পৃথ্বীশ রাণার সম্পাদনা ও নির্দেশনায় নাটক ‘বাদাবন’ নির্মাণ

পৃথিবীর গভীরতম অসুখ এই নাটকের মূল উপজীব্য বিষয়; অর্থাৎ বিশ্বব্যাপী উদ্বাস্তু সংকট। সেই সমস্যা খুব অদ্ভুতভাবে মিশে গেছে সুন্দরবনের পটভূমিতে, বনবিবির পালায়। আনা হয়েছে বাংলার শরণার্থী সমস্যার সবচেয়ে বিতর্কিত অধ্যায় ‘মরিচঝাঁপিকে’। একাত্ম হয়ে যেতে হয় ওই প্রান্তিক মানুষগুলোর জীবনযাত্রার সঙ্গে, ওদের গানে-গল্পে। নাটকের শেষে অভিনেতারা যখন মঞ্চে গান গাইছেন, তখন মনে হয় ওঁরাও তো সেই অর্থে উদ্বাস্তু। প্রতিনিয়ত খুঁজে বেড়াচ্ছেন নিজের পায়ের তলার শক্ত জমিটুকু। ওঁরাও আকাশের দিকে তাকিয়ে খুঁজে চলেছেন ধ্রুবতারাকে। যে তারার আলো তাঁদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে এক পরম নিশ্চিন্তের দিকে।

‘বাদাবন’ দেখে মনে হবে, আসলে দেশ হারে না। দেশ হারায় তার মানুষকে। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে। লাখো মানুষ উৎখাত হন নিজের জন্মভিটা থেকে। তাঁরা দলে দলে পাড়ি জমান ভিন দেশে। নতুন দেশে এসেও দুশ্চিন্তায় তাঁদের ঘুম আসে না, ভাবেন পরদিন কোন দেশে কাটাবেন। তাঁদের মনে প্রশ্ন উঁকি দেয়, দুই দেশের সীমানার কাঁটাতারেই শুকাবে না তো তাঁদের অনাগত সন্তানের কাঁথা? যাঁদের মাথার ওপর ছাদ আছে, তাঁদের পক্ষে খুব কঠিন এ বাস্তুহারাদের যন্ত্রণা উপলব্ধি করা।

গতকাল রোববার সন্ধ্যায় (২৬ নভেম্বর ২০২৩) মিনার্ভা থিয়েটার হাউসফুল। বনস্পতির ছায়া স্বনামধন্য লেখক ও নাট্যকার ব্রাত্য বসু। সুদীপ সিংহের লেখা নাটক ‘বাদাবন’। তুখোড় সম্পাদনা ও উচ্চ মানের নির্দেশনায় পৃথ্বীশ রাণা দর্শকদের চমকে দিলেন। মঞ্চ ও আলো দুর্দান্ত পরিবেশন করেছেন শিল্পী অভ্র দাশগুপ্ত। সংগীত অভিজিৎ আচার্য। এককথায় অনবদ্য গান মনকে নাড়া দিয়ে যায়। আবহ বিশ্বজিৎ বিশ্বাস। রূপসজ্জা সুরজিৎ পাল। পোশাক মৌমিতা দত্ত।

অভিনয়ে দাগ কেটেছেন সব নবাগত অভিনেতা। কুর্নিশ জানাতেই হয় নীলাঞ্জন গাঙ্গুলি, রানা বিশ্বাস, রানা গুহ, অনির্বাণ সরকার, অনির্বাণ পাল, বাপ্পা দাস, রাজ রাখাল, তিতুমীর দত্ত, পান্না মণ্ডল, তনিমা মণ্ডল, তোর্ষা গায়েন, সানন্দিতা দাস, ঐন্দ্রিলা চৌধুরীর অভিনয় মুগ্ধ করে।

দক্ষিণ দমদম সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্র প্রযোজিত মাটি কেটে টুকরা হলেও, আকাশ থাকে বাকি। কোথায় আমার দেশ আর আমি কোথায় থাকি—শেষ সংগীত অপূর্ব সুন্দর পরিবেশনে সবাইকেই নতুন আকাশ দেখায়। দেশভাগের যন্ত্রণা চোখের জলে ভিজিয়ে দেয় চিবুক। ‘বাদাবন’ নাটক দেখার পর মনের আকাশজুড়ে জেগে থাকে জন্মভূমি ছাড়ার যন্ত্রণার নানা ছবি। সুন্দরবন থেকে মরিচ ঝাঁপি নানা দৃশ্য ও সংলাপ মুগ্ধ করবেই। ৬টা ৩০ থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত মন্ত্রমুগ্ধের মতো নাটক উপভোগ করতে বারবার দেখুন ‘বাদাবন’, মধ্যে ১০ মিনিটের ব্রেক। পৃথ্বীশ রাণার ‘বাদাবন’ দাগ কেটে গেছে দর্শকদের মনে। করতালির মাধ্যমে সবাই অডিটরিয়াম ভরিয়ে তোলেন। নাটক শেষে সবাই খুব প্রশংসা করলেন শিল্পীদের।

পৃথ্বীশ রাণা নাট্যজগতের একজন স্বনামধন্য প্রাণপুরুষ। পৃথ্বীশ রাণা ইতিপূর্বেই পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি থেকে পুরস্কার পাওয়ায় তাঁর গুণমুগ্ধরা খুবই আনন্দিত হয়েছিলেন।

পৃথ্বীশ রাণার জন্ম ২৪ আগস্ট। খুব ছোট বয়সে নাটকচর্চায় হাতেখড়ি হলেও ২০০৯ সালের শেষকালে কালিন্দী ব্রাত্যজন নাট্যদলে যোগ দেন। নাট্যগুরু ব্রাত্য বসুর অভিভাবকত্বে ধীরে ধীরে বিভিন্ন প্রযোজনায় মঞ্চ পরিকল্পনা, আলোক পরিকল্পনা বা কারিগরি সহায়তা ইত্যাদি বিভাগে নিজের শৈল্পিক চেতন ও নৈপুণ্যের প্রকাশ ঘটান। এবার নতুন রূপে হাজির হলেন দর্শকদের দরবারে। নাটক সম্পাদনা ও পরিচালনা করার মাধ্যমে তিনি জাতীয় পুরস্কার পাওয়ার মতো কাজ করলেন। ২০২০ ও ২০২১ সালে পৃথ্বীশের উল্লেখযোগ্য কাজগুলো হলো বিনয়ের জীবন, পিতৃভূমি, খোকাদা ইত্যাদি।

পৃথ্বীশ রাণা মঞ্চ পরিকল্পক বা আলোক পরিকল্পক হিসেবে ‘ক্যানভাসার’, ‘ব্যোমকেশ’, ‘জায়মান’, ‘আনন্দীবাই’, ‘চন্দ্রগুপ্ত’, ‘হাজু মিঁঞার কিস্‌সা’, ‘পদ্মগোখরো’, ‘তক্ষক’, ‘য্যায়সা কা ত্যায়সা’, ‘চিরকুমার সভা’, ‘হড়পা বান’, ‘হাঁসুলী বাঁকের উপকথা’, ‘অথৈ জল’, ‘জতুগৃহ’, ‘কাঁকড়া’, ‘মুম্বাই নাইটস্’, ‘অমূল্যর ডাইরি’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’, ‘বোমা’, ‘পড়ে পাওয়া ষোল আনা’, ‘তিন তস্কর’, ‘ভয়’, ‘অরণ্যদব’, ‘দেবদাস’, ‘বিবর’, ‘উলঙ্গ প্রজা পরিহিত রাজা’, ‘ট্যাঙ্কি সাফ’, ‘গিরগিটি’, ‘নাসিকা পুরান’, ‘আলাউদ্দিন ও পদ্মাবতী’ ছাড়াও বিভিন্ন নাটকে নিজের কর্মদক্ষতা প্রদর্শন করেন।

ছোটদের নিয়ে থিয়েটার করেছেন বেশ কিছু। যেমন ‘তাসের দেশ’, ‘লক্ষ্মণের শক্তিশেল’, ‘চাঁদের পাহাড়’, ‘ডমরু চরিতকথা’, ‘ভোম্বল সর্দার’, ‘পান্ডব গোয়েন্দা’ প্রভৃতি নাটক। কারিগরি সহায়ক হিসেবে কাজ করেছেন চেনা দুঃখ, চেনা সুখ, সিনেমার মতো, কে?, ‘অপারেশন ২০১৪’, ‘আলতাফ গোমস’, ‘অদ্য শেষ রজনী’, ‘২১ গ্রাম’, ‘পাঁচের পাঁচালী’, ‘মীরজাফর’ প্রভৃতি নাটকে।

পশ্চিমবঙ্গ সরকারের তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের অধীনস্থ মিনার্ভা নাট্য সংস্কৃতিচর্চা কেন্দ্রে বেশ কিছু বছর কো-অর্ডিনেটর পদে চাকরি করেন পৃথ্বীশ রাণা।

শিক্ষাগুরু ব্রাত্য বসুর নাট্যধর্মে দীক্ষিত পৃথ্বীশ বেশ কিছু সম্মান অর্জন করেন কলকাতা ও বিভিন্ন জেলার থিয়েটার দলগুলো থেকে। তার মধ্যে হাওড়া ব্রাত্যজন সম্মান, স্বপ্নদর্শী সম্মান, বালিগঞ্জ রেইনেবা থিয়েটার সম্মান, বিজন ভট্টাচার্য স্মারক সম্মান, হাওড়া নাট্যজন সম্মান, আগরপাড়া থিয়েটার পয়েন্ট সম্মান, যাদবপুর মন্থন সম্মান, অশোকনগর প্রতিবিম্ব সম্মান, গোবরডাঙা শিল্পায়ন সম্মান, রমাপ্রসাদ বণিক স্মারক সম্মান ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

২০২২ সালে পশ্চিমবঙ্গ নাট্য আকাদেমি থেকেও পুরস্কার পেয়েছেন পৃথ্বীশ রাণা।

লেখক: সম্পাদক ও প্রকাশক উদার আকাশ, কলকাতা, ভারত।