বানভাসি মানুষদের আর্তনাদ শুনতে কি পাও

‘ঈশ্বর থাকেন ঐ গ্রামে, ভদ্র পল্লীতে—এখানে তাহাকে খুঁজিয়া পাওয়া যাইবে না।’ অবহেলিত পদ্মাপারের মানুষের দুঃখ–দুর্দশা বোঝাতে এর চেয়ে শক্তিশালী লাইন বাংলা সাহিত্যে আরেকটি খুঁজে পাওয়া মুশকিল। আর এভাবেই মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বানভাসি মানুষের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছিলেন তাঁর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে। কিন্তু মানিক বাবুরা তো আর প্রতি গ্রামে জন্মায় না। তাই এ রকম অসংখ্য খরস্রোতা নদীর তাণ্ডবে দিশাহারা হাজারো মানুষের খবর ভদ্র পল্লিতে পৌঁছায়ও না।

বান আসে, বান যায়। ভাসিয়ে নিয়ে যায় হাজারো মানুষের স্বল্পমেয়াদি স্বপ্ন। সিডর, আইলা, আম্পান কিংবা ইয়াস—যে নামেই আসুক না কেন, সব কটির রুদ্রমূর্তি একই। সব কটি উপকূলবাসীর জীবন লন্ডভন্ড করে দেয়, জীবিকা কেড়ে নেয়, বেঁচে থাকার সীমিত সম্বলটুকু উড়িয়ে নেয় এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে বাস্তুচ্যুত করে দেয়। এগুলো বারবার আসে, প্রতিবছর আসে। পৌনঃপুনিকভাবে আসে।

বলছিলাম বাংলাদেশের সর্বদক্ষিণে পটুয়াখালীর উপকূলীয় উপজেলা কলাপাড়ার মানুষের দুঃখ–দুর্দশার কথা। কলাপাড়ার পূর্ব-দক্ষিণের ইউনিয়ন লালুয়া। এখানেই কেটেছে আমার শৈশব–কৈশোর। নবনির্মিতব্য পায়রা বন্দরের অধিকাংশই গড়ে উঠছে এ ইউনিয়নকেই ঘিরে। সুতরাং সবাই ভেবে নিতে পারেন যে ওই অঞ্চলের চিরায়ত দুঃখ–দুর্দশার দিন বুঝি শেষ। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন। এখন পর্যন্ত পুরো ইউনিয়নের কোথাও বিদ্যুতের আলো পৌঁছায়নি, নেই কোনো পাকা রাস্তা। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো বলতে হয়, উন্নয়ন নামের ‘ঈশ্বর’কে কখনোই এই গ্রামে দেখা যায়নি।

ডিম্বাকৃতির ইউনিয়নটির অবস্থান একেবারে বঙ্গোপসাগরের মোহনায়। মোহনার করাল গ্রাস থেকে রক্ষার একমাত্র রক্ষাকবচ হচ্ছে ইউনিয়নটি ঘিরে থাকা একটা বেড়িবাঁধ (ওয়াপদা)। বহু পুরোনো এই বেড়িবাঁধের বয়স আমার জানা নেই। ধারণা করি, আমার বাপ-দাদাদের আমলে নির্মিত। পায়রা বন্দরের জন্য নির্ধারিত রাবনাবাদ চ্যানেলের (সরাসরি মোহনা থেকে উৎপত্তি) অধিকাংশই লালুয়া ইউনিয়নের পূর্ব পাশটাজুড়ে। চ্যানেলটি বেশ খরস্রোতা, বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে তো অগ্নিরূপ ধারণ করে। প্রায় ৩০ বছর আগে ‘নাওয়াপাড়া’ নামের গ্রামের অংশে থাকা বেড়িবাঁধ ধসে যায়। ছোটবেলায় এ গ্রামের মানুষের করুণ দুর্দশার কাহিনি শুনতাম মুরব্বিদের কাছ থেকে। তারপর একটু বড় হয়ে ভয়ে ভয়ে ওই সব গ্রামে যেতাম স্বচক্ষে তা অবলোকন করতে। শত শত মানুষ তাঁদের পৈতৃক ভিটেমাটি হারিয়েছিলেন। প্রতিদিন মাইলের পর মাইল জমি রাবনাবাদের গর্ভে বিলীন হয়ে যেত। আবাদি জমি থেকে বসতভিটা—সবকিছুই ধীরে ধীরে শেষ হতে লাগল। কিছু কিছু মানুষ নিরুপায় হয়ে ভিক্ষা করতে পর্যন্ত বাধ্য হতো। প্রকৃতপক্ষে তা এখনো চলমান। ধীরে ধীরে রাবনাবাদের সাম্রাজ্য বিস্তার বাড়তে থাকে। আস্তে আস্তে তা ছড়িয়ে পরে লালুয়া ইউনিয়নের পূর্বাঞ্চলজুড়ে। আমাদের চান্দুপাড়া গ্রামটি সর্বদক্ষিণে। প্রায় ১৫ বছর আগে শুরু হয় আমাদের গ্রামের বেড়িবাঁধের ভাঙন। ছোটবেলায় যা গল্পে শুনতাম, তাই স্বচক্ষে দেখতে শুরু করলাম। দেখতে দেখতে কয়েক বছরের মধ্যেই আমাদের রক্ষাকবচটি একেবারেই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কয়েক বছর এই ভাঙনপ্রক্রিয়া চলমান থাকলেও বেড়িবাঁধ রক্ষার কোনো রকম সরকারি উদ্যোগ দেখা গেল না। যখন পুরোপরি ভেঙে গেল, তার কয়েক বছর পর একটা বিকল্প বেড়িবাঁধ নির্মাণ করা হলো। যদিও ইতিমধ্যে অনেকে বাস্তুচ্যুত হয়ে গেছে। বিকল্প বেড়িবাঁধটা হওয়া উচিত ছিল আগের বেড়িবাঁধ থেকে মজবুত। কিন্তু মান কিংবা আকারে বিকল্প বাঁধ পুরোনোটার ধারেকাছেও ছিল না। জানি না, সর্বদক্ষিণের এই অসহায় জনগোষ্ঠীর জন্য সরকারি বাজেটের ঘাটতি ছিল, নাকি এত দূরত্ব অতিক্রম করতে করতে বাজেট কাকপক্ষীতে খেয়ে নিয়েছে। ফলস্বরূপ এই দুর্বল বাঁধ শুধু মানুষের আশাই জাগিয়েছে কিন্তু তাদের রক্ষা করতে পারেনি। তারপর কত নামে কত ঝড় এল-গেল, কত মানুষকে ভিটেমাটিহারা করেছে কিন্তু যথাযথ কর্তৃপক্ষের টনক এতটুকুও নড়াতে পারেনি।

কয়েক বছর ধরে আরেক মায়াজাল শুরু হয়েছে পায়রা বন্দরের নামে। যেহেতু এ অঞ্চল পুরোটাই পায়রা বন্দরের জন্য নির্ধারিত, তাই লালুয়া ইউনিয়নের বর্তমান দেখভালের দায়িত্ব বোধ হয় বন্দর কর্তৃপক্ষের কাছে। তাই স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা যখনই প্রশাসনের কাছে এসব কথা তুলে ধরছেন, তখনই তারা বন্দর কর্তৃপক্ষের কথা বলে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। অন্তত স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের বক্তব্য তেমনই।

একটা সময় হয়তো সব জমি অধিগ্রহণ করে সবাইকে সরকারি আশ্রয়ণে নিয়া যাওয়া হবে কিন্তু তত দিন তো এসব মানুষকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে? তাঁদের দৈনন্দিন জীবিকার সুরক্ষা দিতে হবে। আর সেটা সরকারকেই দিতে হবে, হোক সেটা স্থানীয় প্রশাসন কিংবা বন্দর কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে। এর একটা স্থায়ী সমাধান সরকারের কাছে বানভাসি মানুষের ন্যায্য অধিকার। প্রতিবছর একটা করে প্রলয় আসবে আর প্রলয় শেষে কিছু ত্রাণ দেওয়া কোনো সমাধান হতে পারে না।

সুদূর প্রবাস থেকে যখন এই লেখা লিখছি, তখন সিডর, আইলা, আম্পান কিংবা ইয়াস—কিছুই নেই। তবু আমার মা–বাবা, নিকট আত্মীয়, গ্রামবাসীর সীমাহীন দুর্দশার কথা ভেবে দিন কাটে। বর্তমানে গ্রামটির অবস্থা এতটাই খারাপ অবস্থায় পৌঁছেছে যে প্লাবিত হতে আর বড় কোনো দুর্যোগ আসার অপেক্ষা করতে হয় না। প্রতি অমাবস্যা-পূর্ণিমার জোয়ারের পানিতেই তলিয়ে যায় পুরো গ্রামটি। তলিয়ে যায় সব ধরনের ফসল, মাছের ঘের; ভাসিয়ে নিয়ে যায় গবাদিপশু। সুদূরে বসেও ফেসবুক খুললেই দেখি অসহায় মানুষের বাড়িঘর ভেসে যাওয়ার দৃশ্য, সঙ্গে সঙ্গে উপলব্ধি করতে পারি তাদের দুবেলা খাবার জোগান দেওয়া খেতের ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ার আর্তনাদ। শুধু যে মালের ক্ষতি হচ্ছে তা নয়, ইতিমধ্যে শুনেছি, কয়েকটা বাচ্চা প্রাণ হারিয়েছে এসব বানের পানিতে। নব্বই ভাগ কৃষিনির্ভর গ্রামটির মানুষের অনাগত দিনগুলোয় জীবনধারণের উপায় কী করে হবে, তা কেউই জানে না।

উন্নয়নের রোল মডেলে বাংলাদেশে উপকূলীয় মানুষদের সুরক্ষা দেওয়াটা অসম্ভব, এটা আমি বিশ্বাস করি না। শুধু দরকার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের যথাযথ মনোযোগ, সদিচ্ছা আর যথাযথ পরিকল্পনা। আমি আবার বলছি, ত্রাণ কোনো সমাধান নয়। এতে মানুষের শুধু শুধু কর্মক্ষমতা নষ্ট হয় আর এর সঙ্গে জড়িত সবার পেট ভর্তি হয়। অরক্ষিত অঞ্চলগুলো চিহ্নিত করে বৈজ্ঞানিক ভিত্তিতে বাঁধ নির্মাণ করে আমাদের মতো হাজারো উপকূলবাসীর নিজ বসতভিটায় থাকার নিশ্চয়তা সরকারের কাছে চাই। বাস্তুহারা মানুষের আহাজারি শোনার জন্য একটু কান পাতুন, আশা করি, সমস্যা সমাধানের উপায় আপনারা পেয়ে যাবেনই।

*লেখক: তসলিম মাহমুদ পলাশ, টেক্সাস, আমেরিকা।