্রিষ্টধর্মাবলম্বীদের জন্য নয়। সেই আলো আমাদের সবার জন্য। এটি মনে করিয়ে দেয়, আমরা আগে মানুষ, তারপর সব পরিচয়। যে সমাজে টলারেন্স নেই, সেখানে কোনো উৎসবই সম্পূর্ণ হয় না। যে সমাজে রেসপেক্ট নেই, সেখানে আলো থাকলেও উষ্ণতা থাকে না। বড়দিন আমাদের সেই উষ্ণতার কথাই বলে।

এই শীতের দেশে বড়দিনের অপেক্ষা শুরু হয় অনেক আগেই। বিকেলের মধ্যেই অন্ধকার নেমে আসে, আর সেই অন্ধকারের ভেতর মানুষ আলো জ্বালাতে শেখে। জানালার ধারে ধারে বাতি, ঘরের ভেতর নীরব প্রস্তুতি, অপেক্ষার একধরনের কোমল আনন্দ। কোথাও লুসিয়ার আলো, কোথাও অ্যাডভেন্টের মোমবাতি, কোথাও আবার নিঃশব্দে বসে থাকা মানুষের চোখে উষ্ণতার প্রতিফলন। এই আলো কেবল ধর্মীয় অনুষঙ্গ নয়, এটি শীতের বিরুদ্ধে মানুষের মানবিক জবাব। যেন বলা হচ্ছে, বাইরে যতই অন্ধকার হোক, ভেতরের আলো নিভে যাবে না।

এই দিনে আমরা যদি একটু থামি, যদি নিজের বিশ্বাসের পাশাপাশি অন্যের বিশ্বাসকেও সম্মান করতে শিখি, যদি ভেদাভেদ নয় বরং সংযোগ খুঁজি, তাহলেই বড়দিনের সত্যিকারের অর্থ পূর্ণতা পায়। ভালোবাসা মানে কেবল আবেগ নয়, ভালোবাসা মানে দায়িত্ব। অন্যের কষ্টকে নিজের মতো করে অনুভব করার সাহস।

এই বড়দিনে আসুন আমরা মানুষের মধ্যে দেয়াল না তুলে সেতু তৈরি করি। ধর্ম নয়, মানুষকে কেন্দ্র করে ভাবি। উৎসবকে প্রতিযোগিতা নয়, সহযাত্রা হিসেবে দেখি। কারণ, শেষ পর্যন্ত আলো যদি সবার ঘরে না পৌঁছায়, তবে সেই আলো অপূর্ণ থেকে যায়।

হোক না বড়দিন,  ঈদ, পূজা বা রোজা, আনন্দ তো আনন্দই। আর সেই আনন্দ তখনই পূর্ণতা পায়, যখন তা ভাগ করে নেওয়া যায় মানুষের সঙ্গে, মানুষের জন্য।

এই বড়দিনে দাঁড়িয়ে হঠাৎ আমার নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে। মনে পড়ে ঈদের আগের রাতগুলো। ঘুম আসত না চোখে। নতুন জামা, মায়ের ব্যস্ততা, ঘরের ভেতর একধরনের অদ্ভুত উত্তেজনা। ভোরের আজানের সঙ্গে সঙ্গে শুরু হতো ঈদের দিন। ঘরে ঘরে হাসি, দরজায় দরজায় কোলাকুলি, অপরিচিত মানুষও যেন আপন হয়ে যেত। সেই আনন্দের কোনো ধর্ম ছিল না, ছিল মানুষের মিলন।

আজ সুইডেনের শীতের মধ্যে দাঁড়িয়ে বড়দিনের আলো দেখলে সেই ঈদের স্মৃতিই যেন ফিরে আসে। জানালার পাশে জ্বলা বাতি, ঘরে ঘরে সাজানো আলো, মানুষের চোখে সেই একই অপেক্ষা, সেই একই উষ্ণতা। ভাষা আলাদা, খাবার আলাদা, নাম আলাদা; কিন্তু আনন্দের অনুভূতিটা ঠিক একই। স্মৃতির জানালা খুলে দেখি, আনন্দ তখনো ছিল, আনন্দ এখনো আছে, শুধু সময় আর জায়গা বদলেছে।

এখানেই বুঝি, উৎসব আসলে ধর্মের দেয়ালে আটকে থাকে না। উৎসব মানুষের ভেতরের শিশুটাকে জাগিয়ে তোলে। যে শিশু আনন্দে বিশ্বাস করে, ভাগ করে নিতে জানে, অন্যের ঘরে আলো জ্বললে নিজের ঘরও আলোকিত মনে করে। ছোটবেলার ঈদের আনন্দ আর আজকের বড়দিনের আলো এক জায়গায় এসে মিলিয়ে যায় এই উপলব্ধিতে যে মানুষ হওয়াটাই সবচেয়ে বড় পরিচয়।

তাই বড়দিন হোক বা ঈদ, পূজা বা অন্য কোনো উৎসব, আসল কথা একটাই—আমরা যেন একে অপরের আনন্দকে চিনতে পারি, সম্মান করতে পারি। ভিন্নতাকে ভয় না পেয়ে তাকে সৌন্দর্য হিসেবে দেখতে শিখি। কারণ, পৃথিবী তখনই নিরাপদ হয়, তখনই সুন্দর হয়, যখন মানুষ মানুষকে আপন মনে করে।

হোক না বড়দিন, ঈদ, পূজা বা রোজা। আনন্দ তো আনন্দই। আর সেই আনন্দই আমাদের শেখায়, আলো শুধু উৎসবের জন্য নয়, আলো মানুষের জন্য।