জ্বলজ্বলে জুলাই-১
১.
সামান্য ইতস্তত করে পাশের বাসার কলিং বেলটা টিপে দিলাম। তারপর ভেড়া গোনা শুরু করলাম। ফ্রাউ রিজ-এর বয়স নব্বই। দরজা অবধি আসতে তাই সময় লাগে। তিরিশটা ভেড়ার পর দরজা খুলে গেল হাসিমুখে। হালকা গলায় শুধালাম, ''হ্যালো, ফ্রাউ রিজ। সুপারমার্কেটে যাচ্ছি। আপনার কিছু লাগবে নাকি?"। একদম নিশ্চিত গলায় জবাব এল, "আরে নাহ্, সব আছে ঘরে। কিন্তু খোঁজ নেয়ার জন্যে থ্যাংক্স।"।
দোতালার সিড়ি টপকে নিচে নামতেই ডাক পড়ল, "এক লিটার দুধ আনতে পারবে, ফুল ক্রিম?"। কাঁধ ঘুরিয়ে বললাম, "হ্যাঁ, আলবৎ!"। পা চালিয়ে মেইন গেট খুলে বেরিয়ে যাচ্ছি, অমনি শোনা গেল, "সাথে ছয়টা আলু আর দুইটা কলা পারবে? অর্গানিক হলে ভাল হয়"। হাত নেড়ে তার উড়ন্ত লিস্টিটা ধরে মাথায় পুরে নিয়ে ফুটপাথ ধরলাম। মিউনিখ শহরতলীর এই বাসায় ভাড়ায় উঠেছি বছর দুই হল। পুরো দালানে ছয়টা ফ্ল্যাট। কিন্তু ওঠ-বস বলতে এই পাশের বাসার সাথেই। বাকিদের সাথে বিরল হাই-হ্যালো চলে কদাচিৎ। নিজেও অন্তর্মুখী। কিছুটা ভূত-স্বভাবের। মানুষের ছায়া বাঁচিয়ে চলি আর কি। তারপরও ফ্রাউ রিজের সাথে খাতির হয়ে গেল কি করে, সে এক বিস্ময়।
দোকান এখান থেকে দশ মিনিটের হাঁটা পথ। যাওয়া-আসা-লিস্ট মিলিয়ে বাজার করা, সব মিলিয়ে আধা ঘন্টার মামলা। আধা ঘন্টার মাথায় আবার ডি-৩ ফ্ল্যাটের বোতাম চাপলাম। ওক কাঠের ক্লাসিক ডাইনিং টেবিলে তার সদাইগুলো রাখতে রাখতে খেয়াল করলাম, ফ্রাউ রিজ কোঁচকানো ঘরের কাপড় পাল্টে বেল-বটম ডেনিম ট্রাউজার আর ল্যাভেন্ডার রঙা শার্ট চাপিয়েছেন। লোকের সামনে টিপটপ থাকতে ভালবাসেন উনি। ডাই করা ফিনফিনে বার্গেন্ডি চুলে ঢেউ তুলে হালকা গোলাপি লিপস্টিকে স্নিগ্ধ হাসি ছড়িয়ে ফ্রাউ রিজ বলতে লাগলেন, "তুমি কি ম্যাজিকের মত দৌড়ে গেলে আর দৌড়ে আসলে নাকি?"।
জবাব না দিয়ে অন্যমনষ্ক ভাবে পকেট হাতড়ে বাজারের রশিদ খুঁজতে লাগলাম। উশখুস অস্থিরতা ফ্রাউ রিজের নজর এড়ালো না। "আরে, রশিদ খোঁজা রাখো তো। আগে বলো, তোমাকে এমন লাগছে কেন? চোখের নিচে কালি দেখছি। কি হয়েছে?"।
কি যে হয়েছে, সেটা ফ্রাউ রিজকে বলা উচিত কিনা, দ্রুতবেগে ভাবছি। খামোখাই নিজের অস্থিরতা আরেকজনের ভেতর ছড়িয়ে দিয়ে কি লাভ। ঘটনাগুলো যে ফ্রাউ রিজের সাজানো-গোছানো ইউরোপীয় ড্রইংরুমের সাথে ঠিক যায় না। রুপার মোমদানি গলে একটা চাপা ভ্যানিলা সুবাস এই ঘরটায়। শেষ বিকালের হেঁয়ালি হাওয়ায় সাদা লেসের পর্দাগুলো এলোমেলো উড়ে অস্ট্রিয়ান ক্রিস্টালের ঝাঁড়বাতিতে মৃদু-মন্দ টুংটাং তুলছে থেকে থেকে। আরাম কেদারায় আধবোনা সোয়েটারের পাশে উলের বল জিরোচ্ছে নিরুদ্বেগ।
এই শান্ত-সমাহিত পরিবেশে বসে ফ্রাউ রিজকে কিভাবে বলি যে বাংলাদেশে দুইশো ছাত্রকে গুলি করে মেরে ফেলা হয়েছে। পুলিশ বনাম জনতা। যুদ্ধ যুদ্ধ অবস্থা। চাকরির কোটা নিয়ে শুরু ছাত্রদের নিরীহ দাবির বনামে সরকার পেটোয়া বাহিনী নামিয়ে দিয়েছে। বিদেশের মাটিতে বসে ভয়ংকর সব ছবি আর ভিডিও ফুটেজ দেখতে হচ্ছে। গুলি খেয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ছে কিশোর-তরুন-জনতা। দৃশ্যগুলো দেখে নিজেকে চরম অসহায় লাগছে। তার উপর ফোন-ইন্টারনেট বন্ধ সারাদেশে। ক'দিন ধরে পরিবারের সাথেও কথা হয় নি। দুশ্চিন্তা তাই কপালের ভাঁজে আর চোখের কালিতে বাসা বেঁধেছে ভীষন দুর্বিসহ হয়ে।
ঘটনাগুলো ছোট ছোট জার্মান বাক্যে বলে ফেলে যতি টানলাম, "ফ্রাউ রিজ, রাতে যে আর ঘুমাতে পারছি না"। ফ্রাউ রিজ শুনে গেলেন বটে, কিন্তু তার মুখে সহসাই কোনো কথা সরলো না। ক্যান্সারের রোগী, নব্বই বছরের এই বৃদ্ধাকে আবার কি মানসিক চাপে ফেলে দিলাম ইত্যাদি ভাবছি এদিকে।
ফ্রাউ রিজ অবাক গলায় ধীরে ধীরে শুধালেন, "এ তো আরেক হিটলার। কিন্তু কই, কাগজে বা টিভিতে বাংলাদেশের কোনো খবর তো চোখে পড়লো না"।
ছাত্র আন্দোলনে গুলি চালিয়ে এতগুলো তাজা প্রান মেরে ফেলার ঘটনা আসলেই তেমনভাবে আওয়াজ তোলে নি জার্মানিতে। অন্তত আজকে, জুলাইয়ের ১৯ তারিখ পর্যন্ত। তবে আল-জাজিরায় ফলাও করে ছাপছে ওরা। জার্মানিতে আল জাজিরার পর্দায় লোকে চোখ রাখে কম। তাই সে খবর ফ্রাউ রিজের কান অবধি পৌঁছায় নি। ডয়েচে ভেলে অবশ্যকিছু কিছু লিখছে।
ফ্রাউ রিজ বলে চললেন, "তোমার দেশের খবর ডোনাল্ড ট্রাম্পের কানের নিচে চাপা পড়ার কথা"।
কথা সত্য। পশ্চিমা দুনিয়া এখন তাই নিয়ে ব্যস্ত। কে বা কারা ট্রাম্পের নির্বাচনী সভায় গুলি করেছে। গুলি তার কান ঘেঁষে বেরিয়েছে। এই খবরের দাম এখন মিলিয়ন ডলার।
ফ্রাউ রিজ যোগ করলেন, "দুনিয়া জুড়ে যুদ্ধের দামামা। একদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ তো আরেকদিকে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন। ওদিকে দাবার গুঁটির সব মোক্ষম চাল আমেরিকার হাতে। এর মাঝে কোথাও তোমাদের বাংলাদেশের খবর পাত্তা পাবে না। তার চেয়ে অনেক গরম খবরে তেতে আছে পত্রিকার পাতা আর টিভির স্ক্রিন। যা করার তোমাদেরই করতে হবে। এই মিউনিখে একটা মিটিং-মিছিল যা হোক কিছু করো না। আওয়াজ তোলো"।
চেহারায় একশো ওয়াটের বাতি জ্বেলে উত্তেজিত গলায় বললাম, "হ্যাঁ, কালকে যাচ্ছি আমরা। সিটি সেন্টার, ওডিয়ন্সপ্লাৎজ-এ। একটা জমায়েতের আয়োজন হয়েছে, লোকাল অথরিটির অনুমতি নিয়ে"।
"সের গুট (ভেরি গুড)", উজ্জ্বল হেসে ফ্রাউ রিজ বললেন, "বাংলাদেশ নিয়ে তোমার অস্থিরতা দেখে আজ বহুদিন বাদে একটা স্মৃতি মনে পড়লো"।
"দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ চলছে তখন। আমার জন্ম আর শৈশব হলান্ডে। অনেকগুলো ভাইবোন আর মাকে রেখে বাবা চাকরি করেন জার্মানিতে। পুরোদমে যুদ্ধ বেঁধে গেলে বাবার সাথে যোগাযোগ কেটে যায়। এদিকে টাকার অভাবে পেট চলে না অবস্থা। একদিন এক সজ্জন প্রতিবেশী আমাদের সবাইকে জার্মানি পৌঁছে দেয়ার জন্যে ছোট একটা জাহাজে তুলে দেয়। হাতে ছোট ছোট বোঁচকা নিয়ে শেষবারের মত মাতৃভূমি হলান্ডকে দেখলাম। বিন্দু হয়ে মিলিয়ে যাবার আগ পর্যন্ত দেখলাম। সেদিন আমরা কেউ কাঁদি নি। চোখের জলে দেশটা যদি মূহূর্তের জন্যে ঝাপসা হয়ে যায়, সেই ভয়ে। তারপর সাত দিন সাত রাত থেমে থেমে চলল আমাদের ভয়ংকর এক জার্নি বাই বোট। আকাশ থেকে বোমা পড়ছে তো পানির নিচে সাঁই সাঁই টর্পেডো ছুটছে। এক সময়ে জার্মানির তীরে ভিড়লাম বটে, কিন্তু পায়ের তলের চেনা মাটি হারিয়ে"।
ফ্রাউ রিজ তার ল্যাভেন্ডার শার্টের হাতায় চোখ মুছলেন। জায়গাটা হালকা ল্যাভেন্ডার থেকে গাঢ় বেগুনি হয়ে গেল। তারপর দরজা অবধি এগিয়ে দিয়ে আলতো হাসলেন, "তোমার বাংলাদেশ থাকলো আমার চিন্তায়"।
ফ্রাউ রিজের সহানুভূতিটুকু খুব সযত্নে পকেটে পুরে নিয়ে ভাঙ্গাচোরা চেহারায় বিদায় নিলাম সেদিনের মত।
২.
জুলাইয়ের বিশ তারিখ। শনিবার। প্রচন্ড বিচলিত মন নিয়ে দিনের শুরু। মুঠোফোনে আঙ্গুল বোলাতেই দেশের খবরের কাগজগুলোর শিরোনাম ভেসে উঠল, "জ্বলছে ঢাকা, বাড়ছে লাশ", "সারা দেশে সেনা মোতায়েন", "হেলিকপ্টার থেকেও গুলি, বাদ গেল না পথচারীও"...ইত্যাদি। ফেসবুকে ঢুঁ মারতেই দেখা গেল উত্তরা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর, বাড্ডা গোলাগুলিতে রনক্ষেত্র।
নয় বছরের ছেলে তাফসু মিয়া এসে এক পলক উঁকি দিয়ে দেখে গেল মা কি পড়ছে, কেনই বা মায়ের কপালে বিরাট ভাঁজ। ছোট মানুষ হলেও খবরগুলো পড়ে শোনালাম তাকে। প্রতিদিনই শোনাই। প্রবাসের তুলতুলে জীবনে বসে সুদূর বাংলাদেশের ব্যাপারে চোখে ঠুলি এঁটে রাখা বড্ড সহজ। এই সহজতা থেকে তাকে বের করে আনা দরকার। মায়ের ভিটার ভালমন্দ তার জানার প্রয়োজন আছে। নইলে লেগো'র বাক্স আর রিমোট কন্ট্রোল গাড়ির ভিড়ে কখন যে বাংলাদেশের মানচিত্র ঘোলাটে হয়ে আসবে তার কাছে।
"রামপুরা টু মতিঝিল দিনভর যুদ্ধ", "জনগন আজ খুনি সরকারের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ", "ঢাকা মেডিকেলের হাসপাতালে পড়ে আছে ১৬টা লাশ"। খবরগুলো কোনো রকম সেন্সরবিহীন পড়ে গেলাম রুদ্ধশ্বাসে। সাথে ছবিও দেখালাম তাফসু মিয়াকে। রিকশায় করে এক যুবককে হাসপাতালে নেয়া হচ্ছে। তার বুক চুঁইয়ে রক্ত নেমে রিকশার পা-দানি ভিজে লাল। ছবি দেখে তাফসু মিয়ার ছোট্ট চেহারায় অবোধ ক্ষোভের বিশাল মেঘ জমল যেন।
মেঘ সরিয়ে হালকা গলায় সুধালাম, কি রে বাপ, আজকে যাবি নাকি মিছিলে?"। ওডিয়ন্সপ্লাৎজ-এ? আমরা অনেক বাংলাদেশী জমায়েত হবো সেখানে।
ছেলের কাছ থেকে বিজ্ঞের মত জবাব এল, "আমি গেলে যদি শাখিনাত ভয় পায়, তাহলে তো যেতেই হবে"।
প্রশ্নবোধক জানতে চাইলাম, "শাখিনাতটা আবার কে রে?"।
"আরে ঐযে হেক্সে শাখিনাত, সবাইকে বন্দুক দিয়ে 'ফিউ ফিউ' করে দিচ্ছে। আর জার্মান 'হেক্সে' মানে "ডাইনি", জানো তো তুমি"।
বুঝতে বাকি রইল না এই ছোট্ট অথচ বেজায় ক্ষুব্ধ বালক কার কথা বলছে। মেঘের আড়ালে যেন একখন্ড রুপালি রোদ খেলে গেল। নরম হাতটা আলতো চাপ দিয়ে বললাম, "তাহলে চল রে ব্যাটা, একটা প্ল্যাকার্ড বানাই। নিয়ে আয় তোর রঙের বাক্স"।
বৈঠকখানার মেঝেতে রঙের পসরা বসে গেল। খুঁজেপেতে প্রমান সাইজের চারকোনা একখন্ড কার্ডবোর্ডও মিলল। তাতে বাংলাদেশের পতাকা আঁকা হল লাল-সবুজের আঁচড়ে। আর তার ওপরে ছোট হাতে বড় করে লেখা হল জার্মান শ্লোগান, ''Bangladesh braucht Hilfe!", "বাংলাদেশ সাহায্য চায়"।
''মা, কেমন হয়েছে আমার প্ল্যাকার্ড?"।
প্রশ্নের বনামে প্রশ্ন জুড়লাম, "আজকে থেকে বিশ তিরিশ বছর পর আমরা বেঁচে না থাকলে, আর বাংলাদেশে এমন আরেকটা শাখিনাত আসলে কি তুই বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে তোর বিদেশি শহরের উঠানে পোস্টার হাতে আওয়াজ তুলবি?"।
উত্তরে ভুরু নাচিয়ে রহস্যের জবাব এল, "তোমার কি মনে হয়, মা?"। তারপরই ব্যস্ত আদেশ এল, "এ্যাই মা, পতাকাটা কবজিতে ভাল করে বেঁধে দাও তো.."।
মিনিট পাঁচেক পরে পতাকা-প্ল্যাকার্ড সমেত আমরা হুড়মুড়িয়ে রওনা দিলাম।
৩.
টিপির টিপির বৃষ্টির মাঝেই লাল-নীল-কালো ছাতার ভিড়। সংখ্যাটা বাড়ছে ধীরে ধীরে। ওডিয়ন্সপ্লাৎজ-এর এই জায়গাটার নাম ভিটেলবাখারপ্লাৎজ। সুবিশাল স্কয়ারের তিন পাশে আঠারোশ শতকের রাজকীয় দালান। মাঝখানটায় ধাতব ঘোড়ার পিঠে সওয়ার লুডউইগ দ্যা ফার্স্ট, জার্মানির ষোলশ শতকের বাভারিয়ান ডিউক। আপাতত ডিউক লুডউইগের চারপাশে হল্লা করে ঘুরছে এক দঙল দেশি ছেলেপেলে। তাদের বয়স তিন থেকে তেরো। আর যাদের বয়স এক থেকে দুই, তারা বাবা-মার কোলে-কাঁখে ঝুলছে যেমন তেমন। মন ভরে গেল দেখে যে বাংলাদেশি কম্যুনিটির সবাই ছুটির দিন শনিবারের আরাম হারাম করে আজকে ঘর ঝেঁটিয়ে মিয়া-বিবি-বাচ্চাকাচ্চা সমেত এই খোলা চত্বরে এসে হাজির।
দেখতে দেখতে প্রায় তিনশ মানুষে গম গম করে উঠল ভিটেলবাখারপ্লাৎজের স্কয়ার। হিটলারের শাসনামলে এই পথ দিয়ে নাৎসী সেনার দল লেফট-রাইট মার্চ করতো লিঙ্কস-রেখস্ট, লিঙ্কস-রেখস্ট রবে। হিটলার সাহেবের আবার ছবি আঁকার হাত ছিল দুর্দান্ত। সে এই স্কয়ারের একটা জলছবি এঁকেছিল ১৯১৪ সালে। ধূসর দালানের গা চুঁইয়ে বিকালের সোনালি আলো গলে গলে নামছে ক্যানভাসে। কিন্তু বিচিত্র কারনে সেই আলোতে উষ্ণতা নেই, বরং বিষন্ন শীতলতা। শিল্পীর ক্রুর, ধাতব হৃদয়ের প্রতিচ্ছবি যেন। যাহোক, নিয়তির কালো অজগর স্বৈরাচারী হিটলারকে গিলে খেয়েছে সেই কবে। কাকতালীয়ভাবে আমাদের আজকের আয়োজনের উদ্দেশ্যও আরেক স্বৈরাচার হঠানো।
কাছেই দুই গাড়ি পুলিশ দাঁড়িয়ে। সভা-জমায়েতে পুলিশি পাহারা থাকার নিয়ম। এখানে সভা করার অনুমতি নেয়া হয়েছে খুব চটজলদি। মিউনিখের খুব কড়িতকর্মা কিছু ছেলেপেলে এই পেপারওয়ার্ক, লজিস্টিক্ কাজগুলো খুব দায়িত্ব নিয়ে করেছে চুপচাপ। কে বলে বাঙালি নেতা হতে জানে না। তারা আবার একদল হ্যান্ডনোট-লিফলেট ছাপিয়ে এনেছে। সেগুলো হাতে হাতে বিলি হয়ে গেল নিমিষেই। লাল-সবুজ ফন্টে লেখা ছোট-বড় শ্লোগান, পঙক্তি। 'সারা দুনিয়া খবর দে, স্বৈরাচার কবর দে'। 'লাখো শহীদের রক্তে কেনা দেশটা কারো বাপের না'।
বাচ্চাদের একজন বিরাট উৎসাহে অল্প বয়সী পুলিশ অফিসারের হাতে একটা লিফলেট গুঁজে দিয়ে উধাও হয়ে গেল। বেচারা পুলিশ ছেলেটা কাগজ ধরেছে উল্টো করে। বাংলায় লেখা গোটা গোটা হরফ তাকে রহস্যে ফেলে দিয়েছে। অদূরে দাঁড়িয়ে দেখলাম, সেখানে লেখা 'ভয় পেলে তুমি শেষ, রুখে দাঁড়ালেই বাংলাদেশ'।
কাগজ ছাপিয়ে শ্লোগানগুলো গলায় উঠে এল সবার। রক্ষক থেকে ভক্ষক হয়ে ওঠা শকুনের হাত থেকে মুক্তি চায় সবাই। চটপট কতগুলো সিদ্ধান্ত জানালো হল। যেমন দেশে যেন সবাই টাকা পাঠানো বন্ধ রাখে। শপথ হল এর যেন নড়চড় না হয়। রেমিটেন্স হল প্রবাসীদের ঘোড়া। এই ঘোড়া দিয়ে দেশ থেকে হাজার মাইল দূরে বসেও অদ্ভূত এক দাবা খেলা যায়। ঘোড়া হচ্ছে একমাত্র গুটি যেটা অন্য গুটির ওপর দিয়ে চলতে পারে। ঠিক হল, রেমিটেন্স নামের ঘোড়ায় চড়ে মন্ত্রী-রাজা-সৈন্য সব আমরা ডিঙ্গিয়ে যাব। হাতে না মেরেও ভাতে মেরে ফেলবো অনায়াসে।
আরো ঠিক হল, সবাই আমরা এক গায়েবী যুদ্ধে নামবো। এই যুদ্ধ, টুইটার যুদ্ধ। বাংলাদেশে এখন ইন্টারনেট শাট-ডাউন অবস্থা। গুলি আর হত্যার তান্ডব ধামাচাপার ঠুনকো অপচেষ্টা আর কি। এই বোবা সময়ে ছাত্রদের কন্ঠ হবো প্রবাসীরা। আন্দোলনের খবর ছড়িয়ে দেবো দেশ ছাড়িয়ে বিদেশে। বিশ্ব দরবারের তাতে টনক নড়ুক, না নড়ুক, কোটি প্রবাসী এক হওয়াটাও কম অর্জন না।
তিনশ লোকের সভায় ছয়শ হাত বজ্রমুষ্ঠি হল সেদিন। বাড়ি ফিরতে ফিরতে কেন যেন মনে হল এই ভিটেলবাখারপ্লাৎজে আবার আসতে হবে। জালিমের হাতে চাবুক থাকে। কিন্তু মজলুমের হাতেও যে নিদেনপক্ষে এক ছড়া দড়ি থাকে। দড়ি ধরে মারো টান, রাজা হবে খান খান। সুদূর বাংলাদেশের হীরক রাজা হঠাতে দড়ি হাতে বার বার আমরা জড়ো হব এই ভিনদেশী ময়দানে। চলবে...
লেখক : ড. রিম সাবরিনা জাহান সরকার, মিউনিখের একটি ক্লিনিক্যাল রিসার্চ সংস্থায় মেডিকেল রাইটার হিসেবে কর্মরত
ইমেইল: [email protected]