অস্ট্রেলিয়ার পার্থে মঞ্চায়িত হলো ‘মাস্টার বাড়ি’

নাটকের একটি দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

পশ্চিম অস্ট্রেলিয়ার রাজধানী পার্থের নন্দিত নাট্যমঞ্চ মারডক ইউনিভার্সিটির নেক্সাস থিয়েটারে মঞ্চায়িত হলো বিশ্বজিৎ বসু রচিত নাটক ‘মাস্টার বাড়ি’। গত ২০ মে সন্ধ্যায় স্থানীয় শিল্পীদের নিয়ে গড়ে ওঠা নাট্যদল বেঙ্গল আর্টসের তৃতীয় প্রযোজনা মাস্টার বাড়ি। ৪৫ জন নিবেদিতপ্রাণ নাট্যকর্মীর সাড়ে তিন মাসের নিরলস পরিশ্রমের ফসল এ নাটক।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া (বাওয়া) আয়োজিত বার্ষিক নাট্যোৎসবে এটি ছিল একটি মৌলিক নাটক পরিবেশনা। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে রচিত এ নাটকের মুখ্য চরিত্র গ্রামের স্কুলের শিক্ষক জগদীশ বাবু। গত শতাব্দীর ত্রিশের দশকে ফরিদপুরের রাজেন্দ্র কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে গ্রামে ফিরে আসে। নিজ বাড়ির পাশে পতিত জমিতে ঘর তুলে এলাকার শিশু–কিশোরদের শিক্ষাদান করতে থাকে। ধীরে ধীরে সে পরিচিত হয় মাস্টার মশাই আর স্কুলটি হয়ে ওঠে মাস্টার বাড়ি স্কুল।

১৯৭০-৭১–এর তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলার) উত্তাল সময়ে সেই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মাস্টার মশাইয়ের প্রিয় ছাত্র জয়নাল আবেদীন। পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অপারেশন সার্চলাইট শুরু হওয়ার পর ঢাকা থেকে পালিয়ে আসে স্কুলের দুই প্রাক্তন ছাত্র। সঙ্গে নিয়ে আসে মানচিত্র খচিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। প্রধান শিক্ষক মাস্টার বাড়ি স্কুলে সে পতাকা উত্তোলন করে স্কুল বন্ধ ঘোষণা করে। ঢাকা থেকে হানাদার বাহিনী ছড়িয়ে পড়ে জেলা সদরে। শহরে বসবাসরত মাস্টার মশাইয়ের মেয়ের জামাইয়ের বাড়িতে লুটপাট করে জামাইকে ধরে নিয়ে যায় মিলিটারি। অসহায় কন্যা বিমলা নিজের মেয়ে ও দেবরকে সঙ্গে নিয়ে পালিয়ে চলে আসে গ্রামে বাবার বাড়িতে। এদিকে গ্রাম থেকে বিতাড়িত এক চোর সৈজদ্দি রাজাকার বাহিনীতে যোগ দিয়ে ফিরে আসে গ্রামে এবং লুটতরাজ করতে থাকে বাড়ি বাড়ি।

একদিন সে মিলিটারি ও দলবল নিয়ে উপস্থিত হয় মাস্টার বাড়িতে এবং লুটপাট শুরু করে। বাড়িতে রক্ষিত স্কুলের ব্রিফকেসটি লুট করতে বাধা দেয় মাস্টার মশাই। রাজাকারের নির্দেশে লুটকারীরা ব্রিফকেস খুলে স্কুলের কাগজপত্রের সঙ্গে পায় বাংলাদেশের পতাকা। মিলিটারিরা লুটের পর আগুনে পুড়িয়ে দেয় মাস্টার মশাইয়ের বাড়ি। পতাকা রাখার অপরাধে খুন করে মাস্টার মশাইকে। সঙ্গে তার নাতনিকে।

নাটকের একটি দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

মাস্টার মশাইয়ের পিতৃহারা ছেলে বিজন অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী, স্বামী-সন্তানহারা বোনকে নিয়ে পালিয়ে যায় ভারতে। মাস্টার মশাইয়ের ছাত্ররা দেশ স্বাধীন করে মাস্টার মশাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিজ্ঞা করে অস্ত্র হাতে তুলে নেয়। সবাই প্রতিজ্ঞা করে—‘যে পতাকা বুকে নিয়ে মাস্টার মশাই শহীদ হলো, সে পতাকা মাস্টার মশাইয়ের সমাধিতে ওড়াবই।’ স্কুলের প্রধান শিক্ষককে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে প্রতিরোধ।

এ নাটকে একটি দারুণ সংযোজন ‘জাগো জাগো’ গানটি। নাটকের দৃশ্যে দেখা যায় রাজাকারেরা আশপাশের গ্রাম থেকে নারীদের ধরে এনে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে তুলে দেয়। স্কুলশিক্ষক সেলিনাও বাদ যায় না তাদের হাত থেকে। তবে নিজের বুদ্ধিমত্তা দিয়ে সে পাকিস্তানি বাহিনীর অস্ত্র ছিনিয়ে আনতে সমর্থ হয়। নির্যাতিত সেলিনার মানসিক শক্তি সঞ্চয়ের মাধ্যমে জেগে ওঠার চিত্র তুলে ধরার জন্য নাট্যকার বিশ্বজিৎ বসু এ গান রচনা করেছেন। নাট্যকারের সুর ভাবনায় গানটির সুর করেছেন এবং কণ্ঠ দিয়েছেন তাসনিমুল গালিব অমিত। হৃদয়গ্রাহী এ গানের সঙ্গে অপূর্ব কথক নৃত্যনাটকে ভিন্ন মাত্রা যোগ করেছে। বাংলার সাধারণ মানুষের অত্যাচার–নির্যাতনের বিরুদ্ধে জেগে ওঠার শক্তি অর্জনের প্রতীক হয়ে থাকবে ‘জাগো জাগো’ গানটি।

এ ছাড়া মুক্তিযুদ্ধকালে বিভিন্ন শিল্পীগোষ্ঠীর পরিবেশিত গান কীভাবে সব হারানো মানুষকে উজ্জীবিত করত, সেটা দেখানো হয়েছে এ নাটকে। একটি দৃশ্যে দেখা যায়, শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নেওয়া স্বামী–সন্তান-পিতৃহারা নারী বিমলা সংগীত দলের গান শুনে কীভাবে প্রাণ ফিরে পায়। নতুন করে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি পায়। বিজনসহ মাস্টার মশাইয়ের ছাত্ররা মেলাঘর থেকে ট্রেনিং করে ফিরে আসে নিজ গ্রামে। স্কুলে আক্রমণ করে সেনা ক্যাম্প ধ্বংস করে এলাকাটি শত্রুমুক্ত করে। এক সময়ে আকাশবাণীর খবরে তারা জানতে পারে ৯০ হাজার সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করেছে পাকিস্তানি বাহিনী। গ্রামের মানুষ মাস্টার মশাইয়ের সমাধিতে বাংলাদেশের পতাকা তুলে বিজয় পালন করে।

নাটকটি পরিচালনা করেছেন নাট্যকার বিশ্বজিৎ বসু ও শর্মিষ্ঠা সাহা। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন অরুণ সাহা, বাপ্পী রায়, সৈয়দ সাজিদ হোসেন, শর্মিষ্ঠা সাহা, বিশ্বজিৎ বসু, আসিফ ইকবাল, বাবলু হীরা মন্ডল, বঙ্কিম শিকারী, অনিন্দিতা দে ত্রয়ী, সাদিকুর রহমান, ফারজানা কাঁকন, রবিন বণিক, নূপুর তুলসান, অমিত দত্ত, পলাশ বড়ুয়া, দেবব্রত ব্যানার্জী ও শৌভিক লাহিড়ী। এ ছাড়া নাটকে ১০ শিশুশিল্পী অভিনয় করেছে। বিস্ময়, আয়ান, দেবর্ষী, মোহিনী, অভিরাজ, রাজর্ষী, শব্দ, অরিকা, নিধি এবং শালিনী।

নাটকে ব্যবহৃত দুটি নাচের কোরিওগ্রাফিসহ ‘জাগো জাগো’ গানটির সঙ্গে নৃত্য পরিবেশন করেন জয়তি মাবরুক। শরণার্থীশিবিরে সংগীত দলের হয়ে ‘তীর হারা ওই ঢেউয়ের সাগর’ গানটি পরিবেশন করেন নজরুল ইসলাম, আসিফ আল মামুন, গার্গী সরকার, পান্না বড়ুয়া লিজা, শর্মিষ্ঠা তালুকদার, সুবর্ণা চৌধুরী, শীব নারায়ণ সাহা, মনোব্রত সাহা ও অর্জুন সরকার। মঞ্চ ব্যবস্থাপনায় ছিলেন অয়ন ভট্যাচার্য, শিশির ঘোষ, নাফিসা আক্তার চৌধুরী। মেকআপে ছিলেন ঈশিতা সুলতানা, প্রম্পটে ছিলেন নুসরাত আক্তার। শব্দ প্রক্ষেপণে ছিলেন ঝুটন কুরী, আলোকসম্পাতে কামরুল আহমেদ। নেপথ্য কণ্ঠ দিয়েছেন সঙ্গীতা সাহা এবং শুভাশিস দাস।

নাটকের একটি দৃশ্য
ছবি: সংগৃহীত

এ নাটকে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার, মুজিবনগর সরকার গঠনসহ মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ের প্রধান প্রধান মাইলফলক। কাহিনির প্রয়োজনে স্বভাবতই চিত্রিত হয়েছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর অত্যাচার, ক্যাম্পগুলোতে নারী নির্যাতন, রাজাকারদের আস্ফালন, বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজের মতো প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো। আধুনিক মঞ্চের সুবিধা নিয়ে ব্যবহৃত ডিজিটাল ব্যাকড্রপ, ভিডিও ফুটেজ, আলোর মায়াজাল, শব্দের মাদকতা, নাচ-গানের মূর্ছনা সর্বোপরি সাবলীল অভিনয়—সব মিলিয়ে অনবদ্য। মুক্তিযুদ্ধকালে টেনশন, হতাশা, বেদনা, একশ্রেণির বিশ্বাসঘাতকতা, দেশপ্রেম, সাধারণ মানুষের জেগে ওঠা এবং বিজয় অর্জন—১৯৭১–এর উত্তাল সময়ে ফিরে যাওয়া উপস্থিত সবার। নাটকে যাঁরা অভিনয় করেছেন এবং দর্শকসারিতে যাঁরা বসে ছিলেন, তাঁদের বেশির ভাগ মুক্তিযুদ্ধ দেখেননি। কিন্তু ‘মাস্টার বাড়ি’র মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে সেদিন সন্ধ্যায় সবাই পৌঁছে গিয়েছিলেন সেই সময়ে, বাঙালির গর্বের ইতিহাসের সাক্ষী হতে।