অন্যের কন্যাকে আপন করি নিজের কন্যার মতো করে

অলংকরণ: মাসুক হেলাল

আমাদের সমাজে কী হয়—কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া অধিকাংশ ক্ষেত্রে বিয়ের পর মেয়েরা শ্বশুরবাড়ি চলে যায়। আর শ্বশুরবাড়ি মানেই তো নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ। নতুন পরিবেশে নতুন মানুষদের চেনার জন্য, তাদের তার আপন করে নেওয়ার জন্য এবং নতুন পরিবেশের সঙ্গে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য মেয়েটির অনেক সময়ের দরকার হয়।

তার দরকার হয় প্রবল মানসিক শক্তির। ঠিক এ সময়টাতে যদি আশপাশের মানুষ, অর্থাৎ স্বামী, শ্বশুর, শাশুড়ি, জা, ননদ, ভাশুর ও দেবর তাকে সাহায্য না করে তার ছোটখাটো ভুলগুলো ধরে সবাই সমালোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে, তাহলে নতুন পরিবেশে অভ্যস্ত হওয়াটা তখন মেয়েটির জন্য এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। আর একা একা এ চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে গিয়ে দেখা যায়, একপর্যায়ে মেয়েটি ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়ে।

সে বড় নিঃসঙ্গ হয়ে যায়। তার মানসিক শক্তি একেবারে শূন্যের কোঠায় চলে আসে। তখন শুরু হয় তার নানা শারীরিক ও মানসিক সমস্যা। এ সমস্যা থেকে হয়তো মেয়েটির কখনোই আর মুক্তি মেলে না।

যে মেয়েটির জন্ম ও বেড়ে ওঠা তার বাবার বাড়িতে, তার জন্য সে বাড়ির মায়া, মায়াময় আলো-ছায়া, শৈশব ও কৈশোরের হাসি-কান্না, পুতুল খেলার স্মৃতি, আনন্দ-বেদনার পরিবেশ ছেড়ে শ্বশুরবাড়ির নতুন পরিবেশে যাওয়াটাই তো রীতিমতো এক বিরাট  ধাক্কা। মেয়েটি ছেড়ে যায় তার শৈশবের স্মৃতিমাখা শোবার ঘরখানা, যেখানে মা তাকে কোলে নিয়ে ঘুম পাড়ানিয়া গান গেয়ে ঘুম পাড়িয়েছে। সে ছেড়ে যায় তার বাবা, ভাই, বোনদের হাসি আনন্দমাখা মুখগুলো; যে মুখগুলো দেখে সে বড় হয়েছে। তাকে ছাড়তে হয় সে মানুষগুলোকে, যাদের  সঙ্গে রয়েছে তার আত্মার গভীর সম্পর্ক।

আত্মার সম্পর্কের মানুষগুলোকে ফেলে একটি মেয়ে যখন শ্বশুরবাড়ির নতুন কিছু মানুষের কাছে পৌঁছায়, তখন তার মনোজগতে বইতে থাকে এক বিরাট ঝড়। একদিকে মা-বাবা, ভাই-বোনকে ছেড়ে আসার কষ্ট, অন্যদিকে শ্বশুরবাড়ির নতুন মানুষদের আপন করে নেওয়ার, তাদের আপন হওয়ার, পছন্দের মানুষ হওয়ার চ্যালঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ তখন মোটেই তার জন্য সহজ হয় না। একে জয় করার জন্য মেয়েটির দরকার হয় আশপাশের মানুষদের উদার সহযোগিতা। তাদের উৎসাহ। তাদের সমর্থন।। তার কাঁধে তাদের উৎসাহ ও অনুপ্রেরণার হাত।

কিন্তু তা না করে তারা যদি পান থেকে চুন খসলেই তার যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে, তার রান্নায় স্বাদ কম হলে ক্রোধান্বিত শাশুড়ি যদি খাবার টেবিলে তাকে এই বলে ভর্ৎসনা করে যে ‘বাবা-মা তোমাকে কি শুধু হাত-পা চারটা নিয়ে পাঠিয়ে দিয়েছে, রান্নাবান্না কিছু শেখায় নাই’— তখন মেয়েটি অপমান ও লজ্জায় মানসিক শক্তি হারাতে শুরু করে। শ্বশুরবাড়ির লোকজন যখন তার গায়ের রং, তার উচ্চতা, তার চেহারা, তার উচ্চারণ, তার শিক্ষাগত যোগ্যতা,ক্ষেত্র বিশেষে তার মা হতে না পারার অক্ষমতা নিয়ে তাকে অপদস্থ করা শুরু করে, তখন মেয়েটি নিজেকে নতুন পরিবেশের জন্য ক্রমশ অযোগ্য ভাবতে শুরু করে।

এসব আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মেয়েটি তার স্বামীর কাছে আশ্রয় খোঁজে। আশ্রয় খোঁজে পরিবারের অন্য সদস্যদের কাছে, যাদের সে একটু নিরাপদ মনে করে। কিন্তু তারা তাকে আশ্রয় দেওয়ার পরিবর্তে যদি অন্যের সঙ্গে সুরে সুর মেলায়, একই কায়দায় তাকে তিরস্কার করে, তার ছোট ছোট অপারগতা, অযোগ্যতাকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, তখন মেয়েটির আর যাওয়ার কোনো জায়গাই থাকে না। মান-মর্যাদার ভয়ে, সামাজিক কারণে না পারে সে বাবার বাড়িতে ফিরে যেতে, না সে স্বাচ্ছন্দ্যে থাকতে পারে শ্বশুরবাড়িতে। নিজেকে সে বড়ই আশ্রয়হীন মনে করতে থাকে।

ভীষণ অসহায়ত্ব তাকে পেয়ে বসে। তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় সে তিলে তিলে ধুঁকতে থাকে। স্বামী, সংসার—সবকিছু আস্তে আস্তে তার কাছে অসহ্য লাগতে শুরু করে। আর এভাবেই শুরু হয় তার মানসিক জটিলতা। একটি মেয়েকে এভাবে মানসিক জটিলতার দিকে ঠেলে দেওয়ার অধিকার আমাদের কারও নেই।

একজন মা ঠিক যেভাবে তার মেয়েকে শ্বশুরবাড়িতে দেখতে চায়, ঠিক সেভাবে তার উচিত পুত্রবধূকে আদর করা, ভালোবাসা দেওয়া, তার ছোট ছোট অপারগতা বড় করে না দেখে মাতৃস্নেহ নিয়ে তার প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়া। যদি আশা করা হয়, মেয়ের শাশুড়ি তার মেয়েটিকে আস্তে আস্তে সংসারের জন্য তৈরি করে নেবে, তারও উচিত তার পুত্রবধূকে সংসারের জন্য তৈরি করে নেওয়া।

একজন শ্বশুর ঠিক যেভাবে তার মেয়েটিকে শ্বশুরবাড়িতে মর্যাদার আসনে দেখতে চায়, তারও উচিত তার পুত্রবধূকে ঠিক সেভাবে পিতৃস্নেহ দিয়ে তার জন্য মর্যাদার পরিবেশ তৈরি করা।

আর স্বামীর উচিত যেকোনো কঠিন পরিস্থিতিতে স্ত্রীর পাশে দাঁড়ানো। তাকে আশ্রয় দেওয়া, তাকে নিরাপত্তা দেওয়া। তার ভরসার অবলম্বন হওয়া। পরিবারের অন্য সদস্যরা যাতে তার মর্যাদায় আঘাত করতে না পারে, সে বিষয়ে শক্ত অবস্থান নেওয়া।

শ্বশুর-শাশুড়িদের মনে রাখতে হবে যে তারা ছেলেকে বিয়ে করিয়ে ঘরে পুত্রবধূ নিয়ে আসে, চাকরানি নয়। সুতরাং গৃহের সব কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্বও তার একার নয়, এটা সবার। ৩৬৫ দিন পুত্রবধূ একা একা পরিবারের ৪–৫ জন সদস্যের জন্য সকালের নাশতা তৈরি করবে, দুপুর ও রাতের খাবার রান্না করবে, খাওয়া শেষে বাসন-কোসন হাঁড়িপাতিল ধোবে—এটা কখনোই ন্যায়সংগত হতে পারে না। এটা রীতিমতো দাসত্ব। যদিও অসুস্থ, বয়সের ভারে কর্মক্ষমতা হারানো শ্বশুর–শাশুড়ির কথা ভিন্ন।  

বিয়ের পর একটি মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে আসে সংসার সাজাতে, দাসত্বের জন্য নয়। সে–ও রক্তমাংসের মানুষ, মেশিন নয়। তারও শরীর খারাপ থাকতে পারে, ক্লান্তিতে শরীর বিশ্রামের জন্য কাতর থাকতে পারে, একান্ত আপন মনে নিজের সময়টাকে উপভোগ করার ইচ্ছা জাগতে পারে।

ধর্মের দোহাই দিয়ে, মুরব্বিদের সেবা করলে সৃষ্টিকর্তা খুশি হবেন, পরকালে স্বর্গলাভ ঘটবে—এসব যুক্তি দিয়ে পুত্রবধূকে হাত-পা টেপাতে যেসব শ্বশুর–শাশুড়ি বাধ্য করে, তারা রীতিমতো মানবতার অপমান করে। তাদের বাতের ব্যথা নিরাময়ের জন্য ডাক্তারের শরণাপন্ন হওয়া উচিত, পুত্রবধূর নয়। পুত্রবধূ নার্সের ট্রেনিং নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে আসে না যে সে বাতের ব্যথায় শ্বশুর-শাশুড়ির হাত–পা, কোমরে মলম মালিশ করে তাদের ব্যথা নিরাময় করবে।

‘বউ ভিক্সটা নিয়ে এসে পায়ে দুইটা ডলা দিয়ে যাওতো দেখি, পা দুইটা কেমন অবশ হয়ে আসতেছে’— শাশুড়িরা এরকম অন্যায় আবদার করার আগে একটু ভাবা উচিত তার মেয়েটিকে যদি শ্বশুরবাড়িতে তার শাশুড়ি এরকম কাজের জন্য বলে, তাহলে শুনতে তার কেমন লাগবে। আমরা এখন একবিংশ শতাব্দীতে। এই শতাব্দীতে এসেও আমরা যদি মধ্যযুগের বিশ্বাস ও ধ্যানধারণা থেকে বের হয়ে ঘরে ঘরে মানবতার মর্যাদা না দিতে পারি, তাহলে কন্যাদের জীবন যেভাবে দুর্বিষহ ছিল সেভাবেই দুর্বিষহ থাকবে।

আমরা নিজের কন্যার জন্য অন্তরে যে গভীর ভালোবাসা লালন করি, অন্যের কন্যাটি যখন আমাদের ঘরে বউ হয়ে আসবে, তার প্রতিও যেন একই ভালোবাসা দেখাই। শ্বশুরবাড়িটিকে তার শান্তিতে বসবাসের জন্য নিরাপদ ও মর্যাদপূর্ণ আশ্রয় তৈরি করি। তাহলেই কেবল বছর বছর কন্যা দিবস পালন সার্থক ও অর্থবহ হবে।

  • লেখক: লন্ডনপ্রবাসী কবি ও সাংবাদিক